ঢাকা, বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ১১ ১৪৩১

রোহিঙ্গা ক্যাম্পের শুরুর দিনগুলো খুব সহজ ছিল না 

ধীরা ঢালী

প্রকাশিত : ১০:০৮ পিএম, ১১ এপ্রিল ২০২১ রবিবার | আপডেট: ১০:১৬ পিএম, ১১ এপ্রিল ২০২১ রবিবার

আগস্ট মাসের শেষের দিকে রোহিঙ্গারা মিয়ানমার থেকে এদেশে স্রোতের মতো আসতে শুরু করে। নিজ দেশ ছাড়তে বাধ্য হওয়ার পরও তাদের নিয়ে তখনো আন্তর্জাতিকভাবে কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। এই মর্মান্তিক পরিস্থিতিতে তাদের ভাগ্যে কী আছে সেটা কেউ জানে না।  নিরুপায় এই মানুষগুলো শুধু প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে এদেশে পাড়ি জমাতে থাকে। তবে জীবন তো বাঁচাতে হবে! দেশী-বিদেশী এনজিও-গুলোর সাহায্য-সহযোগিতা তখনো এসে পৌঁছায়নি। আর আসবেই বা কীভাবে! ঈদ সামনে রেখে ছুটি হয়ে গেছে অনেকের-ই। তবে সবকিছুকে পেছনে ফেলে মানবতার ডাকে সাড়া দিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে। কিন্তু তাদের অবস্থাও বেহাল, পর্যাপ্ত ফান্ড নেই। তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো মোটা অংকের ব্যাংক লোন নিয়েই তারা ঝাপিয়ে পড়বে মানবতার ডাকে। তৈরি করা হলো সেচ্ছাসেবক টিম। এভাবেই সেদিনের সেই মানবিক অভিজ্ঞতামিশ্রিত গল্পের শুরুটা করেছিলেন ছোটবেলা থেকে মাদার তেরেসা হওয়ার স্বপ্ন দেখা গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পরিচালক ও গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক  ডা. নাসিমা ইয়াসমিন (পিটি)।  

একুশে টেলিভিশন : রোহিঙ্গারা যখন এদেশে আসতে শুরু করে, তখন প্রথম বেসরকারি সংগঠন হিসেবে আপনরাই অর্থাৎ গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র তাদের পাশে দাঁড়ায়। এই কঠিন পরিস্থিতি আপনারা কীভাবে পাড়ি দিয়েছেন? 

ডা. নাসিমা ইয়াসমিন (পিটি) : রোহিঙ্গারা সহায়-সম্বলহীনভাবে এদেশে আসে। তখন তাদের অবস্থা যতটা অসহায়ত্ব, দুর্দিনের মধ্যদিয়ে কাটছিল, আমাদেরও ঠিক তেমনটাই। এতগুলো মানুষের খাদ্য, চিকিৎসা, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা খুব একটা সহজ ছিল না। তবে আমরা মনোবল ধরে রেখেছি, সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি তাদের বেঁচে থাকা এবং নিরাপত্তা কিছুটা হলেও নিশ্চিত করতে।  

একুশে টেলিভিশন : এতো বিশাল জনসংখ্যার খাদ্য ও চিকিৎসা বা আশ্রয়ের জন্য প্রয়োজন ছিল বড় অংকের অর্থের। কীভাবে যোগাড় হলো "পর্যাপ্ত ফান্ড"? 

ডা. নাসিমা ইয়াসমিন (পিটি) : আমরা সামনে-পেছনে কোনোকিছু চিন্তা না করেই মোটা অংকের ব্যাংক লোন নিয়ে কাজ শুরু করি। এই নিরীহ মানুষগুলোর জীবন তো বাঁচাতে হবে, তাদের নিরাপত্তা তো নিশ্চিত করতে হবে। তবে একটা সময়ে আমাদের কাজের প্রতি একাগ্রতা, নিষ্ঠা দেখে দেশী-বিদেশী এনজিও গুলো আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে এবং তাদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে আমাদেরকে আস্বস্ত করে। আর একটা ইতিবাচক কারণ পেছলে ছিল, সেটা হলো গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের পূর্ব পরিচিতি এবং কাজের ক্ষেত্রে আপোষহীনতা। যেটা ঐ দুর্দিনে আমাদেরকে অনেকাংশে সামনে এগোতে সাহায্য করেছিল।  

একুশে টেলিভিশন : বাংলাদেশ তো এর আগে কখনো এমন পরিস্থিতি মোকাবেলা করেনি। সেদিক থেকে আপনাদের কর্মীরাও এমন পরিস্থিতি মোকাবেলায় যথেষ্ট দক্ষ ছিল না। কীভাবে পুরো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করলেন? 

ডা. নাসিমা ইয়াসমিন (পিটি) : কর্মীদের নিয়মিত কাউন্সেলিং, কাজের ফিডব্যাক, চোখের সামনে নিরীহ মানুষগুলোর মর্মান্তিক অবস্থা এগুলো কর্মীদের সাময়িক  মানসিক শক্তি যোগাতে সাহায্য করেছিল। এক পর্যায়ে তারা এই পরিস্থিতিতে নিজেদের মানিয়ে নিতে শুরু করে। আমরা প্রথম  দুইটা মাস কখনো রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মধ্যে পানি, খাবার এগুলো খেতাম না। ওয়াশরুম করতাম না। আসলে ঐ নির্যাতিত মানুষগুলোর হাহাকার দেখে আমাদের মুখে খাবার উঠতো না। তবে মাস দুই পরে পরিস্থিতি কিছুটা আমাদের আয়ত্বে চলে আসে। দেশী-বিদেশী কিছু কিছু এনজিও-গুলোও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে থাকে। তখন আমাদের কর্মীরা নিজেদের শরীর টিকিয়ে রাখতে ক্যাম্পের মধ্যে হালকা শুকনো খাবার, যেমন কলা, রুটি এবং পাশাপাশি পানি খেতে শুরু করে। আমিও একদিন চেষ্টা করলাম কিছু খেতে। শরীর তো চলমান রাখতে হবে। কিন্তু কোথায় বসে খাবো, এটাও একটা বিষয়। চলে গেলাম আমাদের প্রতিদিনের পরিবহনকৃত গাড়ির মধ্যে। আমরা যেহেতু সারাদিন রোগী দেখি, রোগীদের সেবা করি। তাছাড়া ঐ সময়ে রোহিঙ্গাদের অধিকাংশ নারী এবং শিশুর দেহে ছিল "স্কিন ইনফেকশন"। সুতরাং জীবাণু সংক্রমণের বিষয়টা আমাদের তখন মাথায় রাখতে হয়েছে। হাত ধোঁয়ার জন্য পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থাও ছিল না। এটা মাথায় রেখে আমি গাড়ির গ্লাস লক করে ভেতরে বসে একটা কলার খোসা ছাড়াতে থাকি, কারণ হাত না ধোঁয়া অবস্থায় কলা খাওয়াটাই নিরাপদ বলে আমি মনে করলাম।হঠাৎ বাইরে চোখ পড়তেই লক্ষ্য করলাম ৭-৮ টি বাচ্চা গাড়ির গ্লাসে এক নাগাড়ে ধাক্কা দিচ্ছে, কলাটা নেওয়ার জন্য। বলুন তো তখন কোনো মানুষের পক্ষে এতোগুলো ক্ষুধার্ত শিশুকে সামনে রেখে ওই খাবার মুখে দেওয়া সম্ভব! আমি খেতে পারিনি। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আর কখনো খাওয়ার চেষ্টাও করিনি, ইচ্ছেও হয়নি।ঐ শিশুগুলোর ক্ষুধার্ত মুখ এখনো আমার সামনে ভেসে উঠলে আমি হতভম্ব হয়ে পড়ি। অথচ চিন্তা করি বিশ্ব কীভাবে এতটা অমানবিকতার পরিচয় দিচ্ছে! মানুষ হয়ে মানুষের প্রতি এই অমানবিক নিষ্ঠুর নির্যাতন কীভাবে করা সম্ভব! 

একুশে টেলিভিশন : শুরু থেকেই রোহিঙ্গারা কী আপনাদেরকে সহজভাবে গ্রহণ করতে পেরেছিল?  

ডা. নাসিমা ইয়াসমিন (পিটি) : না, পারেনি, এর মূল কারণ ছিল তারা অনেকটা রক্ষণশীল। এছাড়া তাদের মধ্যে গর্ভবতী নারী এবং শিশুর সংখ্যা ছিল বেশি। এক্ষেত্রে তারা নিরাপত্তা এবং চিকিৎসার ক্ষেত্রে নারী সেবিকা বা কর্মীকে  সহজভাবে গ্রহণ করতো। পাশাপাশি আরেকটা বিষয় ছিল লক্ষণীয় তারা যেহেতু ধর্ম হিসেবে ইসলামকে প্রাধান্য দেয়, সেক্ষেত্রে তাদের কামনাও থাকে তাদের আশেপাশের মানুষগুলো একই ধর্মের হবে। কিন্তু আমাদের কর্মীদের মধ্যে একটা বড় অংশ  ছিল সনাতন ধর্মের। তবে রোহিঙ্গাদের মানসিক অবস্থা এবং সমসাময়িক পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে আমরা সিদ্ধান্ত নিই কর্মীদের পরিচয় গোপন রাখতে। যেন তারা সহজভাবে আমাদেরকে গ্রহণ করতে পারে এবং সেটা অল্প কিছুদিনের মধ্যে সম্ভবও হয়েছিল। আমরা তাদের আস্থার জায়গাটা তৈরি করতে পেরেছিলাম। 

একুশে টেলিভিশন : রোহিঙ্গা ক্যাম্পকে ঘিরে আপনার বিশেষ কোনো স্মৃতি আছে কিনা?  

ডা. নাসিমা ইয়াসমিন (পিটি) : রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এক গর্ভবতী মায়ের প্রসব বেদনার মুহূর্ত মনে পড়লে এখনো আমার শরীরের লোমকূপগুলো খাঁড়া হয়ে ওঠে। গভীর অন্ধকার রাতে গহীন পাহাড়ের বুকে ঝুম বৃষ্টির মধ্যে খোলা আকাশের নিচে প্রসব যন্ত্রণায় ছটফট করছে একজন মা। আমিও একজন নারী হয়ে কীভাবে এটা সহ্য করবো! তাৎক্ষণিক তার ডেলিভারির ব্যবস্থা করলাম। কিন্তু যমজ দুই শিশু ছিল ঐ মায়ের গর্ভে। প্রথম জনকে পৃথিবীর মুখ দেখাতে পারলেও দ্বিতীয় জন যেন কোনো অবস্থাতেই মায়ের গর্ভ ত্যাগ করে পৃথিবীর মুখ দেখতে প্রস্তুত ছিল না। এদিকে রাত বেশি হওয়ার জন্য আবার বিজিবি'র ট্রল। তারা কোনো অবস্থাতেই আমাদেরকে ক্যাম্পের মধ্যে থাকতে দিতে নারাজ। তবে আমরাও বা কীভাবে অসহায় ঐ মাকে ফেলে রেখে আসবো। অনেক চেষ্টার পরে দ্বিতীয় শিশুর জন্ম হলো, কিন্তু জন্মের আগেই যে তার মায়ের গর্ভে মৃত্যু হয়েছিল এটা কে জানতো! ঐ রাতে মা এবং প্রথম নবজাতকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে আমরা রওনা হলাম আমাদের নিজস্ব নীড়ে। অন্ধকারে নিমজ্জিত ঐ রাতের কথা মনে পড়লে আজও আমার সমস্ত শরীর অবস হয়ে পড়ে। 

একুশে টেলিভিশন : আপনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের আন্তর্জাতিক ইস্যুতে  পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। নারীদের এই অবস্থানে খুব কম দেখা যায়। অথচ একজন নারী হিসেবে উঠে আসার এমন সফলতার গল্প জানতে চাই?  

ডা. নাসিমা ইয়াসমিন (পিটি) : এটা একদিনে সম্ভব হয়নি। 

আরকে//