ঢাকা, শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ১২ ১৪৩১

বিশ্ববাসীর কাছে আলোচিত নাম ড. রুবাব খান

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১০:০১ এএম, ১২ মার্চ ২০২১ শুক্রবার

ছোটবেলার কথা। লোডশেডিং হলে মা প্রায়ই ছাদে নিয়ে তারা দেখাতেন। পরিচয় করিয়ে দিতেন সপ্তর্ষিমণ্ডল, মঙ্গলগ্রহের সঙ্গে। মহাকাশ নিয়ে ছেলেটির আগ্রহটা তৈরি হয় মূলত তখন থেকেই। পরবর্তীকালে উদয়ন স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় কোয়ান্টাম মেথড কোর্সে অংশ নেন তিনি। সেই কোর্সই তার জীবনের সেরা কোর্স। যা তাকে বদলে দিয়েছে। জীবনের চূড়ান্ত স্বপ্নটি ছুঁয়ে দেখতে সাহায্য করেছে।

কোর্সে তার সবচেয়ে ভালো লেগেছিল মনছবির মেডিটেশন। সেদিন ছেলেটি মনছবি করেছিলেন একজন মহাকাশ বিজ্ঞানী হিসেবে কাজ করার। বলা যায়, জীবনের লক্ষ্যটা তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন মনছবির মেডিটেশনে।

সেই ছেলেটির নাম ড. রুবাব খান। যার জীবনের বড় একটি অংশ কেটেছে রাজধানী ঢাকায়। রাজধানীর উদয়ন স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন তিনি। পরে নটরডেম কলেজ থেকে পাস করেন এইচএসসি। ছোটবেলা থেকেই জ্যোতিবিজ্ঞানী হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন।

২০০৪ সালে রুবাব খান পদার্থবিদ্যার বিশেষ শাখা অ্যাস্ট্রোফিজিকসে পড়াশোনার জন্য কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে বৃত্তি পান। ২০০৮ সালে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেন তিনি। পরে ২০১৪ সালে ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি সম্পন্ন করেন তিনি।

যুক্তরাষ্ট্রেই উচ্চতর পড়াশোনা সম্পন্ন করে . রুবাব খান কাজ শুরু করেন ন্যাশনাল অ্যারোনটিক্স অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে (নাসা)

তিনি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ডে অবস্থিত নাসার গডার্ড স্পেস ফ্লাইটের একদল গবেষকের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। সম্প্রতি মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার গবেষণা দল খুঁজে পেয়েছেন ইটা কারিনার মতো আরাধ্য ৫টি বিশাল নক্ষত্র যা অবস্থান করছে মিল্কিওয়ের বাইরের গ্যালাক্সিগুলোতে। আর সেই গবেষণা দলের নেতৃত্বে ছিলেন বাংলাদেশের পাকুন্দা গ্রামের ছেলে . রুবাব ইমরাজ খান তাঁর এই আবিষ্কার হয়তো মহাকাশ সম্পর্কে আমাদের এত দিনের ধারণা বদলে দেবে!

সুপারস্টার বা বাংলায় বলা হয় মহাতারকা। আমাদের ছায়াপথ আকাশগঙ্গায় সূর্য থেকে ৫০ লাখ গুণ বড় তেমনি এক নক্ষত্র ইটা কারিনা। ১৩ লাখ গ্রহকে নিয়ে সেই নক্ষত্রটির জগৎ। এমনই আরো পাঁচটি সুপারস্টার আবিষ্কার করেছেন একদল বিজ্ঞানী। এমন যুগান্তকারী আবিস্কারের জন্য বিশ্ববাসীর কাছে এখন আলোচিত নাম . রুবাব ইমরাজ খান।

তার সাফল্যের গল্পটা এতো সহজ ছিলো না। নিজের উপরে আত্মাবিশ্বাস তাকে এই অবস্থানে নিয়ে এসেছে।

নিজের স্বপ্নের সমান বড় হওয়ার গল্প নিয়ে ড. রুবাব ইমরাজ খান বলেন, বাবা মায়ের স্বপ্ন ছিলো ছেলে শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করে ভালে একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করবে। কিন্তু তার ইচ্ছা ছিল আকাশ ছোঁয়ার। আর সেই ইচ্ছে শক্তির কারণেই বিশ্ববাসীর ধারণা বদলে দেয় এই আকাশ ছোঁয়া ৩০ বছর বয়সী বাংলাদেশি। নূরুল রহমান খান ফিকরিয়া বেগমের দুই ছেলমেয়ের মধ্যে বড় সন্তান তিনিই। বাবা নূরুল রহমান খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক এবং মা ফিকরিয়া বেগম সেন্টার ওমেন্স ইউনিভার্সিটির দর্শন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক।

বিতর্ক কুইজে পারদর্শী বাংলা মাধ্যমের এই ছাত্র উদায়ন স্কুল থেকে এসএসসি নটরডেম কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। তারপর বাবার ইচ্ছে রাখতেই ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএতে। কিন্তু আকাশ ছোঁয়ার ইচ্ছেতেই আবেদন করতে থাকেন বিদেশি নামীদামি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। এর মধ্যে সুযোগ আসে বৃত্তিসহ যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে জোতিপদার্থবিজ্ঞানে পড়ার।

. রুবাব কিভাবে স্বপ্ন বাস্তবায়ন করলেন তা তার নিজ মুখ থেকেই জেনে নেই- এই স্বপ্নের যাত্রা শুরু হয় মায়ের হাত ধরে যখন ছাদে উঠতেন সেই থেকেই। তখন তার মা মহাকাশ সর্ম্পকে নানা বিষয়ে বলতেন। তখন থেকেই তিনি স্বপ্ন দেখেন মহাকাশ নিয়ে গবেষণা করার। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার স্বপ্নের পরিধিও বাড়তে থাকে। তার বয়স যখন বছর তখন থেকেই কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের প্রশিক্ষণে উপস্থিত হয়ে মনোছবি দেখতে বসেন। তখনই তার মনে জ্যোতিবিজ্ঞান হওয়ার স্বপ্ন জাগে।

যেহেতু আমাদের দেশে মহাকাশ বিজ্ঞান নিয়ে তেমন কোন লেখা পড়া নেই। সেহেতু বিদেশে গিয়েই পড়াশুনা করতে হবে। তখন থেকে এই বিষয় পড়াশুনা প্রস্তুতি নিতে শুরু করলাম। ১৬টি বিশ্ববিদ্যালয় পড়ার জন্য আবেদন করলাম। আমি তিন বছর আগে থেকে প্রস্তুতি নিয়েছিলাম, তবে টাকার জন্য টেনশনে ছিলো বাবা-মা, কিন্তু আমি হতাশ ছিলাম না।

তিনি আরও বলেন, একদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে দিয়ে আসছিলাম, তখন ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের দিকে চোখে পড়ল, তাই নামেমাত্র ফি দিয়ে আইবিএতে ভর্তি হয়ে গেলাম। আমি তখন সিন্ধান্ত নিয়ে ছিলাম যদি বিদেশ না যেতে পারি তাহলে আইবিএ শেষ করবো। তবে কিছুদিনের মধ্যে সংবাদ আসল, কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে বৃত্তিসহ পড়ার সুযোগ।

গবেষণার জন্য সুযোগ তৈরি হল, জানাতে পারলাম এই বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন একজন শিক্ষক এসেছে। তার ল্যাবে আমি গবেষণা কাজ শুরু করলাম। মাসে কিছু টাকাও দিতো, যা দিয়ে হাতখরচ চলতো।  পড়াশুনা শেষ করতে না করতে সেই শিক্ষক আমাকে একটি জবের ব্যবস্থা করে দিল। সেই প্রতিষ্ঠানে আমি সব থেকে ছোট ছিলাম।

পড়াশুনা শেষ করে আমি গবেষণা করা জন্য মনোনিবেশ করলাম। এর মধ্যে বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে দেখার সুযোগ হলো। অবশেষে ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটিতে গবেষণার কাজ শুরু করলাম। আমি যে ধরনের গবেষণা করতে চাচ্ছিলাম, এটার জন্য সবচেয়ে ভাল পরিবেশ ছিলো ওহাইও বিশ্ববিদ্যালয়। তবে দু:খের বিষয় আমি পড়াশুনা শেষ করে ৩০টার উপরে চাকরির জন্য আবেদন করেও চাকরি মিলল না। তবে আমি কখনই হতাশ হয়নি। কারণ আমি আত্মবিশ্বাসী ছিলাম, আমি মহাতারকা খোঁজে বের হরার গবেষণা শুরু করলাম। এখন আমার স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয়েছে।

. রুবাব বিশ্বাস করেন নিয়মিত মনছবির মেডিটেশন করলে এবং সৎসঙ্ঘে একাত্ম থাকলে একজন মানুষ সহজেই জীবনের লক্ষ্য স্থির করতে পারবে এবং পায়ে পায়ে এগিয়ে যেতে পারবে সেই লক্ষ্য অর্জনের পথে।

মেডিটেশনে আমার ব্রেন আমাকে বলেছিল, ‘ভুলে যাও যে তুমি ভালো ছাত্র। আর তোমার জীবনের লক্ষ্য নিয়ে ভাবো।

আজ মনে হয়, আমার ব্রেন সেদিন আমাকে খুব সময়োপযোগী পরামর্শ দিয়েছিল। কারণ আমার ভেতরে একটা গর্ব ছিল যদিও ক্লাসে প্রথম হচ্ছি না কিন্তু আমি যদি চাই তবে ঠিকই হয়ে যাব। ব্রেনের পরামর্শ থেকে বুঝলাম, এসব হেঁয়ালি ছাড়তে হবে। লক্ষ্যে পৌঁছার জন্যে প্রয়োজনীয় কাজে মনোযোগ দিতে হবে।

তখন বাংলাদেশে এস্ট্রোফিজিক্স নিয়ে পড়ার সুযোগ ছিল না। অতএব দেশের বাইরে গিয়ে পড়তে হবে। এজন্যে প্রথমত, ভালো কোনো কলেজের রিকমেন্ডেশন লেটার প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, এইচএসসি-র পর স্যাট ও টোফেল দিতে হবে। আমি তাই এসএসসি-র পর থেকেই প্রস্তুতি নিতে শুরু করলাম।

স্কুলে পড়ার সময়ই আমি ভালো কলেজে ভর্তির জন্যে প্রস্তুতি নিয়েছি। নটরডেম কলেজে ভর্তির সুযোগ পেলাম। বিদেশে মানসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পেতে হলে ভালো রেজাল্টের পাশাপাশি সহশিক্ষা কার্যক্রমও থাকতে হয়। তাই স্কুল ও কলেজে আমি ডিবেটিং ক্লাব, সায়েন্স ক্লাব ও কালচারাল ক্লাবে সক্রিয় ছিলাম।

এইচএসসি-র পর যুক্তরাষ্ট্রের ১৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করলাম যেখানে স্কলারশিপসহ এস্ট্রোফিজিক্স পড়তে পারব। এদিকে আমি দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতিও নিয়েছিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলাম। ভর্তিও হয়ে গেলাম। কারণ ১২ বছরের একটি কিশোর স্বতঃস্ফূর্তভাবে যে সিদ্ধান্ত নিতে পারে, এইচএসসি পরীক্ষার্থী একজন তরুণের জন্যে সেই সাহসী স্বপ্ন দেখা ততটা সহজ নয়। বাস্তবতা আর নানারকম যুক্তি তার মনে ভর করে। আর এ-ক্ষেত্রে মেডিটেশন হতে পারে সবচেয়ে সহায়ক, যা একজন মানুষকে লক্ষ্যের জন্যে নিরলস চেষ্টা চালিয়ে যেতে শক্তি জোগায়।

তাই অভিভাবকদের অনুরোধ করি, আপনার সন্তানের বয়স সাত-আট বছর হলে তাকে মেডিটেশনে উদ্বুদ্ধ করুন। তাহলে সে লক্ষ্য স্থির করতে পারবে জীবনের শুরুতেই। সেইসাথে নিয়মিত মেডিটেশন তাকে দেবে লক্ষ্যের পথে বাধা অতিক্রম করার শক্তি।

আমি দেখলাম উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে লক্ষ্যে পৌঁছানোর পথে বাধা তিনটি।

এক, বাংলা মিডিয়ামে পড়ে ইংরেজি ভালোভাবে শেখা হয় না।

দুই, অর্থের সংস্থান।

আর তিন হচ্ছে, চেষ্টা না করা।

ভাষা আমি ভালোভাবে শিখলাম। স্কলারশিপের প্রস্তুতি নিয়ে আবেদন করলাম, ফলে অর্থাভাব দূর হলো। আর শেষ হচ্ছে চেষ্টা বা লেগে থাকা। একজন মানুষ যখন চেষ্টা করে, প্রস্তুতি নেয়, সৌভাগ্য তার কাছেই ধরা দেয়।

 

আমি সৌভাগ্যবান। নিউইয়র্কের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে এস্ট্রোফিজিক্সে ভর্তির সুযোগ পেয়ে গেলাম। মনছবিই ছিল এ-ক্ষেত্রে আমার সবচেয়ে বড় সহায়ক শক্তি। আমি যদি আগে থেকে প্রস্তুতি না নিতাম, তাহলে সৌভাগ্য আমার কাছে এলেও আমি সুযোগটা নিতে পারতাম না।

প্রথম সেমিস্টার থেকেই আমি গবেষণার খোঁজ নিতে শুরু করি। খুঁজতে খুঁজতেই সুযোগ পেলাম বড় ও আলোচিত একটি প্রজেক্টে কাজ করার। চতুর্থ বর্ষে পড়ার সময়ই এ প্রজেক্টের গবেষকদের নামের তালিকায় আমার নাম অন্তর্ভুক্ত হয়। গবেষকদের মধ্যে আমি ছিলাম সর্বকনিষ্ঠ।

গ্রাজুয়েশনের পর পিএইচডি প্রোগ্রামে পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমি কাজের প্রস্তাব পেলাম। দেখলাম, ওহাইও স্টেট বিশ্ববিদ্যালয় আমার কাজের জন্যে সবচেয়ে ভালো হয়। ওখানে পিএইচডি শুরু করলাম।

পিএইচডির পর ২০১৪-তে আমি যোগ দিলাম যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা-র গোডার্ড স্পেস ফ্লাইট সেন্টারে। নাসা আমাকে দুই বছরের জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ ফেলোশিপ দেয়। এতে আমার মৌলিক গবেষণার কাজটিও আমি এগিয়ে নিতে পারলাম। ২০১৮ সালে নাসা এ টেলিস্কোপটি মহাকাশে পাঠাবে।

আমার গবেষণায় আমি ইটা ক্যারিনা-র মতো জীবনের শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে এমন তারাগুলো খুঁজছিলাম। ডিসেম্বর ২০১৫-তে আমি পাঁচটি আলাদা গ্যালাক্সিতে এরকম পাঁচটি সুপারস্টার খুঁজে পেলাম। নাসা তাদের গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারগুলো সংবাদ সম্মেলন করে সবাইকে জানায়। এ আবিষ্কারটি ছিল সে-রকমই একটি সাড়া জাগানো আবিষ্কার।

ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটন সিয়াটল থেকে ২০২৪ সালে ওয়াইল্ড ফিল্ড ইনফ্রারেড টেলিস্কোপ পাঠানো হবে। এখন আমি সেটা নিয়ে গবেষণা করছি। পাশাপাশি আমার যে মৌলিক গবেষণা ছিল, তা-ও চালিয়ে যাচ্ছি।

তরুণদের বলি, মনছবির দর্শনটাকে নিজের মাঝে ধারণ করুন। সবসময় মনে রাখুন, আপনার লক্ষ্য কী, সে লক্ষ্যের জন্যে আজ আপনি কী করছেন। যতক্ষণ এই অনুভূতি ভেতরে থাকবে, যত বাধাই আসুক, যত সংকটের ভেতর দিয়েই আপনাকে যেতে হোক, মনছবির পথে অবিচল থাকতে এবং শেষ পর্যন্ত আপনি লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবেনই।