ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ১১ ১৪৩১

কোথায় হারিয়ে গেলো ঢাকাইয়্যা ক্বাসিদা

আ নো য়া র কা জ ল

প্রকাশিত : ০২:১৮ পিএম, ৩ মে ২০২১ সোমবার | আপডেট: ০২:২৪ পিএম, ৩ মে ২০২১ সোমবার

মুঘল আমল থেকে রমজানের মধ্যরাতে সুরেলা কণ্ঠে একদল তরুণ পুরান ঢাকার রোজাদারদের ঘুম থেকে তোলার ‘মহান’দায়িত্ব পালন করত। ঢাকঢোল পিটিয়ে দল বেঁধে পাড়ার লোকদের জানিয়ে দিত সেহরির সময় হয়েছে, ঘুম থেকে উঠতে হবে ইত্যাদি। ফারসি ও উর্দু ভাষার এসব গীত কালের বিবর্তনে বিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। যদিও রমজান আসলে আজো পুরান ঢাকায় ভোররাতে এমন হাকডাক শুনা যায় কিন্তু তা নেহাত ঐতিহ্যের ধারা রক্ষার্থে। সেহরির পূর্বে উর্দু ফার্সি ভাষায় রোজাদারদের জাগিয়ে তোলার এ পদ্ধতির নাম ক্বাসিদা।

পুরান ঢাকায় পবিত্র রমজান এলেই সেহেরির  সময় মহল্লায় মহল্লায় ক্বাসিদা গাওয়া হতো। উদ্দেশ্য, রোজাদারদের ঘুম থেকে জাগানো। বছর কুড়ি আগেও ঢাকার মালিবাগ, খিলগাঁও, রামপুরা ইত্যাদি এলাকায়ও ক্বাসিদার প্রচলন ছিল। কিন্তু এখন  প্রযুক্তির ছোঁয়ায় মুঠোফোনের অ্যালামের শব্দে মানুষের ঘুম ভাঙে, তাই আর প্রয়োজন পড়েনা এসব সওয়াব অর্জনের ব্রত নিয়ে ঘুম থেকে তোলা তরুণের দলকে।

ক্বাসিদা অর্থ  কি
ক্বাসিদার অর্থ প্রশংসা বা প্রশস্তিমূলক কবিতা। ইসলাম ধর্মের প্রথম পর্বেই আরবি সাহিত্যে ক্বাসিদার বড় ভান্ডার গড়ে উঠেছিল। ধীরে ধীরে অন্যান্য ভাষায়ও প্রসার লাভ করে। বিশেষ করে ফারসি, তুর্কি, উর্দু ভাষায় ক্বাসিদার বিস্তর দেখা মেলে। এর মূল অর্থ হচ্ছে কবিতার ছন্দে প্রিয়জনদের প্রশংসা করা। ক্বাসিদা শব্দের উৎপত্তি হয়েছে আরবি ক্বাসাদ থেকে। ক্বাসাদ শব্দের অর্থ পরিপূর্ণ । ক্বাসাদ বিবর্তিত হয়ে ফারসি ক্বাসিদায় রূপান্তরিত হয়েছে। সহজ ভাষায় বলতে গেলে যে কবিতায় প্রিয়জনের প্রশংসা করা হয় তাকে ক্বাসিদা বলা হয়। ইবনে কুতাইলা রচিত নবম শতকের বই আন-শিরা ওয়া আন শুয়ারায় ক্বাসিদার গঠনতন্ত্র উল্লেখ করা হয়েছে।

এ গ্রন্থ অনুযায়ী ক্বাসিদার রয়েছে তিনটি অংশ। প্রথম অংশকে বলা হয় নসিব, যেখানে স্মৃতিকাতরতা প্রাধান্য পায়। দ্বিতীয় অংশকে বলা হয় তাখাল্লাস, যেখানে জীবনযাত্রার চুম্বক অংশ তুলে ধরা হয়। আর তৃতীয় অংশকে বলা হত হিজা, যেখানে মূলত অন্যের প্রতি ব্যঙ্গার্থে ব্যবহার করা হত। ক্বাসিদা বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। দর্শনতত্ত্ব, প্রশস্তিমূলক, ভক্তিমূলক, রমজান ও ঈদের ক্বাসিদা।

বাংলাদেশে ক্বাসিদা
বাংলাদেশে ক্বাসিদার প্রচলন মুঘলদের হাত ধরে। ১৬০৮ সালে সুবাদার ইসলাম খানের সাথে মুঘল সংস্কৃতির অংশ হিসেবে ঢাকায় ক্বাসিদার বিকাশ ঘটে। রাজবন্দনা, আল্লাহ-নবীর সিফত,ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদির মাহাত্ম্য বর্ণনা করা হত এসব ক্বাসিদায়। ঊনিশ শতকের পর থেকে রোজার মাসে ক্বাসিদা পাঠের ধুম পড়ে যেতো ঢাকার অলিতে গলিতে।

প্রথম প্রথম ফার্সি ও উর্দুতে হলেও পরে ঢাকার স্থানীয় হিন্দুস্থানি ভাষায় ক্বাসিদার চর্চা হতে থাকে। বিশ শতকের সেই জমজমাট ক্বাসিদার আসর কিংবা ক্বাসিদাওয়ালাদের হাকডাক আজ ঐতিহ্যের ইটের গাঁথুনিতে বিলীন প্রায়। যদিও  রমজানের রাতে আজো পুরান ঢাকার বিভিন্ন অলিগলিতে সেই পুরনো সংস্কৃতির কিঞ্চিৎ চর্চা লক্ষ্য করা যায়।

এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকাশিত ঢাকা কোষ গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে উল্লেখ রয়েছে, নবাবি আমলে ঢাকা শহরের প্রায় প্রতিটি মহল্লার সর্দাররা ক্বাসিদা দলের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। ঢাকার নবাব আহসান উল্লাহর সময় ক্বাসিদা গাওয়ার ব্যাপক প্রসার ঘটেছিল। নবাব নিজে ক্বাসিদা রচনা করতেন। আহসান উল্লাহর রচিত উর্দু কাব্যগ্রন্থ কুল্লিয়াতে শাহীন-এ বেশ কিছু ক্বাসিদা স্থান পেয়েছে।

এ ছাড়া বাংলার সুবাদার ইসলাম খাঁর সেনাপতি মির্জা নাথনের মোগল অভিযানের বর্ণনামূলক গ্রন্থ বাহারিস্থান-ই-গায়েবীতেও মোগল পৃষ্ঠপোষকতায় ক্বাসিদা চর্চার উল্লেখ রয়েছে।

বর্তমানে পুরান ঢাকায় কোথাও কোথাও উর্দু ক্বাসিদা গাওয়ার প্রচলন থাকলেও নবাবি আমলে চলত ফারসি ক্বাসিদা। ক্বাসিদা গাওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাকরণ, উচ্চারণ, সুর, তাল, লয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ক্বাসিদা গায়কেরা পাক-পবিত্রতা,আদবের সঙ্গে গান পরিবেশন করে থাকেন। রমজানে ঢাকার কোথাও কোথাও বিভিন্ন ব্যক্তির আয়োজনে ক্বাসিদা প্রতিযোগিতা আয়োজনের কথা শোনা যায়।

অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের ঢাকা: স্মৃতি-বিস্মৃতির নগরীর গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে, ১৯৪৭-এর পর উদুর্ভাষী মোহাজেররা ঢাকায় এসে ক্বাসিদায় নতুন মাত্রা যোগ করেন। পুরান ঢাকার মহল্লায় মহল্লায় ভোররাতে ক্বাসিদা গায়কেরা বেরিয়ে পড়তেন। গান গেয়ে ঘুম ভাঙাতেন। এটিকে তাঁরা সওয়াবের কাজ মনে করতেন। আর ঈদের দিন মহল্লায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে নজরানা নিয়ে আসতেন।

তবে ঢাকায় রমজানের সময় কবে, কখন থেকে ক্বাসিদার প্রচলন শুরু হয়, তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। ধারণা করা হয়, মোগল আমলে শুরু হলেও ইংরেজ আমলে এসে তা লুপ্ত হয়ে যায়। তবে হাকিম হাবিবুর রহমানের বর্ণনা থেকে ধারণা করা যায়, বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে তার প্রচলন ঘটে।

পাঁচ রকমের ক্বাসিদার কথা বিভিন্ন বইপত্রে উল্লেখ আছে। এগুলো হলো :
(১) চানরাতি আমাদ, (২) খুশ আমদিদ, (৩) আলবিদা, ( ৪) ঈদ মোবারক ও (৫) বিশেষ ক্বাসিদা।
রমজান শুরুর পর এর ফজিলত বর্ণনা করে যে ক্বাসিদা পরিবেশন করা হতো,তার নাম ‘চানরাতি আমাদ’। প্রথম ১৫ রোজা পর্যন্ত রোজাকে খোশ আমদিদ জানিয়ে গাওয়া হতো ‘খুশ আমদিদ’। তারপর ‘আলবিদা’ বা বিদায় চলত ২৭ রোজা পর্যন্ত। ঈদের পরদিন গাওয়া হতো ‘ঈদ মোবারক ক্বাসিদা’। ‘বিশেষ ক্বাসিদা’ও  পরিবেশিত হতো জনপ্রিয় সিনেমার গান থেকে।

একেক ক্বাসিদা একেক সুরে গাওয়া হয়। শাহেদি, মার্সিয়া, না’ত-এ রাসুল, ভৈরবী, মালকোষ প্রভৃতি রাগে এর সুর প্রয়োগ করা হয়। অধিকাংশ ক্বাসিদার সুর তৎকালীন ছায়াছবির গান থেকে নেওয়া। ক্বাসিদা মূলত কোরাস সহকারে গাওয়া হয়। যেখানে সাত থেকে আটজন তালিমপ্রাপ্ত গায়ক সম্মিলিতভাবে অংশ নেন। তাঁদের মাঝে যিনি ‘সালারে কাফেলা’, তিনি সংগীত রচনা, সুর প্রয়োগ ও উপস্থাপনার পাশাপাশি দল পরিচালনার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখেন। ভণিতায় রচয়িতার নাম উল্লেখ থাকে। যাঁরা ক্বাসিদার গান রচনা করেন, তাঁদের বলা হয় কাসেদ।

কয়েক রকমের ক্বাসিদার উদাহরণ:-
(১) চানরাতি আমাদ
চাওদ উই তারিখ কা হ্যায় চান্দ ইয়ে রামাজান কাদখলো ইয়ে বাহাসে রাহাত হ্যায় জিসমো জানকা
পাঁচ ওয়াক্ত কা মোমেনা পড়তে রাহো হারদাম নামাজ  দহান তুমকো হ্যায় আগার কুচ দিন কা ইমান কা
(সময়কাল: ১৯৫০, রচনা: এজাজ, সুর: শাহেদী, কণ্ঠ: মো. জুম্মন মিয়া)
অথবা
আ গায়া অ্যায় সামোয়া মাহে মোবারক আ গায়া
ছা গায়া সারি ফিজা পার নূর বানকার ছা গায়া
(সময়কাল: ১৯৪৮, রচয়িতা: এজাজ, সুর: কাওয়ালি, কণ্ঠ: মো. জুম্মন মিয়া)

(২) খুশ আমদিদ
খুশ আমদিদ খোশকে লাব পার আবরে রাহমাত খোদ নিসাওয়ার হো গায়া
মারাতাবে মাহে কারামসে দেকতেহি আজ হামৃ
(সময়কাল: ১৯৪৮, রচয়িতা: মুনসেফ, কণ্ঠ: মো. জুম্মন মিয়া)

(৩) আলবিদা
অ্যায় মাহে মোবারাক মাহে কারাম
যানেকা আভি সামান নাহ্ কার
(সময়কাল: ১৯৫৫, রচয়িতা: এজাজ, সুর: কাওয়ালি, কণ্ঠ: মো. জুম্মন মিয়া)

(৩) সাহরির ক্বাসিদা
আল্লাহকা বান্দেকো হাম আয়ো জাগানেকো
হার দিলমে রামজানকি পায়গাম পাওচায়ঙ্গে
(সময়কাল ১৯৫০-৫৫, রচয়িতা: আনোয়ার হোসেন, সুর: হিন্দি দার্দ ছায়াছবির গানের সুরের অনুকরণে, কণ্ঠ: আনোয়ার হোসেন)

(৪) ঈদ মোবারক
লুটল অ্যায় সাযয়োমো মারাকানা ইল্লাল্লাহাকা
ঈদকি দিন হ্যায় পিও পায়মানা ইল্লাল্লাহাকা
(সময়কাল: ১৯৪৮, রচয়িতা: মুনসেফ, সুর: কাওয়ালি, কণ্ঠ: মো. জুম্মন মিয়া)

ক্বাসিদাশিল্পী ও ক্বাসিদার পৃষ্ঠপোষকতা
উনিশ শতকের শেষ দিক থেকে এ পর্যন্ত এই অঞ্চলে অনেকেই ক্বাসিদা রচনা করেছেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন মুনসেফ, এজাজ, হামিদ-এ-জার, হাফেজ দেহলভি, জামাল মাশরেকি, তালিব কবির, মুজিব আশরাফি, সারওয়ার, শওকত প্রমুখ। পুরান ঢাকার লালবাগ এলাকায় এখনো স্বল্প পরিসরে ক্বাসিদা গাওয়ার প্রচলন রয়েছে। এ ক্ষেত্রে একজনের বিশেষভাবে নাম উল্লেখ করতে হয়। তিনি আমলীগোলার শিল্পপতি আনোয়ার হোসেন। ঢাকার ইতিহাসের আকর গ্রন্থ কিংবদন্তির  লেখক নাজির হোসেনের ছোট ভাই তিনি। 

আনোয়ার হোসেন নিজেও ক্বাসিদার সুর করেন; কণ্ঠ দেন। ক্বাসিদার পৃষ্ঠপোষকতা, সুর ও কণ্ঠে আরও যাঁদের অবদান রয়েছে, তাঁরা হলেন বকশীবাজারের মো. জুম্মন মিয়া (১৯৩৭), উর্দু রোডের মঞ্জুর আলম (১৯৪৪), বকশীবাজারের মানিক চান (১৯৫২), হোসেনি দালানের সৈয়দ ফসিহ হোসেন (১৯৫৬) প্রমুখ। তাঁদের অধিকাংশ ব্যবসায়ী হলেও অনেকে এখনো ক্বাসিদার সঙ্গে যুক্ত আছেন। কেউ সুরের মাধ্যমে, কেউ কণ্ঠ দিয়ে, কেউ সালারে কাফেলা হিসেবে, কেউ প্রতিযোগিতার আয়োজক বা বিচারকের দায়িত্ব পালন করে ক্বাসিদাকে বাঁচিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্বাসিদার রূপও যেন পাল্টে গেছে। ক্বাসিদা কেন হারিয়ে যাচ্ছে— এটা খুবই দুঃখজনক। আমরা আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে বিসর্জন দিচ্ছি। আমরা শেকড়কে ভুলে থাকছি। শিল্পপতি আনোয়ার হোসেনের পরিবারের পৃষ্ঠপোষকতায় ঢাকার হারিয়ে যাওয়া ক্বাসিদা নামে একটি বইও রচনা করা হয়েছে। 

পুরান ঢাকার প্রতিটি মহল্লার বিশিষ্টজনদের উচিত স্বল্প পরিসরে হলেও ক্বাসিদা টিকিয়ে রাখা। ক্বাসিদা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা, যাতে নতুন প্রজন্ম জানতে পারে তাদের পূর্বপুরুষের ইতিহাস।
এএইচ/এসএ/