ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৫ ১৪৩০

নারীর জয় দিয়েই জয় হোক বিশ্বের

ডা. দীপু মনি

প্রকাশিত : ১০:০৬ পিএম, ৮ মার্চ ২০২১ সোমবার | আপডেট: ১১:১৬ এএম, ৯ মার্চ ২০২১ মঙ্গলবার

আমাদের প্রত্যেক নারীকে সংগ্রাম ভালোবাসতে হবে। ঝুঁকি নিয়েই পর্বত আরোহন করতে হবে। তবেই আমরা নেতৃত্বে আসতে পারবো। আগে আমরা পুলিশকে দেখেছি নির্যাতনকারী হিসেবে। এখন তারা হয়েছে জনতার বন্ধু। পুলিশ প্রতিটি থানাতেই নারী সহায়তা সেন্টার খুলেছে। যেখানে একজন নারী সহজেই পুলিশের সহায়তা পাবেন। এ উদ্যোগগুলোই নারী অধিকারের প্রতি বতর্মান সরকারের বিশেষ উদ্যোগ।

একজন নারীকে ভালো পদে অধিষ্ঠিত হতে হলে সে পদে তার সমকক্ষ পুরুষের চেয়ে বেশি যোগ্যতা সম্পন্ন হতে হয়। যেমন আমি যখন একজন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হলাম, তখন কেউ কেউ বলেছিল- উনি কিভাবে কোন দক্ষতায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছেন?

মানুষ মাত্রই রাজনৈতিক প্রাণি। আমরা খুব স্বাভাবিকভাবেই বলি যে, আমি ওই দলকে পছন্দ করি, অমুক দলকে পছন্দ করি, আমি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। আমি তো যে কোনও দলকে ভোট দিতে পারি, যে কোনও দলকে পছন্দ করতে পারি। আমি নারীর অধিকারে যদি বিশ্বাস করি, তাহলে আমার এমন রাজনৈতিক দল পছন্দ করা উচিত নয়, এমন কোনও রাজনীতিকে বেছে নেয়া উচিত নয়, যে রাজনীতি নারীর অধিকারের বিরুদ্ধে কাজ করে, যে রাজনৈতিক দল বা দল পরিচালিত সরকার নারীর অধিকার হরণ করে, নারীকে পিছিয়ে দেয়।

যে রাজনীতি নারীর অধিকার কেড়ে নিয়েছে সে রাজনীতি আমরা চাই না। আমরা যতদিন নারী বিদ্বেষী রাজনীতির সঙ্গে থাকবো এবং তাদের ভণ্ডামী থেকে বের হতে পারবো না, ততদিন আমাদের পূর্ণ অধিকার পাবো না।

স্বাধীনতার পক্ষের যে রাজনীতি, নারীর পক্ষের যে রাজনীতি, সেখানেও নিশ্চিয়ই ভালো-মন্দ আছে। সেখানেও নিশ্চিয়ই কেউ না কেউ আছেন যারা হয়তো নিয়ম ভাঙেন, আইন ভাঙেন, অন্যায় করেন। তাদের বিরুদ্ধেও সোচ্চার হব, তাদেরকে প্রতিহত করব। কিন্তু রাজনীতির জায়গাটা যেন সঠিক থাকে। সেই সঠিক রাজনীতিটাই করতে হবে। 

আমার সন্তানকে আমি যদি শেখাতে চাই নারীর প্রতি সম্মান, তাহলে আগে আমার বাড়িতে সেই পরিবেশটা তৈরি করতে হবে। সেটা শুধু একজন নারী, একজন মা, একজন স্ত্রী করতে পারবেন না। সেখানে বাবা, স্বামী, ভাইয়েরও অংশ নিতে হবে। তাহলেই সেই সমাজটা তৈরি হবে। কাজেই দায়িত্বটা শুধু একজন নারীর নয়, আমাদের সকলের। সবাইকেই সে দায়িত্বটা যথাযথভাবে পালন করতে হবে। 

কারণ, নারী বিদ্বেষী যে সমাজ সে সমাজ কোনোদিনও এগোবে না। নারীকে বাদ দিয়ে কোনোদিন কোনও সমাজ এগোতে পারেনি। বেগম রোকেয়াই বলে গেছেন, একটা পাখির একটা ডানা বেঁধে রাখলে পাখিটি উড়তে পারবে না। তেমনি আমাদের একটা হাত একটা পা বেঁধে দিলে আমরা সাঁতার কাটতে পারবো না। 

আমাদের দেশটা এগিয়ে যাচ্ছে অপ্রতিরোধ্য গতিতে। কারণ, তার নেতৃত্বে আছেন এমন এক নারী, যিনি আমাদের সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রতিটি মানুষকে নিয়ে ভাবেন, নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ-শিশু, প্রান্তিক মানুষ- সকল মানুষকে নিয়ে তিনি ভাবেন। সেজন্যই আজকে আমাদের ক্ষুদ্র-নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর শিশুরাও তাদের মাতৃভাষাতেই পড়ালেখার সুযোগ পাচ্ছে। এই যে সবাইকে নিয়ে ভাবা, এটা আমাদের ভাবতে হবে এবং সেই সঠিক রাজনীতিটাই আমাদের করতে হবে। আর বেশি শক্তি যোগাতে হবে।

সেইসঙ্গে যেটা অপরাজনীতি সেটা পরিত্যাগ করতে হবে এবং সেটাকে বলতে হবে এটা খারাপ। কারণ নারীর অধিকার রাজনীতির বাইরে নয়। বরং নারীর অধিকার অসম্ভব রকমের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ইস্যু। আর সেটা একমাত্র সঠিক রাজনীতিই পারে সেই অধিকারকে নিশ্চিত করতে।       

বঙ্গবন্ধু নারীর মর্যাদা দিয়েছেন। তাদের অধিকার দিয়েছেন। নারীদের বীরাঙ্গনা উপাধি দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর কন্যা ১৯৯৭ সালে নারী নীতিমালা করেছেন। নীতিমালায় নারীর অধিকার ও ক্ষমতায়ন সন্নিবেশ ঘটিয়েছেন। কিন্তু নারী বিদ্বেষী রাজনীতিকরা ২০০৫ সালে নারী নীতিকে কেটেছেঁটে নারীর সম্পদ ও ক্ষমতায়নের অধিকার ক্ষুন্ন করেছে। বর্তমানে আবার আমাদের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। নারীর ক্ষমতায়ন হচ্ছে। প্রতিটি কর্মস্থলে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়েছে। 

প্রতিটি মা তার ছেলেকে বলে যে, তুমি নারীকে সম্মান করবে। কিন্তু সে যদি দেখে যে, তার বাবাই তার মাকে অসম্মান করছে, তাহলে সে তো সেটাই শিখবে। কারণ, স্কুলে গিয়ে বা পড়ে শেখার চেয়ে দেখে শেখাটা অনেক বড়। কাজেই সে যখন দেখবে, তার বাবা একজন নারীকে অসম্মান করে, সে তখন অসম্মান করাটাই শিখবে। 

এক্ষেত্রে দায়িত্বটা কিন্তু বরাবরই আমরা নারীকেই দিয়ে থাকি। সব জায়গায়, সব ক্ষেত্রেই। সবকিছুর ভার যেন নারীরই। অবশ্য প্রকৃতিও তাকে বেশি দায়িত্বই দিয়েছে। কারণ, নারীরা দায়িত্ব নিতে পারে। আর সেজন্যই পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন দায়িত্ব সন্তান ধারণ, সন্তান জন্মদান- যেগুলো না হলে মানব সভ্যতাই থমকে যেত, সেই গুরুত্বপূর্ণ কাজই বিশ্বাস আর আস্থা নিয়ে প্রকৃতি নারীকে দিয়েছে।

কারণ, সে জানে- নারী এটা পারবে, নারীর সেই সক্ষমতা আছে। নারীর সেই দায়িত্ববোধ আছে, কর্তব্যবোধ আছে, কষ্টসহিষ্ণুতা আছে। নারী আসলেই অনেক অনেক শক্ত। আর সেইজন্যেই নারী অনেক শক্তিশালী। আরেকটি বিষয় হলো- আমাদের এই উপমহাদেশে তো বটেই, বিশ্বের নানা স্থানেও দেবী হিসেবে নারীকে পূজো করা হয়। অথচ মানবী হিসেবে তার যে প্রাপ্য সম্মানটুকু, সেটা দেয়া হয় না। 

আমরা তো অনেক বেশি কিছু চাইছি না, আমরাও যে মানুষ, শুধুমাত্র সেই স্বীকৃতিটুকুই চাই। অন্য দশজন পুরুষ যেমন নির্বিঘ্নে কোথাও যেতে পারে, ঘুরতে পারে, নারীরাও যেন সেই সুযোগ পায়, আমি সেটুকুই চাইছি। আর এজন্য আমাদের সেই মানসিকতার একটা জায়গা তৈরী করতে হবে। 

এই যে পদে পদে ধর্ষণের ভয়, নারীরা বের হতে পারে না রাস্তায়, এই নিরাপত্তাহীনতা থেকেই তো ভয়টা আসে। এটা যে শুধুমাত্র বিকৃত মানসিকতার একটা বহিঃপ্রকাশ তা কিন্তু নয়, সঙ্গে সঙ্গে নিজের শক্তিমত্তা প্রকাশের একটা মাধ্যম হিসেবেও মনে করে বিকৃত মানসিকতার কোনও কোনও পুরুষ। 

আর এটিকে নির্যাতনের একটি চরম রূপ হিসেবেও বেছে নেয়। এমনকি যুদ্ধেও এটাকে অস্ত্র হিসেবে বেছে নেয়। শুধু যুদ্ধ নয়, পাড়ায় পাড়ায় সংঘাত, এ বাড়ি ও বাড়ি সংঘাত, জমি-জমা নিয়ে মামলা-মোকদ্দমা, এসবের মধ্যেও কিন্তু নারীকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়। 

কিন্তু সেটা কেন ব্যবহার করা হয়? তার কারণ আমরা দেখি যে, কোনও ধর্ষণের ঘটনায় ধর্ষককে যদি ধরা যায়, যদি তার বিচার করা যায়, তাহলে হয়তো তাকে একবার দণ্ডিত করা হয় এবং সে দণ্ডটা ভোগ করে। কিন্তু ধর্ষিতা নারী প্রতিদিনই প্রায় মৃত্যুদণ্ডের সমান দণ্ড ভোগ করে চলে। কারণ সমাজ তাকে স্বাভাবিক জীবন যাপনের আর কোনও সুযোগ দেয় না। আর তার আপনজনেরাও সেই পরিবেশটা তৈরি করে দেয়না। 

কাজেই নারীর জন্য ধর্ষণের ঘটনাকে মনে করা হয়- প্রায় একটা মৃত্যুদণ্ডের মতো। আর সেই কারণেই এটা আরও ঘটে, সেই কারণেই এই অস্ত্রটা আরও বেশি করে প্রয়োগ করে সেই রকম বিকৃত মানসিকতার পুরুষ। কাজেই আমাদের এই ধরণের মানসিকতার পরিবর্তন আনা দরকার।  

একজন পুরুষ যদি গাড়ি চাপা পড়ে, একজন পুরুষ যদি হিংস্র কোনও প্রাণির হামলার শিকার হয়, আমরা তো বলি না যে, তার সম্মান নষ্ট হয়েছে, আমরা তো বলিনা- তার সম্ভ্রমহানী ঘটেছে। কিন্তু একজন নারী ধর্ষিত হলে আমরা বলি, তার সম্ভ্রম চলে গেছে। সেই কারণেই এটা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়। কাজেই আমাদের এই জায়গাটিতে একটা নতুন করে চিন্তা করার প্রয়োজন রয়েছে। 

আর এক্ষেত্রে আমি প্রায়ই বলি, ভাষার একটা অসম্ভব রকমের প্রভাব রয়েছে। কেননা, এই ভাষাই আমাদের নারী-পুরুষের মাঝে একটা বড় পার্থক্য করে দেয়। আমাকে শেখায় যে, নারী ও পুরুষ ভিন্ন এবং নারীকে তুলে ধরা হয় অনেক বেশি নেতিবাচকভাবে। যেমন- ডাইনী, পেত্নী, শাঁকচুন্নি- যেগুলোর কোনও পুরুষ বাচক শব্দ নেই। শুধুমাত্র নারীর জন্যই প্রযোজ্য।

পতিব্রতা নারী, একেবারেই অসাধারণ ভালো। আর স্ত্রৈণ পুরুষ একেবারেই খারাপ। এরকম আরও আছে, কোনও শেষ নেই। যে পুরুষের স্ত্রী মারা গেছেন, আমরা নিশ্চয়ই দুঃখ প্রকাশ করি, কিন্তু গ্রাম্য প্রবাদ আছে- যার কপাল খারাপ তার গরু মরে, আর যার কপাল ভালো তার বউ মরে। কাজেই যার স্ত্রী মারা গেছে, তাকে কিন্তু সমাজ বেশ সৌভাগ্যবান মনে করে। 

অন্যদিকে যে নারীর স্বামী মারা গেছেন, যে নারী বৈধব্য বরণ করেছেন, সে নারীর জন্য তার জীবনটা যেন একেবারেই শেষ হয়ে গেছে- সেই রকম একটা অবস্থার সৃষ্টি হয়। এখন আর সনাতন ধর্মের সেই সতীদাহ প্রথা না থাকলেও, মোটামুটি তার জীবনটা একই অবস্থায় চলে যায়।

এই যে ভাষা দিয়ে, ভাষার প্রয়োগ দিয়ে আমরা যেভাবে নারীকে আরও বেশি বৈষম্যের স্বীকার করি। সেইজন্য আমাদের এই ব্যাপারগুলো নিয়ে ভাবতে হবে। আমরা যেন নারীর কথা ভাবি, প্রতিদিন যেন নারীকে এগিয়ে দিই। যেন নারী-পুরুষ উভয় মিলে আমরা একটা সমতার বিশ্ব গড়তে পারি। 

আরেকটা কথা বলি, এই করোনার সময় বিশ্বে যে কয়টি দেশে নারীরা নেতৃত্বে আছেন, সেই কটি দেশ করোনাকে মোকাবেলা করেছেন সবচেয়ে সফলভাবে। অবশ্য এটা খুব বিচিত্র ঘটনা নয়। কারণ নারীরা প্রতিদিন সংসারে, এক রান্নাঘরেই প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত যে সব সমস্যার সমাধান করেন, তাতে তাদেরকে আপনি যে কাজই দেন না কেন, তিনি কিন্তু অভিনব একটা সমাধান বের করেই ফেলবেন। কারণ তাঁর কোনও উপায় নাই, তাকে করতেই হয়। 

আর সে কারণেই তিনি সবকিছু পারেন এবং তিনি সর্বংসহা, তাঁর কষ্টসহিষ্ণুতা অনেক। কারণ প্রকৃতি তাকে সেভাবেই তৈরি করেছে। এখানে একজন বলছিল যে, নারী আর প্রকৃতি এক- আসলেই তাই। সুতরাং নারীর জয় হোক এবং নারীর জয় দিয়েই নারী-পুরুষ উভয়ের জয় হোক। সবার জন্য একটা সমতার বিশ্ব হোক, যে বিশ্ব থেকে সব ধরণের সহিংসতা দূর হয়ে যাক। সবার জন্যে একটা শান্তির বিশ্ব তৈরি হোক।

(আন্তর্জাতিক নারী দিবসে একুশে টেলিভিশন আয়োজিত অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির বক্তব্য) 

এনএস/