ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৮ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৪ ১৪৩০

পাখি পরিচিতি

নিশাচর শিকারি প্যাঁচা

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১০:৪৩ এএম, ৫ এপ্রিল ২০২১ সোমবার

প্যাঁচা, পেঁচা, বা পেচক। যে নামেই ডাকিনা কেনো, এ পাখিটিকে আমরা কম বেশি চিনি। নিশাচর শিকারী এ পাখিটি কারো করো কাছে অশুভ। প্যাঁচার অদ্ভুত রকমের ডাক এবং নিশাচর স্বভাব একে নানা কুসংস্কার এবং অলৌকিক চিন্তার সাথে যুক্ত করেছে।

কেনিয়ার কিকুয়ু উপজাতিগোষ্ঠী বিশ্বাস করে যে, প্যাঁচা মৃত্যুর আগমনের কথা জানিয়ে দেয়। যদি কেউ একটি প্যাঁচা দেখে কিংবা তার আওয়াজ শোনে তাহলে সে মৃত্যুমুখে পতিত হবে। প্রচলিত বিশ্বাসবোধে প্যাঁচাকে মন্দ ভাগ্য, শারীরিক অসুস্থতা অথবা মৃত্যুর প্রতিচ্ছবি হিসেবে গণ্য করা হয়। প্রাচীনকাল থেকেই এই বিশ্বাস অদ্যাবধি প্রচলিত রয়েছে।

তবে বিজ্ঞানীরা পেঁচাকে শুভ কিংবা অশুভ কোনোটাই মানতে নারাজ। পেঁচা অন্য সবার মতোই প্রাণিজগতের একজন সদস্য। 

স্ট্রিজিফর্মিস বর্গভূক্ত এই পাখিটির বিভিন্ন প্রজাতি রয়েছে। তবে এখনও পর্যন্ত প্রায় ২০০টি প্রজাতি টিকে আছে। এখনও পর্যন্ত যেসব প্যাঁচার দেখা পাওয়া যায় তাদেরকে দুটো গোত্রে ভাগ করা হয়েছে- সাধারণ প্যাঁচা বা স্ট্রিগিডি এবং লক্ষ্মীপ্যাঁচা বা টাইটোনিডি।

ভিন্ন প্রজাতির প্যাঁচার ডাক ভিন্ন রকম। ডাকের ভিন্নতা অনুযায়ী বাংলায় বিভিন্ন প্যাঁচার বিভিন্ন নামকরণ হয়েছে। যেমন : হুতুম প্যাঁচা (Bubo bengalensis), ভূতুম প্যাঁচা (Ketupa zeylonensis), লক্ষ্মীপ্যাঁচা (Tyto alba), খুঁড়ুলে প্যাঁচা (Athene brama), কুপোখ (Ninox scutulata), নিমপোখ (Otus lepiji) ইত্যাদি।

বেশীরভাগ প্যাঁচা ছোট ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী যেমন ইঁদুর এবং কীটপতঙ্গ শিকার করে, তবে কিছু প্রজাতি মাছও ধরে। প্যাঁচা উপর থেকে ছোঁ মেরে শিকার ধরতে অভ্যস্ত। শিকার করা ও শিকার ধরে রাখতে এরা বাঁকানো ঠোঁট বা চঞ্চু এবং নখর ব্যবহার করে।

কুমেরু, গ্রীনল্যান্ড এবং কিছু নিঃসঙ্গ দ্বীপ ছাড়া পৃথিবীর সব স্থানেই প্যাঁচা দেখা যায়। বাংলাদেশে ১৭টি প্রজাতির (মতান্তরে ৮ গণে ১৫ প্রজাতি) প্যাঁচা পাওয়া যায়। যার মধ্যে ২৫টি স্থায়ী এবং ২টি পরিযায়ী। প্যাঁচা মূলত নিঃসঙ্গচর। এরা গাছের কোটর, পাহাড় বা পাথরের গর্ত বা পুরনো দালানে থাকে।

প্যাঁচার মাথা বড়, মুখমন্ডল চ্যাপ্টা এবং মাথার সম্মুখদিকে চোখ। প্যাঁচার চোখের চারিদিকে সাধারণত বৃত্তাকারে পালক সাজানো থাকে যাকে ফেসিয়াল ডিস্ক বলে। এদের অক্ষিগোলক সামনের দিকে অগ্রসর থাকায় এরা দ্বিনেত্র দৃষ্টির অধিকারী।

প্যাঁচার দূরবদ্ধদৃষ্টি আছে ফলে এরা চোখের কয়েক ইঞ্চির মধ্যে অবস্থিত কোন বস্তু পরিষ্কারভাবে দেখতে পায় না। এরা এদের ধরা শিকারকে চঞ্চু এবং নখরে অবস্থিত বিশেষ এক ধরনের পালক দ্বারা অনুভব করতে পারে। প্যাঁচা তার মাথাকে একদিকে ১৩৫ ডিগ্রী কোণে ঘোরাতে পারে। তাই দুই দিক মিলে এদের দৃষ্টিসীমা ২৭০ ডিগ্রী। ফলে এরা নিজের কাঁধের উপর দিয়ে পেছনে দেখতে পায়।

প্যাঁচার শ্রবণশক্তি খুব প্রখর। শুধু শব্দ দ্বারা চালিত হয়ে এরা নিরেট অন্ধকারে শিকার ধরতে পারে। সামান্য মাথা ঘুরালে প্যাঁচা অনুচ্চ শব্দ যেমন ইঁদুরের শষ্যদানা চিবানোর আওয়াজও শুনতে পায়, এর কারণ হচ্ছে মাথার গড়ন রূপান্তরিত হওয়ার জন্য প্যাঁচার দুই কানে সামান্য আগে পরে শব্দ পৌঁছায়। এরা বাতাসে উড়ার সময় কোনো রকম শব্দ করে না। প্যাঁচার ফেসিয়াল ডিস্ক শিকারের করা শব্দকে শ্রবনে সহায়তা করে। অনেক প্রজাতির প্যাঁচার ফেসিয়াল ডিস্ক অসমভাবে সাজানো থাকে যাতে শিকারের অবস্থান নির্ণয় করা সহজ হয়।

সাধারণত মেয়ে পেঁচা ছেলে পেঁচার  চেয়ে আকারে ২৫% বড় হয়ে থাকে। এন্টার্কটিকা মহাদেশ ছাড়া পৃথিবীর সব মহাদেশেই পেঁচা পাওয়া যায়। পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট পেঁচা প্রায় সাড়ে ৪ ইঞ্চি লম্বা এবং সবচেয়ে বড় পেঁচা ইউরেশীয়ান ঈগল পেঁচা যা দুই ফুট লম্বা হয়।

আমাদের দেশে নানা ধরনের পেঁচা দেখতে পাওয়া যায়। এর মধ্যে- লক্ষ্মী পেঁচা, কোটরে পেঁচা, নিম পেঁচা, কুপোখ বা কাল পেঁচা, ভুতম পেঁচা, পাহাড়ী পেঁচা, ঘাসবনের পেঁচা, ভুমা পেঁচা, বন্ধনীযুক্ত নিমপোখ পেঁচা, বনের বড় পেঁচা অন্যতম।

পেঁচার অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য
- গ্রেট হর্ন্ড পেঁচাসহ কিছু প্রজাতির পেঁচারা পানিতে সাঁতার কাটতে পারে। শিকার ধরতে প্রায়ই পেঁচাকে জলাশয়ের কাছাকাছি যেতে হয় এবং পালক ভিজে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু পেঁচার মতো ভারী পালকের পাখির পক্ষে ভেজা পালক নিয়ে ওড়া সম্ভব না। তখন এরা ডানার সাহায্যে সাঁতরে তীরে পৌঁছায়।

- পেঁচাকে সাধারণত নিশাচর পাখি বলা হয়। কিন্তু সব পেঁচা নিশাচর না। গ্রেট গ্রে, নর্দান হক্‌, নর্দান পিগমিসহ পেঁচার আরও কয়েকটি প্রজাতি রয়েছে যারা দিনের বেলা শিকার করে। তবে এদের নিশাচর না হওয়ার জন্য দায়ী বিবর্তন। কারণ, এরা যেসব অঞ্চলে বসবাস করে সেখানে রাতের বেলা তেমন কোনো শিকার পাওয়া যায় না।

- পেঁচার ঘাড়ের বৈশিষ্ট্য বিস্ময়কর। এদের ঘাড়ে ১৪টি অস্থিসন্ধি থাকে। মানুষের ঘাড়ে থাকে এর অর্ধেক। এ অনন্য দেহ বৈশিষ্ট্যের জন্য পেঁচার ঘাড় ২৭০ ডিগ্রি পর্যন্ত ঘুরে যেতে পারে। এ দক্ষতা পেঁচাকে টিকে থাকতে সাহায্য করে। এরা সহজে চোখ নাড়াতে পারে না। ফলে ঘাড় ঘুরিয়ে চারপাশের উপর নজর রাখতে হয় এদের।

- কিউবার ‘জায়ান্ট আউল’ হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আকৃতির পেঁচা। এদের উচ্চতা প্রায় সাড়ে তিন ফুট। তবে এরা অনেক আগেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে এবং গবেষকরা নিশ্চিত না যে এরা উড়তে পারতো কিনা। যদি এদের ওড়ার ক্ষমতা থাকতো, তবে এদেরকেই বলা যেত উড়তে জানা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পাখি। কিউবার বনাঞ্চলে এদের দেহাবশেষ আবিষ্কার করেন গবেষকরা।

- মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনীতিতে পেঁচা অনেক উপকারী ভূমিকা পালন করে। এসব অঞ্চলের পেঁচাদের প্রধান শিকার ইঁদুর। আর এই ইঁদুর হচ্ছে ফসলের শত্রু। ইসরায়েল, জর্ডান ও প্যালেস্টাইন অঞ্চলে কৃষিজমির আশপাশ দিয়ে পেঁচার জন্য বাসা বানিয়ে রাখা হয়। এক জোড়া পেঁচা বছরে গড়ে ছয় হাজার ইঁদুর শিকার করে।

- কিছু কিছু পেঁচার নকল চোখ থাকে, যেমন- নর্দান পিগমি আউল। এদের চোখের রং উজ্জ্বল হলুদ। কিন্তু এদের মাথার পেছনে কালো রঙের কিছু পালক আছে যা দেখলে অবিকল চোখ বলে মনে হবে। শিকারি প্রাণীকে বিভ্রান্ত করে এ নকল চোখ।

- আর্কটিকে বসবাসকারী তুষার পেঁচারা শীতের মৌসুমে দক্ষিণ দিকে তিন হাজার মাইল পর্যন্ত ভ্রমণ করে।

- পেঁচা দুই কানে দুই রকম শব্দতরঙ্গ শনাক্ত করতে পারে।

- নারী পেঁচারা আকৃতিতে পুরুষ পেঁচার চেয়ে বড়।

- পেঁচারা বাসা তৈরি করতে পারে না। এরা বেশিরভাগ সময়ই গাছের কোটরে বসবাস করে। অন্য পেঁচার পরিত্যক্ত গাছের কোটরই বেছে নেওয়া পছন্দ পেঁচাদের।

এসএ/