ঢাকা, শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ৭ ১৪৩১

জানতে হবে নিজের দেশ, মানুষ ও সংস্কৃতিকে

অধ্যাপক রফিকুন নবী (রনবী)

প্রকাশিত : ০৪:০৩ পিএম, ১৮ মার্চ ২০২১ বৃহস্পতিবার

আমি তখন বেশ ছোট। প্রতিবেশী দারোগা সাহেবের ছেলেটি ছিল আমার খুব কাছের বন্ধু। একসাথে খেলতাম। আমরা ছিলাম প্রায় একই বয়সী। হঠাৎ একদিন দেখি এ হিন্দু পরিবারটি নেই। তারা ভারতে চলে গেছে। আমার ভীষণ মন খারাপ হয়েছিল সেদিন।

ওরা ভারতে চলে গেল কেন? আর কোনোদিন ফিরবে না? এমনই কত প্রশ্ন তখন আমার মনে। ঐ বাসাতেই নতুন দারোগা এলেন ভারত থেকে। এ পরিবারটি মুসলমান। তাদের ছোট বাচ্চাটিও আমারই বয়সী। তবু মানুষগুলো তো আর এক নয়। ছোটবেলায় এ ঘটনা সাংঘাতিক দাগ কেটেছিল আমার মনে।

সে-সময় আমরা গ্রামের বাড়িতে যেতাম ব্রডগেজ ট্রেনে। যাওয়া-আসার পথে দেখতাম অগণিত মানুষের ভিড়। মুসলমান পরিবারগুলো ভারত থেকে চলে আসছে আমাদের দেশে। আর হিন্দু পরিবারগুলো চলে যাচ্ছে ভারতে। তখন দেশভাগ কী আর কেনই-বা হলো, এসব আমি কিছুই বুঝি না।

১৯৪৭-এ দেশভাগের আগের ঘটনা মনে পড়ে। আমার বাবা তখন পুলিশ বিভাগে কর্মরত ছিলেন ফতুল্লা থানায়। আমার বয়স তখন চার। সে-সময় আমাদের গ্রামের সব মানুষ একত্র হয়ে নাটক দেখত। ব্রিটিশবিরোধী নাটক সিরাজউদ্দৌলা। দেখতাম সিরাজউদ্দৌলার ভূমিকায় অভিনয় করছেন একজন হিন্দু ভদ্রলোক। হিন্দু-মুসলমান বৈরিতার কথা আমরা পরবর্তীকালে শুনেছি কিন্তু এগুলো কিছুই দেখি নি।

আমার দাদাও ছিলেন একজন পুলিশ অফিসার। তার আকস্মিক মৃত্যুতে পারিবারিক চাপের মুখে আমার বাবা চাকরিতে ঢুকতে বাধ্য হলেন। অথচ বাবার ছিল ছবি আঁকার শখ। কলকাতা আর্ট কলেজে ভর্তি পরীক্ষায় পাশ করেও ভর্তি হতে পারলেন না। আমি দেখতাম— প্রতি সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে তিনি ছবি আঁকতেন।

বাবা স্লেট-পেন্সিল দিয়ে আমাকে দেখাতেন হাতি কীভাবে আঁকতে হয়, পাখি কীভাবে আঁকতে হয়। আমি বাবার মতো সুন্দর করে আঁকতে চেষ্টা করতাম। এভাবেই ছবি আঁকার প্রতি ধীরে ধীরে আমার মধ্যে একটা আগ্রহ তৈরি হতে থাকল।

আঁকার প্রতি ভালোলাগা থেকেই আর্ট কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম। তবে আমার চেয়েও এ ব্যাপারে বেশি আগ্রহ বাবারই ছিল। ১৯৬৪ সালে আমি ফাইনাল পরীক্ষা দিলাম এবং আমার রেজাল্ট বেশ ভালো হলো। রেজাল্টের দিনই শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন স্যার আমাকে ডেকে পাঠালেন। 

স্যার আমাকে চারুকলায় শিক্ষক হিসেবে যোগ দিতে বললেন। কিন্তু থার্ড ইয়ারে পড়ার সময়েই আমি অবজার্ভার গ্রুপ অব পাবলিকেশনসে খণ্ডকালীন কাজ শুরু করি। ইচ্ছা ছিল পড়াশোনা শেষে ওখানেই কাজ করব, বড় প্রচ্ছদশিল্পী হবো। তবে শেষ পর্যন্ত আবেদিন স্যার আর বাবার কথা আমি ফেলতে পারি নি। বৃহস্পতিবার রেজাল্ট হলো আর সোমবার আমি চারুকলায় যোগদান করলাম।

ছাত্রজীবন থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত নানান কিছু দেখেছি। দেশ নিয়ে আমাদের মধ্যে তখন নানান অনুভূতি-উপলব্ধি তৈরি হচ্ছে। কেন মানুষ মুক্তি চায় তা যেন আমরা একটু একটু করে বুঝতে পারছি। ১৯৫২-তে ভাষা আন্দোলনের পর আমাদের দেশে একটার পর একটা রাজনৈতিক আন্দোলন হচ্ছিল, তার সাথে সাথে সাংস্কৃতিক আন্দোলন।

১৯৬৯-এর গণ-আন্দোলনে শিল্পীদের একটা বড় ভূমিকা ছিল। আমরা তখন মিছিলের জন্যে কার্টুন পোস্টার এঁকেছি। আমাদের চিন্তা ছিল ৫০০ জন মানুষ মিছিলে থাকবে, প্রত্যেকের হাতে যেন একটা করে ব্যানার থাকে, ফেস্টুন থাকে, পোস্টার থাকে। 

এসব আয়োজন নিয়ে চারুকলা তখন সাংঘাতিক ব্যস্ত। আমরা ছড়ার বই বের করলাম ৬৯-এর ছড়া। বিখ্যাত হয়ে গেল বইটি। এই কাজগুলো আর্টিস্টরাই করেছিল। সবার সম্মিলিত প্রয়াসে এসব আন্দোলন ধীরে ধীরে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত এসে দাঁড়াল। এভাবেই আমাদের একটা বৈরি সময়ের মধ্য দিয়ে শিল্পকলা চর্চা করতে হয়েছে, যা সহজ ছিল না মোটেই।

শিল্পী হিসেবে আমি ভাবতাম রোমান্টিক ছবি আঁকব, প্রকৃতি আঁকব, মানুষ আঁকব। কার্টুন আঁকব এমন কথা কখনো ভাবি নি। দেশ, কাল ও চারপাশের অবস্থা চিন্তা করে কার্টুনচর্চার সাথে আমার সম্পৃক্ততা। মিছিলের জন্যে কার্টুন আঁকা শুরু হয়েছিল। স্বাধীনতার পর পত্রিকায় কার্টুন আঁকতাম। হঠাৎ আমার মনে হলো, অনেক আগে একটি ছোট্ট পথশিশুকে নিয়ে আমি এমনই কার্টুন করতাম। হাস্যরসাত্মক কার্টুন। ভাবলাম, ওদের মধ্য থেকে একটা চরিত্র ঠিক করি এবং তার একটা নাম দিয়ে দেই।

শুরু করলাম টোকাই নাম দিয়ে। টোকাই একসময় আমার চেয়েও অনেক বেশি জনপ্রিয় হয়ে গেল। সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং মানুষের দুঃখ-দুর্দশা সবকিছুই উঠে আসত টোকাই-এর বুদ্ধিদীপ্ত ও সরস মন্তব্যে। আসলে আমরা শিল্পীরা কি আমাদের দেশকে ভুলে কিছু করতে পারব? অন্য কিছু ভাবতে পারব? পারব না। অতএব দেশকে নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে।

দীর্ঘ শিল্পচর্চার মধ্য দিয়ে আমি উপলব্ধি করেছি, শিল্পী হওয়াটা আসলে দুরকমের। ট্যালেন্ট নিয়ে জন্মালে একরকম। তথাকথিত ট্যালেন্ট নেই, অথচ শিল্পী হওয়ার ইচ্ছা নিয়ে আর্ট কলেজে এসেছে তাকে দিয়েও হবে। তবে অনেক পরিশ্রম করতে হবে, নিজেকে তৈরি করতে হবে।

শিল্পী হিসেবে আমারও নিজেকে তৈরি করতে হয়েছে। আমাকে সহযোগিতা করেছে দেখা, শোনা ও জানার আগ্রহ। একজন শিল্পীকে তার দেশ, দেশের মানুষ-সংস্কৃতি-পরিবেশ সবকিছু সম্পর্কে জানতে হবে। চারপাশকে গভীরভাবে দেখা ও শোনার দক্ষতা তাকে আয়ত্ত করতে হবে। কেননা সবমিলিয়েই আমাদের জীবন। আর জীবন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেই সামনে এগিয়ে যেতে হবে আমাদের।
লেখক : একুশে পদক প্রাপ্ত খ্যাতনামা চিত্রকর
মুক্ত আলোচনা, ৭ মে ২০১৮