ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৫ ১৪৩০

রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞান চেতনা, ধ্যান ও স্রষ্টাবন্দনা

ড. এম শমসের আলী

প্রকাশিত : ০৩:৩০ পিএম, ১৮ মার্চ ২০২১ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ০৩:৪৭ পিএম, ১৮ মার্চ ২০২১ বৃহস্পতিবার

আমি মূলত তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র। পৃথিবীর যেখানে যা-কিছু ঘটে, হোক বিজ্ঞানের জগতে বা সাহিত্যের জগতে, সেটা আমি বিজ্ঞানের আলোকে অনুধাবনের চেষ্টা করি। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্ম নিয়ে আমরা কিছুটা বিশ্লেষণ করতে পারি।

রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আমরা যখন কোনো অনুষ্ঠান করি, তাতে তার গান, নাচ, আবৃত্তি এবং তার জীবন ও কর্ম নিয়ে নানামুখী আলোচনা থাকে। কবিগুরুর সাহিত্য-সঙ্গীতের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয় এবং যথার্থই বলা হয় যে, তিনি একজন গীতি কবি, মরমী কবি, প্রকৃতি প্রেমিক কবি, আধ্যাত্মিক কবি এবং সার্বজনীন কবি। কিন্তু অনুষ্ঠানে যা বলা হয় না, তা হলো তার বিজ্ঞান-মানসের কথা, তার বিশ্বচিন্তার কথা।

রবীন্দ্রনাথ তার জীবনব্যাপী নানা দেশ ঘুরেছেন। সে-সব দেশে মানুষের জীবনযাত্রার মান ও বহুমাত্রিক আয়োজন দেখেছেন। তাদের উন্নয়নে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি যে একটি বড় হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে, সেটা তিনি গভীরভাবে উপলদ্ধি করেছেন এবং এ-সম্পর্কে লিখেছেনও। বিজ্ঞানের শক্তি করায়ত্ত করতে পারলে চীন যে একদিন পৃথিবীর একটি বড় শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে এ ভবিষ্যদ্বাণীও তিনি করে গেছেন। ইতোমধ্যে তার একথা ফলেও গেছে। 

জগৎ-পরিভ্রমণ করা এই মানুষটির যে একটি বিশ্বদর্শন ছিল, আমরা যাকে ইংরেজিতে বলি ‘ওয়ার্ল্ড ভিউ’, তা বলাই বাহুল্য। তার এ বিশ্বদর্শন বুঝতে হলে প্রকৃতই তার বিজ্ঞান-মানসকে আমাদের বুঝতে হবে। কিন্তু শুরুতেই বলেছি, আমরা সেটা বলি না বা বলতে চাই না। কেন? এর প্রধান কারণটি হলো, আমাদের কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে যারা রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য ও সঙ্গীত নিয়ে কাজ করেন, রবীন্দ্রনাথ চর্চা করেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা বিজ্ঞান থেকে অনেক দূরে। আবার যারা বিজ্ঞান চর্চা করেন, তারা সাধারণত সাহিত্যের দিকে খুব একটা আগ্রহী হন না। 

মজার কথা হলো, সাহিত্য যদি সত্যিই মানুষের জীবন, সংস্কৃতি ও পরিবেশের এক শৈল্পিক প্রতিচ্ছবি হয় এবং বিজ্ঞান যদি হয় সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, তবে বিজ্ঞান ও সাহিত্যের মধ্যে অবশ্যই একটা যোগসূত্র থাকা দরকার। চিরন্তন এ কথাটাই আমরা অর্থাৎ সাহিত্যিকগণ ও বিজ্ঞানীরা অনেক সময় বুঝে উঠতে পারি না। বিপত্তিটা ঘটে সেখানেই।

রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞান চেতনা
রবীন্দ্রনাথের কাব্যে ও সাহিত্যে নানাভাবে মূর্ত হয়ে উঠেছে আধুনিক বিজ্ঞানের অনেক সূত্র ও তত্ত্ব। অথচ এ কথাগুলো যে বিজ্ঞানের, সেটা কোথাও ‘নোটিশ জারি’ করে বলা হয় নি কিংবা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয় নি। আর সেখানেই রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞান-মানসের অভিনবত্ব এবং ওটাই তার সাহিত্যিক-মুনশিয়ানা। 

রবীন্দ্রসঙ্গীতের কথাই ধরা যাক। রবীন্দ্রনাথের বহু গানে প্রকৃতি ও পরিবেশ-বিজ্ঞানের বিভিন্ন সূত্র-তত্ত্ব নানাভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। গায়ক-গায়িকারা এটা ভেতরে অনুধাবন করতে পারলে তাদের কণ্ঠে গানের আসল ভাবটা দারুণভাবে ফুটে উঠতে পারে। গীতের ভাব ছাড়া গীতের কথার কী মূল্য? রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি গানের কিছু চরণ উদ্ধৃত করে ব্যাপারটা বোঝানোর চেষ্টা করা যেতে পারে। আপনারা সবাই জানেন ওরে গৃহবাসী খোল্, দ্বার খোল্ গানটার কথা। সে গানের এক জায়গায় বলা হচ্ছে

মউমাছি ফিরে যাচি ফুলের দখিনা, 
পাখায় বাজায় তার ভিখারির বীণা, 
মাধবীবিতানে বায়ু গন্ধে বিভোল। 
দ্বার খোল্, দ্বার খোল্॥

মৌমাছি ও ফুল, এদের দুজনেরই দুজনকে দরকার। মৌমাছির দরকার ফুলকে, নইলে সে মধু সংগ্রহ করবে কী করে? ওদিকে ফুলের দরকার মৌমাছিকে। মৌমাছি ফুলের গায়ে এসে না বসলে তার পরাগায়ন হবে কী করে? কীভাবে হবে তার বংশবৃদ্ধি? কিন্তু মৌমাছি যদি ফুলকে গিয়ে শুধু একথা বলে যে, ‘ফুল তুমি একটু উন্মোচিত হও, আমি তোমার কাছ থেকে মধু সংগ্রহ করব’ফুল মৌমাছির এ আহ্বানে সাড়া না-ও দিতে পারে। তাই ফুলের চারপাশে উড়ে উড়ে সে মিনতি করতে থাকে এবং নিজের পাখার সাহায্যে বীণা বাজিয়ে চলে এতে যদি ফুলের মন গলে!

ফুল সৌন্দর্যের প্রতীক। মৌমাছির মধু ভিক্ষার এই শিল্পসৌকর্যময় কাতরতা দেখে সে মুগ্ধ হয়। নিজেকে মেলে ধরে মৌমাছির কাছে। এভাবে দুজনই দুজনের প্রয়োজন মেটায়। প্রকৃতিতে এই যে দেয়া-নেয়ার সম্পর্ক, এক ধরনের মিথষ্ক্রিয়া, বিজ্ঞানের ভাষায় একেই বলা হয়ে থাকে সিম্বায়োটিক রিলেশনশিপ (Symbiotic Relationship)। প্রকৃতির এই খেলাটিকে রবীন্দ্রনাথ তার গানে কী অনুপম ভাষাতেই না ফুটিয়ে তুলেছেন! গায়ক-গায়িকারা এটি বুঝতে পারলে গানটি গাইতে গিয়ে তাদের ভালো লাগার পরিমাণ যে বাড়বে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

এভাবেই এক গীতের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ প্রচ্ছন্নভাবে গেয়েছেন অন্য গীত। যেমন, আলো আর উদ্ভিদের পারস্পরিক সম্পর্ক। এ প্রসঙ্গে এখানে রবীন্দ্রনাথের একটি গানের কথা উল্লেখ করতে হয়

ওগো নদী, আপন বেগে পাগল-পারা,
আমি স্তব্ধ চাঁপার তরু গন্ধভরে আত্মহারা॥
আমি সদা অচল থাকি, গভীর চলা গোপন রাখি,
আমার চলা নবীন পাতায়, আমার চলা ফুলের ধারা॥
ওগো নদী, চলার বেগে পাগল-পারা,
পথে পথে বাহির হয়ে আপন-হারা
আমার চলা যায় না বলা আলোর পানে প্রাণের চলা
আকাশ বোঝে আনন্দ তার, বোঝে নিশার নীরব তারা॥

এ গানটি অনেকেই পরিবেশন করে থাকেন নদীর গান হিসেবে। এটা যতটা না নদীর গান, তার চাইতে বেশি চাঁপাতরুর গান। চাঁপাতরু নদীকে দেখে সে পাগল-পারা গতিতে বয়ে চলেছে। এদিকে চাঁপাতরুর চলার কথা কেউ ভাবে না। তাকে দেখে অচল মনে হয় বটে কিন্তু তার সত্তার মধ্যেও একটা গতি আছে, যার ফলে তার অঙ্গে নবীন পাতা আসে, ফুল ফোটে। আর তরু নিজে তার এই চলার কথাটা গোপন রাখে। 

কিন্তু কী সেই গোপন কথা? সেটাই হচ্ছে আসলে বিজ্ঞানের কথা। ফটোসিনথেসিস বা সালোক-সংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় কী ঘটে, তা বুঝলেই বিষয়টা খুব সহজ। মাটি থেকে পানি ও বাতাস থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড সংগ্রহ করে এবং নিজের পাতার সবুজ অংশস্থিত ক্লোরোফিল ও সূর্যালোক ব্যবহার করে বৃক্ষ তার খাবার তৈরি করে যার কিছুটা লাগে তার নিজের বৃদ্ধিতে আর বাকিটা লাগে অন্যের কাজে ফুল ফল কাঠ ও তন্তু হিসেবে।

অর্থাৎ আদতে বৃক্ষ দেখতে অচল মনে হলেও তার ভেতরে রয়েছে একটি নীরব চলমান প্রক্রিয়া। সে নিয়ত কর্মপ্রাণ। তার এই পুরো প্রক্রিয়াটি আলোর ওপর নির্ভরশীল। তার যাত্রা আলোর দিকে। তাই তো চাঁপাতরু বলছে, আমার চলা যায় না বলা আলোর পানে প্রাণের চলা

রবীন্দ্রনাথের আরেকটি গান জোনাকি নিয়ে। দেখি সে গানে তিনি কী বলছেন :

ও জোনাকী, কী সুখে ওই ডানা দুটি মেলেছ।
আঁধার সাঁঝে বনের মাঝে উল্লাসে প্রাণ ঢেলেছ॥ 
তুমি নও তো সূর্য, নও তো চন্দ্র, তোমার তাই ব’লে কি কম আনন্দ। 
তুমি আপন জীবন পূর্ণ ক’রে আপন আলো জ্বেলেছ॥ 
তোমার যা আছে তা তোমার আছে, তুমি নও গো ঋণী কারো কাছে, 
তোমার অন্তরে যে শক্তি আছে তারি আদেশ পেলেছ। 
তুমি আঁধার-বাধন ছাড়িয়ে ওঠ, তুমি ছোটো হয়ে নও গো ছোটো, 
জগতে যেথায় যত আলো সবায় আপন ক’রে ফেলেছ॥

রবীন্দ্রনাথ যে তীক্ষè ও বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিতে জোনাকিকে পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং তার গানে এটি তুলে ধরেছেন তা সত্যিই অভূতপূর্ব। জোনাকি যে প্রক্রিয়ায় নিজের দেহের রাসায়নিক শক্তিকে (chemical energy) তড়িৎ-চুম্বকীয় শক্তিতে রূপান্তরিত করে, বিজ্ঞানের ভাষায় তাকে বলা হয় chemiluminescence। আলো একটি তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ। পুরো তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গের যে বর্ণালি (electromagnetic spectrum) তাতে বেতার তরঙ (radio wave) থেকে শুরু করে গামা রে (gamma-radiation) পর্যন্ত সবই অন্তর্ভুক্ত। এই বর্ণালির একটি নির্দিষ্ট কম্পনাঙ্কের তরঙ্গ (frequency) আমাদের চোখে দর্শনের অনুভূতি জাগায়। আর সে হিসেবে সূর্যের আলো, মোমবাতির আলো, হারিকেনের আলো, ইলেকট্রিক টিউব বা ল্যাম্পের আলো এবং জোনাকির আলো সব একই ধরনের। কারণ সূত্রের দিক থেকে আলাদা হলেও এগুলো সবই দেখতে সাহায্য করে। 

এখানে বলা যেতে পারে, কোনো পদার্থের একটি অণু বা এটমের মধ্যে থাকে নিউক্লিয়াস, যার মধ্যে আছে প্রোটন ও নিউট্রন। সূর্য একটি নক্ষত্র, সেখানে প্রচণ্ড চাপে ও তাপে অবিরাম চলছে নিউট্রন প্রোটনের বিক্রিয়া। যার ফলে রচিত হচ্ছে ডিউটেরন নামক পরমাণুর কেন্দ্র (Nucleus) এতেও রয়েছে সেই একই প্রোটন ও নিউট্রন। ভারী পরমাণুকেন্দ্র নির্মাণে পর্যায়ক্রমে এই প্রক্রিয়া চলতে থাকে। এই প্রক্রিয়ায় কিছুটা ভর রূপান্তরিত হয় শক্তিতে, যা আমরা পাই সৌরশক্তি হিসেবে। 

আলো প্রধানত সূর্য থেকে আসে বলে সূর্যকেই গণ্য করা হয় আলোকের মূল উৎস হিসেবে। আর সূর্য থেকে আমরা যে প্রক্রিয়ার আলো পাই, তার মূল সূত্রধর কিন্তু অতি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পরমাণু জোনাকির চাইতেও যা বহুগুণ ছোট, প্রায় ১০ লক্ষ কোটি গুণ। এ কারণেই কবি জোনাকিকে বলেছেন নিজেকে ছোট না ভাবতে। তাই যথার্থই বলা যায়, কী অসাধারণ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতেই না কবি দেখেছেন জোনাকিকে!

রবীন্দ্রনাথ বোধ করি তার আধ্যাত্মিক উৎকর্ষতার শক্তিতেই কাশ্ফের জগৎ থেকে এসব সত্য উপলব্ধি করেছিলেন। আজ আমরা লেজার রশ্মির কথা জানি— আলো নাচে, আলো বাজে, আলো কাটে। আলো একটি সুইচের কাজ করে। কিন্তু এসব তো হালের কথা। রবীন্দ্রনাথ যেন ধ্যানলব্ধ জ্ঞানে গেয়ে উঠেছিলেন—

আলো আমার, আলো ওগো, আলো ভুবন-ভরা।
আলো নয়ন-ধোওয়া আমার, আলো হৃদয়-হরা॥
নাচে আলো নাচে, ও ভাই, আমার প্রাণের কাছে
বাজে আলো বাজে ও ভাই, হৃদয় বীণার মাঝে
জাগে আকাশ, ছোটে বাতাস, হাসে সকল-ধরা॥

আলোর স্রোতে পাল তুলেছে হাজার প্রজাপতি।
আলোর ঢেউয়ে উঠল নেচে মল্লিকা মালতী।
মেঘে মেঘে সোনা, ও ভাই, যায় না মানিক গোনা
পাতায় পাতায় হাসি, ও ভাই, পুলক রাশি রাশি
সুরনদীর কূল ডুবেছে সুধা-নিঝর-ঝরা॥

এই আলো হচ্ছে ‘লাইফ অব দি ইউনিভার্স’। আলোর কম্পন, আলোর দ্যুতি, আলোর স্পন্দন সমস্ত জীবকূল কিন্তু বেঁচে আছে এই আলো নিয়ে। সেজন্যেই বুঝি রবীন্দ্রনাথের মধ্যে এই আলোর প্রতি এক অপার্থিব আকুতি লক্ষ করা যায় তার আরেকটি গানে, সেখানে স্রষ্টার প্রতি তার প্রার্থনা— আরো আলো, আরো আলো/ এই নয়নে, প্রভু, ঢালো । বিজ্ঞানের সংশ্লেষ নেই যদিও, তবু প্রসঙ্গক্রমে বলি, এই গানেরই এক পর্যায়ে তিনি বলছেন— আরো বেদনা, আরো বেদনা/ প্রভু, দাও মোরে আরো চেতনা । অর্থাৎ বেদনার ভারে ও চাপে তিনি নুয়ে পড়েন নি, হতোদ্যম হয়ে যেতে চান নি, বরং এই বেদনার মধ্য দিয়েই আরো গভীরতর চেতনা লাভ করার বাসনা জানিয়েছেন স্রষ্টার কাছে। 

যা-ই হোক, এরপর যে গানটির কথা বলছি, সেখানে রবীন্দ্রনাথ যেন অবতীর্ণ হয়েছেন দ্রষ্টার ভূমিকায়। যে মহাবিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়েছিল (Big Bang), তার জীবদ্দশায় এ তত্ত্ব প্রমাণিতই হয় নি। বিগ ব্যাং থিয়োরি অনুসারে, প্রায় ১৫০০ কোটি বছর আগে মহাবিশ্বের সব পদার্থ ও শক্তি ঘনীভূত ছিল একটিমাত্র বিন্দুতে, যা থেকে মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে সূচনা ঘটে এই বিপুল সৃষ্টিজগতের। মহাবিস্ফোরণের পর পরই শুরু হয় বিকিরণ। ভর ও শক্তির সমতূল্যতার সূত্র অনুসারে সেই বিকিরণ রূপান্তরিত হয় পদার্থে। বিস্ফোরণের ১০-৪৩ সেকেন্ড পর অর্থাৎ একের (১) পিঠে ৪৩টা শূন্য বসিয়ে যে সংখ্যা হয়, এক সেকেন্ডকে তা দিয়ে ভাগ করলে যে সময়টা পাওয়া যায় (যা অকল্পনীয় এবং যাকে বলা হয় Planck’s Time), তার আগের কোনো ঘটনাই বিজ্ঞানীদের পক্ষে জানা সম্ভব হয় নি। ফলে মহাবিস্ফোরণের মূল কারণ বিজ্ঞানীদের কাছে আজও রহস্যাবৃতই রয়ে গেছে। তবে যারা স্রষ্টায় বিশ্বাস করেন, তারা বলেন, এ-কাজ কেবল স্রষ্টার পক্ষেই সম্ভব। আর রবীন্দ্রনাথের একটি গানে এ বিশ্বাসেরই প্রতিফলন ঘটেছে। গানের কথাগুলো হচ্ছে :

প্রথম আদি তব শক্তি—
আদি পরমোজ্জ্বল জ্যোতি তোমারি হে 
গগনে গগনে॥ 
তোমার আদি বাণী বহিছে তব আনন্দ, 
জাগিছে নব নব রসে হৃদয়ে মনে॥
তোমার চিদাকাশে ভাতে সূরয চন্দ্র তারা,
প্রাণতরঙ্গ উঠে পবনে। 
তুমি আদিকবি, কবিগুরু তুমি হে,
মন্ত্র তোমার মন্দ্রিত সব ভুবনে॥

এ গানে কবি তার বিশ্বাসেরই স্বীকৃতি দিয়েছেন যে, সৃষ্টির প্রথম শক্তি বিধাতারই, গগনে গগনে পরমোজ্জ্বল জ্যোতি একমাত্র তাঁরই। বিশ্বসৃষ্টি এক মহাকাব্য এবং স্রষ্টাই এর রচয়িতা। তিনিই এর আদি কবি এবং মহাগুরু। কবি তার কল্পনা দিয়ে এখানে যেভাবে মহাবিশ্ব সৃষ্টির কথা বলেছেন, তা তার অনন্য সৃজনশীলতারই নিদর্শন।

এসব গানের মর্মকথা একদিন আলাপ করছিলাম আমাদের দেশের একজন বিশিষ্ট রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীর সাথে এবং একটি টিভি চ্যানেলে সেদিন তিনি এ গানগুলো গেয়েও ছিলেন। অনুষ্ঠান শেষে তিনি আমাকে বললেন, ‘আজ ৩০ বছর ধরে গানগুলো গাইছি কিন্তু এর অন্তরালে যে এমন অপূর্ব বিজ্ঞান চেতনা ছিল তা-তো কখনো ভাবি নি।’ সত্যি বলতে কী, শ্রোতা-শিল্পীদের বেশিরভাগই এটা নিয়ে ভাবেন না। ভাবলে তারা বিস্মিত হতেন। লাভ করতেন অনেক বাড়তি আনন্দও।

রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞান চেতনার একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো, জীবন ও পরিবেশ নিয়ে তার সহজাত সচেতনতাবোধ। পৃথিবীজুড়ে সর্বত্রই পরিবেশ দূষণ ও ‘হিউম্যান ইকোলজি’ অর্থাৎ মানুষের সঙ্গে পরিবেশের সম্পর্ক নিয়ে আজ পরিলক্ষিত হচ্ছে ভীষণ উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। অনুষ্ঠিত হচ্ছে সেমিনার-সিম্পোজিয়াম। নানাভাবে আলোচিত হচ্ছে, তর্কবিতর্ক হচ্ছে কলকারখানা ও যানবাহনের নির্গত ধোঁয়া থেকে মানুষকে পরিত্রাণ দেয়ার উপায় নিয়ে। আরো আলোচিত হচ্ছে আমাদের ঘরবাড়ির ধরন আর তার চারপাশে কেমন গাছপালা থাকা উচিত, গো-চারণভূমি না থাকার ফলে গবাদি পশুদের কী অসুবিধা হচ্ছে, জ্বালানির প্রয়োজনে দ্বিধাহীনভাবে বৃক্ষ নিধনের দরুন মরু-প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হচ্ছে কিনা ইত্যাদি বিষয়। 

অথচ ভাবতে অবাক লাগে, আজ থেকে প্রায় শত বৎসর আগে ঠিক এ প্রশ্নগুলোই রবীন্দ্রনাথের মনকে নাড়া দিয়েছিল গভীরভাবে। তিনি পরিবেশ-সংক্রান্ত সমস্যাগুলোকে অনেক আগেই চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন। পরিবেশ-বিজ্ঞানের পরিভাষাগুলো ব্যবহার না করেও তিনি যে এর গভীরে ঢুকতে পেরেছিলেন তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে তার কবিতায়। চৈতালি কাব্যগ্রন্থের সভ্যতার প্রতি কবিতায় পরিবেশ প্রসঙ্গে তার আবেদন ছিল—

দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর,
লও যত লৌহ লোষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তর
হে নবসভ্যতা! হে নিষ্ঠুর সর্বগ্রাসী,
দাও সেই তপোবন পুণ্যছায়ারাশি, 
গ্লানিহীন দিনগুলি, সেই সন্ধ্যাস্নান,
সেই গোচারণ, সেই শান্ত সামগান ...

তাই এটা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, আধুনিককালে হিউম্যান ইকোলজির কথা সর্বপ্রথম যারা চিন্তা করেছেন, রবীন্দ্রনাথ তাদের অন্যতম।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর বিজ্ঞানের জগতে ঘটে গেছে বেশ কিছু আলোড়ন সৃষ্টিকারী আবিষ্কার, যার প্রয়োগ ঘটেছে মহাশূন্য অভিযান ও কম্পিউটার প্রযুক্তিসহ নানা ক্ষেত্রে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, এ-যুগের কবি-সাহিত্যিকরা এসব আবিষ্কার থেকে একটু যেন নিরাপদ দূরত্বই বজায় রেখেছেন। এর একটা সম্ভাব্য কারণ হিসেবে হয়তো বলা যেতে পারে অশিক্ষা, দারিদ্র্য ও ব্যাধির কবলে জর্জরিত যে দেশের মানুষ, তাদের সাহিত্যে সর্বাধুনিক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের তাৎপর্য প্রতিফলিত হবে এটা আশা করা ঠিক নয়। এ যুক্তিতে যে জোর নেই, তা-ও নয়। তবে এ-ও সত্যি যে, বিজ্ঞানই আজ পৃথিবীজুড়ে দারিদ্র্যমোচনের পথ প্রশস্ত করেছে। 

বিজ্ঞানের অগ্রগতি ও মানবগোষ্ঠীর নবতর বিকাশের প্রতি রবীন্দ্রনাথের ছিল তীক্ষ দৃষ্টি। জীবদ্দশায় তিনি পারমাণবিক আগ্রাসনের কথা জানেন নি। মাইক্রো-ইলেকট্রনিকস কিংবা কম্পিউটার প্রযুক্তির প্রবর্তন দেখে যান নি। শিল্পবিপ্লবের সময় বিজ্ঞানের যে সূত্রগুলো ব্যবহার করা হয়েছিল, সেগুলোই প্রগতি ও সমৃদ্ধির লক্ষ্যে পৃথিবীজুড়ে কীভাবে প্রয়োগ করা হলো, রবীন্দ্রনাথ তা প্রত্যক্ষ করে গেছেন। তিনি দেশে দেশে ঘুরেছেন। এ সময় তিনি যেমন দেশ-কাল-ধর্ম ছাপিয়ে সর্বজাতির মানুষের মধ্যে এক সদাজাগ্রত সত্তার সন্ধান পেয়েছেন, তেমনি এসব মানুষের হাত-পাগুলোকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কীভাবে চালাচ্ছে বা চালাতে পারে, তা-ও তার দৃষ্টি এড়ায় নি।

তিনি একবার জাপান যাচ্ছিলেন। আজকের চীন তখনো গড়ে ওঠে নি। যাত্রাপথে হংকং বন্দরে চীনা মজুরদের ‘কাজের শক্তি, কাজের নৈপুণ্য এবং কাজের আনন্দকে পুঞ্জিভূতভাবে একত্র দেখতে পেয়ে’ রবীন্দ্রনাথ বিস্মিত হন। তিনি লিখেছিলেন, ‘এই এতোবড় একটা শক্তি যখন আপনার আধুনিক কালের বাহনকে পাবে, অর্থাৎ যখন বিজ্ঞান তার আয়ত্ত হবে, তখন পৃথিবীতে তাকে বাধা দিতে পারে এমন কোন্ শক্তি আছে? তখন তার কর্মের প্রতিভার সাথে তার উপকরণের যোগসাধন হবে। এখন যে-সব জাতি পৃথিবীর সম্পদ ভোগ করছে তারা চীনের সেই অভ্যুত্থানকে ভয় করে, সেই দিনকে তারা ঠেকিয়ে রাখতে চায়’। 

এই ভবিষ্যদ্বাণী তো আজ এক দৃশ্যমান বাস্তবতা। চীনের অভ্যুদয় ঠিকই ঘটল। কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারল না। এখানে যেটি লক্ষণীয় তা হলো, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রতি একটি গভীর আস্থাবোধ থেকেই রবীন্দ্রনাথ এমন আশা সেদিন ব্যক্ত করতে পেরেছিলেন।

জাপানে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়। আজ আমরা জাপানকে বলে থাকি ‘ওয়ার্কশপ অব দি ইস্ট’ বা প্রাচ্যের কর্মশালা। ৮০ বছরেরও বেশি সময় আগে যখন রবীন্দ্রনাথের পা পড়ে জাপানের মাটিতে, তখনো এই কর্মশালা আজকের মতো অত্যাধুনিক হয় নি। তবু তখনই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন তাদের কর্মপ্রাণ উদ্যম। কবির ভাষাতেই বলতে হয়‘এশিয়ার মধ্যে জাপানই এই কথাটি একদিন হঠাৎ অনুভব করলে যে, য়ুরোপ যে-শক্তিতে পৃথিবীতে সর্বজয়ী হয়ে উঠেছে একমাত্র সেই শক্তির দ্বারাই তাকে ঠেকানো যায়। নইলে তার চাকার নীচে পড়তেই হবে এবং একবার পড়লে কোনোকালে আর ওঠবার উপায় থাকবে না।

এই কথাটি যেমনি তার মাথায় ঢুকল অমনি সে আর এক মুহূর্ত দেরি করলে না। কয়েক বৎসরের মধ্যেই য়ুরোপের শক্তিকে আত্মসাৎ করে নিলে। য়ুরোপের কামান বন্দুক, কুচ-কাওয়াজ, কল-কারখানা, আপিস-আদালত, আইন-কানুন যেন কোন্ আলাদিনের প্রদীপের জাদুতে পশ্চিমলোক থেকে পূর্বলোকে একেবারে আস্ত উপড়ে এনে বসিয়ে দিলে। নতুন শিক্ষাকে ক্রমে ক্রমে সইয়ে নেওয়া, বাড়িয়ে তোলা নয়; তাকে ছেলের মতো শৈশব থেকে যৌবনে মানুষ করে তোলা নয় তাকে জামাইয়ের মতো একেবারে পূর্ণ যৌবনে ঘরের মধ্যে বরণ করে নেওয়া। বৃদ্ধ বনস্পতিকে এক জায়গা থেকে তুলে আর-এক জায়গায় রোপণ করবার বিদ্যা জাপানের মালীরা জানে; য়ুরোপের শিক্ষাকেও তারা তেমন করেই তার সমস্ত জটিল শিকড় এবং বিপুল ডালপালা সমেত নিজের দেশের মাটিতে এক রাত্রির মধ্যে খাড়া করে দিলে। শুধু যে তার পাতা ঝরে পড়ল না তা নয়, পরদিন থেকেই তার ফল ধরতে লাগল। প্রথম কিছুদিন ওরা য়ুরোপ থেকে শিক্ষকের দল ভাড়া করে এনেছিল। অতি অল্পকালের মধ্যেই তাদের প্রায় সমস্ত সরিয়ে দিয়ে, হালে এবং দাঁড়ে নিজেরাই বসে গেছে কেবল পালটা এমন আড় ক’রে ধরেছে যাতে পশ্চিমের হাওয়াটা তার উপরে পুরো এসে লাগে।’

দেশগড়ার কাজে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কীভাবে কাজে লাগানো যেতে পারে, সে-বিষয়ে জাপান যে নীতি ও দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছিল তার এমন সঠিক উপলদ্ধি ও চিত্রাঙ্কণ পৃথিবীতে নজিরবিহীন। তৃতীয় বিশ্বের বহু লোক আজ জাপান ভ্রমণ করছেন, জাহাজ নির্মাণসহ ইলেক্ট্র্রনিক্স শিল্পে তাদের দক্ষতা দেখে স্তম্ভিত হচ্ছেন, কিছু শৌখিন যন্ত্রপাতি সঙ্গে করে নিয়েও আসছেন, কিন্তু অ্যাডাপ্টিভ টেকনোলজি বা খাপ-খাওয়ানো প্রযুক্তি যে কীভাবে দেশগড়ার মন্ত্র হিসেবে কাজ করছে, সে-সম্পর্কে তাদের অনেকেরই ধারণা ততটা স্পষ্ট নয়। তাই শুধু ভ্রমণ নয়, মনের জানালা-দরজাগুলো খুলে দিয়ে বিজ্ঞানের আলো-বাতাসকে ঢুকতে দেয়ার যে মানসিকতা, তা থাকা চাই। আর এখানেই রবীন্দ্রনাথের সাথে সমসাময়িক অন্য মনীষীদের পার্থক্য।

শুধু জাপান নয়, রাশিয়াতে গিয়েও তিনি বিজ্ঞানের আয়োজনটা বুঝতে চেষ্টা করেছেন। তিনি লক্ষ করেছেন, ‘শুধু শ্বেত-রাশিয়ার জন্যে নয় মধ্য-এশিয়ার অর্ধসভ্য জাতের মধ্যেও এরা বন্যার মতো বেগে শিক্ষা বিস্তার করে চলেছে; সায়েন্সের শেষ-ফসল পর্যন্ত যাতে তারা পায় এইজন্যে প্রয়াসের অন্ত নেই।’ 

রবীন্দ্রনাথ যে ‘শেষ-ফসল’-এর কথা বলেছেন তা এখনো বোনা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও অন্যান্য শিল্পোন্নত দেশগুলোতে, তবে এক চরম উত্তেজনা আর প্রতিযোগিতার সাথে।

ইউরোপে গিয়ে সেই মহাদেশটা কীভাবে বিজ্ঞানের স্পর্শ দ্বারা সর্বদেশ ও সর্বকালকে স্পর্শ করেছে তা উপলদ্ধি করে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ‘বিজ্ঞান যে বিশুদ্ধ তপস্যার প্রবর্তন করেছে সে সকল দেশের, সকল কালের, সকল মানুষের...’। সার্বজনীন কবি রবীন্দ্রনাথ বিজ্ঞানের সার্বজনীনতাকে তুলে ধরার যে প্রয়াস পেয়েছেন তা সত্যিই প্রশংসনীয়। তবে কবি যদিও বলেছেন‘মানুষের অমরাবতী নির্মাণের বিশ্বকর্মা এই বিজ্ঞান’, তবু তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এই ভেবে যে, ‘এই বিজ্ঞানই কর্মের রূপে যেখানে মানুষের ফল-কামনাকে অতিকায় করে তুললে সেইখানেই সে হল যমের বাহন।’ তার মতে, ‘এই পৃথিবীতে মানুষ যদি একেবারে মরে তবে সে এই জন্যেই মরবে সে সত্যকে জেনেছিল কিন্তু সত্যের ব্যবহার জানেনি। সে দেবতার শক্তি পেয়েছিল দেবত্ব পায়নি’। শান্তির লক্ষ্যে বিজ্ঞানকে ব্যবহার করার যে উদাত্ত আহ্বান তিনি সেদিন জানিয়েছিলেন, তা আজও বিজ্ঞানী-অবিজ্ঞানী সবার কাছে উৎসাহ আর উদ্দীপনার সঞ্চার করবে, সন্দেহ নেই।

ইউরোপের ঔপনিবেশিক ও বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি কবিকে ব্যথিত করেছিল। তিনি প্রকৃতই উপলব্ধি করেছিলেন ইউরোপ আপন বিজ্ঞান নিয়ে আমাদের মধ্যে আসে নি, এসেছে আপন কামনা নিয়ে। তবে এজন্যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে রবীন্দ্রনাথ কখনো দায়ী করেন নি। এ ব্যাপারে তার বিশ্লেষণ অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত। তার মতে, ‘যন্ত্রকে থামিয়ে দিয়ে কোনো লাভ হবে না, থামাতে হবে লোভ। আর শুধু ধর্ম উপদেশ দিলে চলবে না, তার সঙ্গে চাই বিজ্ঞানের যোগ। যে সাধনায় লোভকে ভিতরের দিক দিয়ে দমন করে সে সাধনা ধর্মের কিন্তু যে সাধনায় লোভের কারণকে বাইরের দিক থেকে দূর করে সে সাধনা বিজ্ঞানের। দুইয়ের সম্মিলনে সাধনা সিদ্ধ হয়, বিজ্ঞানবুদ্ধির সঙ্গে ধর্মবুদ্ধি আজ মিলনের অপেক্ষায় আছে।’

রবীন্দ্রনাথ যে মিলনের বাণী শুনিয়েছিলেন, তা আজও মানুষকে আশা দেয়। এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকায় বসবাসকারী পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার এক বিরাট অংশ আজও পাশ্চাত্যের এই শুভবুদ্ধির অপেক্ষায় আছে। কবে তার উদয় হবে কে জানে।

শুধু বিজ্ঞান নয়, বিজ্ঞানীর প্রতিও ছিল রবীন্দ্রনাথের যে দৃষ্টি তা ছিল কখনো স্নেহ কখনো ভক্তি আর কখনো শ্রদ্ধায় ভরা। এর দৃষ্টান্ত যে শুধু তার ব্যক্তিগত জীবনেই দেখা যেত, তা নয়। তার সাহিত্যে বিভিন্ন চরিত্রের মধ্যেও এর প্রতিফলন ঘটতে দেখা যায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, তার ল্যাবরেটরি নামক ছোটগল্পে দেখা যায়, সোহিনী মল্লিক নাম্নী প্রৌঢ়া ভদ্রমহিলা প্রণাম করছেন সদ্য ডক্টরেট অব সায়েন্স ডিগ্রিধারী যুবক রেবতী ভট্টচার্যের পায়ে মাথা রেখে। যুবকের পা ছোঁয়ার ছল হিসেবে তিনি বলছেন, ‘কিছু মনে কোরো না বাবা, তুমি ব্রাহ্মণের ছেলে আমি ছত্রির মেয়ে... তোমার মতো ব্রাহ্মণ তো খুঁজে পাব না’। রেবতী অবাক হয়ে বলেন, ‘আমার মতো ব্রাহ্মণ!’। জবাবে সোহিনী বলেছিল‘আমার গুরু বলেছেন, এখনকার কালে সবসেরা যে বিদ্যা তাতেই যাঁর দখল তিনিই সেরা ব্রাহ্মণ’।

এখানে অবশ্য সেরা ব্রাহ্মণ বলতে সেরা বিজ্ঞানীকেই বোঝানো হয়েছে। রেবতীর হাতেই সোহিনী তার স্বামীর ল্যাবরেটরি তুলে দিতে চেয়েছিলেন। গল্পে বোঝা যায়, সোহিনী কিছুটা ছলনাময়ী কিন্তু এই নারীর মুখেও রবীন্দ্রনাথ বিজ্ঞানীকে ব্রাহ্মণ হিসেবে চিহ্নিত করে হিন্দু মতাদর্শ অনুযায়ী তাকে সর্বোচ্চ সম্মানে ভূষিত করেছেন। বিজ্ঞানীদের প্রতি এর চেয়ে বড় শ্রদ্ধা প্রদর্শন আর কী হতে পারে!

রবীন্দ্রনাথ শুধু যে বিজ্ঞানের গতি, প্রকৃতি এবং এর অন্তর্নিহিত শক্তি সম্বন্ধেই চিন্তাভাবনা করতেন তা নয়। তিনি বিজ্ঞান জগতের নানা খবর নিজে জানার চেষ্টা করেছেন, আবার নিজে জেনে অন্যদের জন্যে সেটা লিখেও গেছেন। বিশ্বপরিচয় রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞানপ্রীতি ও বিজ্ঞানচর্চার একটা মহত্তম স্বাক্ষর। পরমাণুলোক থেকে শুরু করে নক্ষত্রলোক সৌরজগৎ গ্রহলোক ভূলোক প্রতিটি জগতের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও বিশ্লেষণ তুলে ধরেছেন এ বইটিতে। বহুদিন আগে লেখা বলে কিছু কিছু তথ্যকে সময়ের আলোকে একটু ঝালিয়ে নিতে হতে পারে মাত্র। কিন্তু লেখার মূল সুর অর্থাৎ বিশ্বের বিভিন্ন লোকে পদার্থের সংগঠনের যে হরেক রীতিনীতি, তা-তো অপরিবর্তিতই থাকবে। 

বিশ্বপরিচয়-এ রবীন্দ্রনাথ বিশেষ নজর দিয়েছেন ভাষার প্রতি। সাবলীল ভাষায় বিজ্ঞানের দুরূহ তত্ত্বগুলোকে বোধগম্য করার কী সহজসাধ্য একটা প্রয়াসই-না এ বইটি! বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে পরিভাষার প্রয়োজন অনস্বীকার্য। তবে রবীন্দ্রনাথের নিজের ভাষায়‘বিজ্ঞানের সম্পূর্ণ শিক্ষার জন্যে পারিভাষিকের প্রয়োজন আছে। কিন্তু পারিভাষিক চর্ব্যজাতের জিনিস। দাঁত-ওঠার পরে সেটা পথ্য।’ সে-কথা মনে রেখে রবীন্দ্রনাথ যতদূর সম্ভব পরিভাষা এড়িয়ে ভাষার সহজতার দিকেই মন দিয়েছেন। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের বিশ্বপরিচয় সত্যিই একটি অনন্য দৃষ্টান্ত।

রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞান-মানসের কথা বলতেই সবার মনে বিশ্বপরিচয়-এর কথাই আগে জাগতে পারে। এই বইটিতে বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে তার জ্ঞান ও চিন্তার বিমূর্ত প্রকাশ ঘটেছে। তবে এটি তার বিজ্ঞান-মানসের সামান্য অংশের ওপরই আলোকপাত করে মাত্র। বড় অংশটাই প্রচ্ছন্নভাবে লুকিয়ে আছে তার কবিতা গান গল্প নাটক আর উপন্যাসে। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এসব নানা উপকরণ কুড়িয়ে এনে তা দিয়ে রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞান-মানসকে সঠিক ছাঁচে ফেলা খুবই কঠিন কাজ, সন্দেহ নেই। তবে এতে রয়েছে অনাবিল আনন্দের অবকাশ।

রবীন্দ্রনাথের পারিবারিক জীবনেও বিজ্ঞানকে পছন্দের একটি ক্ষেত্র হিসেবেই গণ্য করার প্রয়াস লক্ষ করা যায়। বড় ছেলে রথীন্দ্রনাথকে তিনি কাব্যচর্চা নয়, বরং উৎসাহিত করেছিলেন কৃষিচর্চাতেই এবং উন্নত কৃষিবিদ্যা শিখে আসার জন্যে তাকে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠিয়েছিলেন। এ-ছাড়া শান্তিনিকেতনে যে-সব প্রকল্পের মাধ্যমে তিনি পল্লীমঙ্গলের কথা ভাবতেন তা দেশজ প্রযুক্তির প্রতি তার গভীর আস্থাই ব্যক্ত করে।

রবীন্দ্রনাথের ধ্যান ও স্র্রষ্টাবন্দনা

যে ধ্যানে রবীন্দ্রনাথ জীবনব্যাপী মগ্ন ছিলেন, প্রকৃতি ও স্রষ্টাপ্রেমই তার মূল উপজীব্য। প্রকৃতিপ্রেমের দৃষ্টান্ত তো আমরা ইতোমধ্যেই পেয়েছি, আর স্র্রষ্টাপ্রেমের পরিচয় মেলে তার কবিতায় ও গানে। গীতাঞ্জলি স্রষ্টাবন্দনার এক অসাধারণ রূপ। এ অনবদ্য সাহিত্যকর্মের জন্যেই তিনি নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। 

আমরা প্রথম দেখব প্রকৃতিকে ঘিরে রবীন্দ্রনাথের ধ্যানমগ্নতার বিষয়টি। উদ্ভিদ নিয়ে যে গীত তিনি রচনা করেছেন তার জুড়ি নেই। এক জায়গায় তিনি বলছেন, ‘ঐ গাছগুলো বিশ্ববাউলের একতারা, ওদের মজ্জায় মজ্জায় সরল সুরের কাঁপন, ওদের ডালে ডালে পাতায় পাতায় একতালা ছন্দের নাচন। যদি নিস্তব্ধ হয়ে প্রাণ দিয়ে শুনি তা হলে অন্তরের মধ্যে মুক্তির বাণী এসে লাগে।’

এ যে শুধু ভাবের কথা তা নয়। এর মধ্যেই ধরা পড়েছে বৃক্ষের নীরব লীলা বোঝার প্রয়াস, যা আরো মূর্ত হয়ে ওঠে তার বনবাণী কাব্যগ্রন্থের বৃক্ষবন্দনা কবিতায়—

অন্ধ ভূমিগর্ভ হতে শুনেছিলে সূর্যের আহ্বান
প্রাণের প্রথম জাগরণে, তুমি বৃক্ষ, আদিপ্রাণ
ঊর্ধ্বশীর্ষে উচ্চারিলে আলোকের প্রথম বন্দনা
ছন্দোহীন পাষাণের বক্ষ-’পরে; আনিলে বেদনা
নিঃসাড় নিষ্ঠুর মরুস্থলে।

আলো সাত রংয়ের বর্ণালি। এর প্রতিটি রংয়ের তরঙ্গদৈর্ঘ্য আলাদা। বৃক্ষের ওপর যখন সৌরশক্তি এসে পড়ে তখন সালোক-সংশ্লেষণের জন্যে সে আলোর সবগুলো তরঙ্গ ব্যবহার করে না, কিছু বাদ দিয়ে করে। অর্থাৎ আলোর মধ্যে কী লুকিয়ে আছে বৃক্ষ তার খবর রাখে। এর কতটুকু তাকে নিতে হবে, তা-ও সে জানে, যদিও বৃক্ষের এই আলোকতরঙ্গ বাছাইয়ের খবর বিজ্ঞানীকে বুঝতে হয়েছে বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে। কিন্তু গাছকে উদ্দেশ্য করে রবীন্দ্রনাথ যখন বলেন :

...সুন্দরের প্রাণমূর্তিখানি
মৃত্তিকার মর্তপটে দিলে তুমি প্রথম বাখানি
টানিয়া আপন প্রাণে রূপশক্তি সূর্যালোক হতে,
আলোকের গুপ্তধন বর্ণে বর্ণে বর্ণিলে আলোতে।

রবীন্দ্রনাথ বৃক্ষের এই গোপন কথা জেনেছিলেন বোধ করি তার গভীর ‘ধ্যানবল’-এর মাধ্যমে। একই কবিতায় তাই তিনি বলছেন :

...ধ্যানবলে তোমার মাঝার
গেছি আমি, জেনেছি, সূর্যের বক্ষে জ্বলে বহ্নিরূপে
সৃষ্টি যজ্ঞে যেই হোম, তোমার সত্তায় চুপে চুপে
ধরে তাই শ্যামস্নিগ্ধরূপ, ওগো সূর্যরশ্মিপায়ী,
শত শত শতাব্দীর দিনধেনু দুহিয়া সদাই
যে তেজে ভরিলে মজ্জা, মানবেরে তাই করি দান
করেছ জগৎজয়ী; দিলে তারে পরম সম্মান;

এই চরণ ক’টিতে কবি গীতিময় ভাষায় প্রকাশ করেছেন বৃক্ষ কী করে সূর্যশক্তিকে আটকে রেখেছে তার দেহের স্তরে স্তরে। প্রায় শতাব্দীকাল আগে রবীন্দ্রনাথ সূর্যরশ্মিপায়ী বৃক্ষমজ্জাতে যে তেজের কথা লিখেছিলেন, আজকের জ্বালানি-সংকট কবলিত বিশ্ব কিন্তু নতুন করে সেই তেজের কথাই বলতে শুরু করেছে!

বৃক্ষের রহস্য উদ্ঘাটন করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ যে ‘ধ্যানবল’-এর কথা লিখেছেন, সুফিদের ভাষায় তাকেই বলা যেতে পারে ‘কাশ্ফ’, যার মাধ্যমে সুফি কবিরা কিছু সত্য উপলব্ধিতে পৌঁছান। বিজ্ঞানীরা একই সত্যে উপনীত হন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে। 

এখানে উল্লেখ্য, কবি শেখ সাদীও বোধ করি ‘ধ্যানবল’-এর মাধ্যমে বৃক্ষের গোপন কথা জেনেছিলেন : বার্গে দরখতখানে সব্জ/ দার নাজায়ে হোঁশিয়ার/ হার ওরাকে দাফতারিস্ত/ মারাফাতে কারদেগার ..। যার বাংলা মর্মার্থ দাঁড়ায় হুশিয়ার অর্থাৎ সচেতন ব্যক্তির দৃষ্টি যদি সবুজ বৃক্ষের ওপর পড়ে তবে সে এর প্রতিটি পাতায় দেখতে পাবে একটি দফতর, যার মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে কারিগরের গুপ্তজ্ঞান। সালোক-সংশ্লেষণ প্রক্রিয়া আসলেই পরম স্রষ্টার গুপ্তজ্ঞানের এক উদাহরণই বটে, যা আমরা বিজ্ঞানীরা আজও পুরোপুরি জেনে উঠতে পারি নি।

এবার স্র্রষ্টাকে ঘিরে রবীন্দ্রনাথের ধ্যানের কথা বলব। এ ধ্যানের কোনো তুলনা নেই। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতিকে পর্যবেক্ষণ করেছেন, বুঝতে চেষ্টা করেছেন স্রষ্টার মাহাত্ম্য। আর এ নিয়ে যা তিনি উপলব্ধি করেছেন, তা প্রকাশ করেছেন তার বহু কবিতায়, গানে। তেমনি একটি গানের কথা হলো :

সত্য মঙ্গল প্রেমময় তুমি, ধ্রুবজ্যোতি তুমি অন্ধকারে।
তুমি সদা যার হৃদে বিরাজ দুখজালা সেই পাশরে
সব দুখজ্বালা সেই পাশরে॥
তোমার জ্ঞানে তোমার ধ্যানে তব নামে কত মাধুরী
যেই ভকত সেই জানে,
তুমি জানাও যারে সেই জানে।
ওহে, তুমি জানাও যারে সেই জানে।

বিশ্বপ্রভুর ধ্যানে যে মাধুরী, তা-ই প্রকাশ পেয়েছে রবীন্দ্রনাথের অসংখ্য গানে ও গীতাঞ্জলি-তে স্রষ্টাবন্দনায়। এখানে পরম স্রষ্টাকে পাওয়ার আকুতি থেকে একদিকে তিনি নিজের ঘর আবিষ্কার করার কথা বলেছেন, অন্যদিকে তার সকল অহংকার বিনাশের কথা বলেছেন। নিজের ঘরের কথাটাই প্রথমে বলি। তিনি গাইছেন : যাব না গো যাব না যে, রইনু পড়ে ঘরের মাঝে/ এই নিরালায় রব আপন কোণে/ ..আমার এ ঘর বহু যতন ক’রে/ ধুতে হবে মুছতে হবে মোরে/ আমারে যে জাগতে হবে, কী জানি সে আসবে কবে..।

এই ঘর ধোয়া-মোছাটাই কিন্তু ধ্যানের একটি বড় কাজ। মেডিটেশনে আমাদের যে মনের বাড়িতে প্রবেশ করতে বলা হয়, সেটা আত্ম উপলব্ধির ঘর। নিজেকে চেনার, জানার ও ফিরে পাওয়ার ঘর। এমন ঘর তৈরি করে সারাজীবন কবি অপেক্ষায় ছিলেন পরমাত্মার সঙ্গে মিলনের।

সেইসাথে নিজের সকল অহংকারকে দূর করার সাধনা করেছেন তিনি প্রতিনিয়ত। স্র্রষ্টার কাছে তিনি মিনতি করেছেন এই বলে— আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধুলার তলে।/ সকল অহংকার হে আমার ডুবাও চোখের জলে॥/ নিজেরে করিতে গৌরব দান, নিজেরে কেবলই করি অপমান/ আপনারে শুধু ঘেরিয়া ঘেরিয়া/ ঘুরে মরি পলে পলে।

গীতাঞ্জলি-র আরেকটি গীতে কবি গাইছেন : নামাও নামাও আমায় তোমার/ চরণতলে,/ গলাও হে মন, ভাসাও জীবন/ নয়নজলে।/ একা আমি অহংকারের/ উচ্চ অচলে,/ পাষাণ-আসন ধুলায় লুটাও,/ ভাঙ্গো সবলে।/ নামাও নামাও আমায় তোমার/ চরনতলে।/ কী লয়ে বা গর্ব করি/ ব্যর্থ জীবনে।/ ভরা গৃহে শূন্য আমি/ তোমা বিহনে।/ দিনের কর্ম ডুবেছে মোর/ আপন অতলে/ সন্ধ্যাবেলার পূজা যেন/ যায় না বিফলে।/ নামাও নামাও আমায় তোমার/ চরনতলে।

গর্ব করার মতো কতকিছুই না কবির ছিল, তা আমরা জানি। তাই কবি যে কথাগুলো বলেছেন তা কেবল তার বিনয়ের কথা। কারণ বিনয় ছাড়া বন্দনা হতে পারে না। আমরা যখন মনের ঘরে ঢুকতে যাই তখন এই বিনয় অর্থাৎ নিরহংকারের সাথেই ঢুুকতে হবে। তাহলেই আমরা প্রকৃত অর্থে ধ্যানমগ্ন হতে হবে।

স্রষ্টার সৃষ্টিনৈপুণ্য, সৃষ্টিজগতে বিরাজমান অনবদ্য ঐকতান ও সিম্ফনি নিয়ে রবীন্দ্রনাথ যা উপলব্ধি করেছেন, তা তিনি বিপুল সাহিত্যকর্মের মধ্য দিয়ে তুলে ধরেছেন বিশ্ববাসীর সামনে। নানা সুরে ও বিনম্র্র ভঙ্গিতে। 

১৯১৩ সালে লন্ডন থেকে প্রকাশিত গীতাঞ্জলি-র ইংরেজি অনুবাদের (Song Offerings) দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকা লিখেছিলেন বিশ শতকের প্রখ্যাত আইরিশ কবি ডব্লিউ. বি. ইয়েটস। ওখানে তিনি বলেন, ‘... এখানে পথিক গেরুয়া বসন পরিধান করে গায়ে ধুলো লাগলে বোঝা যাবে না বলে, যুবতী তার শয্যায় তার প্রেমিক রাজপুত্রের মালা থেকে খসে পড়া পাপড়ি খোঁজে, ভৃত্য বা বধূশূন্য গৃহে প্রভুর প্রত্যাবর্তনের প্রতীক্ষা করে, এসবই ঈশ্বরের দিকে ধাবমান হৃদয়ের প্রতীক। ফুল আর নদী, শঙ্খধ্বনি, ভারতীয় ঘন বর্ষা অথবা তপ্ত নিদাঘ, এগুলোও মিলনের বা বিরহের বিভিন্ন মেজাজের প্রতিচ্ছবি; আর নৌকোর ওপর বসে যে ব্যক্তিটি বাঁশি বাজান রহস্যময়, অর্থব্যঞ্জক চীনা চিত্রপটের মতো, তিনি স্বয়ং ঈশ্বর ...।’ 

এভাবেই হৃদয়-নিঃসৃত নন্দিত সাহিত্যবাণী দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন স্র্রষ্টার দিকে চিরধাবমান, যার অনন্য সাহিত্যরূপ এই গীতাঞ্জলি। ইসলামিক পরিভাষায় স্র্রষ্টাবন্দনাকে অভিহিত করা হয় ‘হামদ’ নামে। গীতাঞ্জলি-র এই ‘হামদ’-ই জাতিধর্মনির্বিশেষে বিশ্ববাসীর মন কেড়েছে শত বছরেরও বেশি সময় ধরে। কবি এতে যা রচনা করেছেন, তা হলো স্র্রষ্টার প্রতি এক সমর্পিত বান্দার হৃদয়ের নৈবেদ্য। 

তাই রবীন্দ্রনাথকে আমরা যেন দেখি সামগ্রিকরূপে, খণ্ডিতরূপে নয়। তাহলেই তার বিজ্ঞান চেতনা, সার্বজনীন প্রেম এবং তার ধ্যান ও স্রষ্টাবন্দনা থেকে জীবন-জগৎ সম্বন্ধে আমরা একটি পরিপূর্ণ ধারণা লাভ করতে পারব। আজকের এই শশব্যস্ত কোলাহলময় জীবনে প্রতিদিন কিছুক্ষণের জন্যে হলেও যদি বিনয় ও দীনতার সাথে ধ্যানমগ্ন হয়ে আমরা বিশ্বস্র্রষ্টার করুণাকে অনুভব করতে পারি, সকল প্রাপ্তির জন্যে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানিয়ে তাঁর বন্দনা করতে পারি, তবে স্রষ্টাকে আমরা পাব আমাদের সকল শুভ-উদ্যোগের সঙ্গী হিসেবে ও দিশারী হিসেবে এবং সেটাই হবে আমাদের জীবনের সর্বোত্তম পাওয়া।

কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন আয়োজিত বিশেষ আলোচনা, ২১ ডিসেম্বর ২০১৭
(উল্লেখ্য, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসুর ১২০তম বন্ধুত্ববার্ষিকী উপলক্ষে কলকাতার জোড়াসাঁকোস্থ ঠাকুরবাড়িতে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ও জগদীশ চন্দ্র বোস ইনস্টিটিউটের যৌথ উদ্যোগে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় ২০১৮ সালের ২৬ মার্চ। সেখানে মূল প্রবন্ধ হিসেবে এটি পাঠ করেন ড. এম শমশের আলী।)