ঢাকা, সোমবার   ০৪ নভেম্বর ২০২৪,   কার্তিক ২০ ১৪৩১

বইমেলায় শেখ মোহাম্মদ হাসানূর কবীরের উপন্যাস ‘গহনে নোঙর’

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১০:০৬ পিএম, ১০ এপ্রিল ২০২১ শনিবার

‘গহনে নোঙর’ উপন্যাসের কাহিনি গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের একটি অখ্যাত অমার্জিত গ্রামকে আশ্রয় করে। শিক্ষা-সভ্যতায় অনগ্রসর গ্রামটির নাম বাহাদুরপুর। আধুনিক নগরায়ণের ঢেউ বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলকে স্পর্শ করলেও বাহাদুরপুর গ্রামে তার ছিটেফোঁটাও এসে পৌঁছায়নি। দারিদ্র্য, কুসংস্কার আর সমাজের প্রভাবশালী ধুরন্ধরদের দৌরাত্ম্যে বাহাদুরপুরের সাধারণ মানুষের প্রাণ ওষ্ঠ্যাগত। একসময় বাহাদুরপুর গ্রামের সুবিধাবঞ্চিত ভাগ্যহত এই সব মানুষের জীবনে আশীর্বাদ হয়ে আসেন জোহান নামে একজন খ্রিস্টান সন্ত।

জোহানের জন্ম নিউজিল্যান্ডের ওয়েলিংটনে এক অভিজাত পরিবারে। তিনি পড়াশোনা করেছেন চিকিৎসা শাস্ত্রে অটাগো মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটিতে। জোহানের লক্ষ্য ছিলো দরিদ্র কপর্দকহীন মানুষদের ভালোবাসা দিয়ে, সেবা দিয়ে হৃদয় জয় করে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করার; কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি লক্ষ্যে অবিচল থাকতে পারেননি। অসীম মহানুভবতা আর নৈতিক দৃঢ়তায় জোহান অল্পদিনেই হয়ে উঠলেন পুরোপুরি মানবতাবাদী অসাম্প্রদায়িক চেতনার এক ভিন্ন মানুষ। 

পরিযায়ী বলে গ্রামের লোকেরা জোহানকে সম্বোধন করতো পরদেশী বলে। ধীরে ধীরে জোহান গ্রামের খেঁটে খাওয়া প্রান্তিক মানুষের খুব প্রিয়জন হয়ে উঠেন। জোহান বাহাদুরপুর গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেন ‘বাহাদুরপুর চ্যারিট্যাবল হসপিটাল’ নামে একটি হাসপাতাল। মাটির দেয়াল ঘেরা চারচালা দুটি খড়ের ঘরে চলে জোহানের হাসপাতালের চিকিৎসা কার্যক্রম। জোহানের সহযোগিতায় পাশে এসে দাঁড়ায় সহায় সম্বলহীন প্রতাবপুর গ্রামের বিধবা গৃহবধূ আয়শা। আয়শা হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসে সুস্থ হয়ে আর বাড়ি ফেরেনি। জোহানের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে সেবিকা হিসেবে থেকে গেছে হাসপাতালে। ঘটনা পরিক্রমায় জোহানের সাথে পরিচয় হয় বাহাদুরপুর গ্রামের বিত্তবান ইন্তাজ শেখের স্ত্রী জয়তুনের। জয়তুনের বয়স অল্প। সবসময় হাসি তামাশায় মেতে থাকে। জয়তুন স্বপ্ন দেখে জোহানকে নিয়ে, কিন্তু জোহান জয়তুনের কাছ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নেয়। জয়তুনের জীবনে চলতে থাকে টানাপড়েন। এদিকে লোকমান জোহানকে প্রতিপক্ষ ভাবতে শুরু করে। লোকমান বাহাদুরপুরের মানুষের রোগ শোকে একমাত্র আশা-ভরসার স্থল। এলোপ্যাথিক, হোমিওপ্যাথিক, আয়ুর্বেদিক ও ঝাড়ফুঁকসহ বাঙালি চিকিৎসা ব্যবস্থার সকল শাস্ত্রে লোকমানের দাপুটে বিচরণ। গ্রামের লোকজনের কাছে সে ডাক্তার হিসেবে পরিচিত। 

বাহাদুরপুর, প্রতাবপুর, নিশ্চিন্তপুর ও সুন্দরপুরসহ আশপাশের গ্রামের মানুষ তাকে সাক্ষাত কলিযুগের অবতার রূপে মান্য করে। তবে জোহান বাহাদুরপুরে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করায় লোকমানের পূর্বের অবস্থানে খানিকটা ভাঁটা পড়েছে। আর তাই তার যত রাগ জোহান ও তার হাসপাতালের উপর। লোকমান জোহানকে সহ্য করতে পারে না। লোকমানের ধারণা জোহানের কারণেই সে আজ পথে বসেছে। লোকমান জোহানকে উচিত শিক্ষা দেয়ার পরিকল্পনা করে। রাতের আঁধারে জোহানকে হাসপাতালসমেত পুড়িয়ে মারতে গিয়ে লোকমানের সহযোগী গহর সাপের কামড়ে প্রাণ হারায়। সোমেশ্বরী নদীতে কলার ভেলায় ভাসিয়ে দেয়া হয় গহরের লাশ। লোকমান নিদারুণ বেদনায় ক্ষত-বিক্ষত হয়। প্রতিশোধ নিতে মরিয়া হয়ে উঠে সে। অবশেষে জোহানকে ফাঁসাতে লোকমান হাসপাতালের মানসিক রোগী কাজুরীকে খুন করে পাকুড় গাছে ঝুলিয়ে রাখে। কাজুরীকে এ অবস্থায় দেখে জোহান ভেঙে পড়েন। গভীর বেদনা, চিন্তা আর হতাশা তাঁর মনকে আচ্ছন্ন করে রাখে।

একদিন দুর্গাপুর থানা থেকে বাহাদুরপুর ফেরার পথে অকস্মাৎ মাথা ঘুরে রাস্তার পাশে খাদে পড়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন জোহান। চায়ের দোকানদার মোতালেব ও কয়েকজন পথচারী ভ্যানরিক্সা করে জোহানকে নিয়ে আসে হাসপাতালে। হাসপাতালে নিয়ে আসার কিছুক্ষণ পরেই জোহান পৃথিবীর মায়া পরিত্যাগ করে চলে যান অনন্ত জীবনের পথে। বাহাদুরপুর, প্রতাবপুর, নিশ্চিন্তপুর ও সুন্দরপুরসহ আশপাশের গ্রাম থেকে লোকজনের বাঁধ ভাঙ্গা ঢল নামে। তারা ছুটে আসে তাদের প্রিয় পরদেশীকে এক নজর দেখতে। শোকে মূহ্যমান মানুষগুলো হতবিহল হয়ে পাথরের মূর্তির মতন জোহানের মৃত দেহ ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকে।
 
রাত গভীর হয়। চারিদিকে শুনশান নীরবতা। মাঝে মাঝে নীরবতা ভেঙে রাতের প্রহর ঘোষণা করছে পাকুড় গাছের ডালে বসা এক জোড়া নিশিজাগা পাখি। রাতের আঁধারে একগুচ্ছ হিজলের ফুল হাতে জোহানের প্রতি অন্তিম ভালোবাসা জানাতে আসে জয়তুন। জয়তুন জোহানের কবরের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে গুমড়ে কেঁদে উঠে। জয়তুনের সে কান্নার আওয়াজ বাহাদুরপুর চ্যারিটেবল হসপিটালের মাটির দেয়ালে প্রতিফলিত হয়ে খড়ের চালার ফুটো দিয়ে আকাশ ফুঁড়ে শূন্যে মিলিয়ে যায়।

উপন্যাসটিতে ট্র্যাজিক রসে জোহানের সহজ সরল সাদামাটা জীবনের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরা হলেও জোহানের কুসংস্কারাচ্ছন্নতার বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান, নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা ও আধুনিক সুসভ্য জীবন গড়ার প্রতিশ্রুতি উপন্যাসটিকে নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়। এক কথায় বলতে গেলে উপন্যাসটিতে সাধু জোহানের আত্মত্যাগের যে মহিমা অঙ্কিত হয়েছে, তা যুগ যুগ ধরে মানুষের মনে অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।

উপন্যাসটির প্রধান এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র জোহান। জোহান উপন্যাসটির গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হলেও অপরাপর চরিত্রগুলোর আবেদনও কম বলা যাবে না। ইন্তাজ শেখ, লোকমান, জয়তুন, আয়শা, গহর, হাজেরা, মোতালেব, নেতু সর্দার, দীনু হাওলাদার, আয়েন উদ্দিন, কাজুরী, অখিল মাঝি, ইউসুফ গাজী, ময়নাল, হালিমা ও রাহেলা  প্রত্যেকটি চরিত্রই যেন আমাদের পূর্ববাংলার ঘুণে ধরা ক্ষয়িষ্ণু সমাজ বাস্তবতাকেই মনে করিয়ে দেয়।

এবারের অমর একুশের গ্রন্থমেলা,২০২১ এ আসা নতুন এই উপন্যাসটি পাওয়া যাচ্ছে- সাহস প্রকাশনী, স্টল নম্বর ৫০৫ ও ৫০৬ (টিএসসি গেট সংলগ্ন) সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লেকের পশ্চিম পাড়ে। এছাড়া ঘরে বসে রকমারি ডটকম এ অর্ডার করেও পাওয়া যাবে।
কেআই//