ঢাকা, শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

যদি সেই বীভৎস ভিডিও বের না হতো...

মো. আনোয়ার হোসেন শামীম

প্রকাশিত : ০৭:৩৬ এএম, ৩০ মে ২০২১ রবিবার

গত ২৬ মে সন্ধ্যায় এক ফেসবুক বন্ধু আমাকে মেসেঞ্জারে ভিডিওটি পাঠান। সাথে লিখে দেন, পারলে আমি যেন ভিডিওতে থাকা নরপশুদের উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করি। প্রথমে আমি অতটা গুরুত্বও দেইনি। ভেবেছিলাম জায়গাজমির বিরোধ নিয়ে মারপিট টাইপ কিছু একটা হবে হয়তো। এমন ভিডিও মোবাইলে প্রতিদিন ১০/২০টা আসেই!

কিন্তু ভিডিও চালু করার পর একের পর এক যেসব দৃশ্য ভেসে আসছিল, আমি নিজের চোখকেও বিশ্বাস করাতে পারছিলাম না। এত নির্মমতা, এত নিষ্ঠুরতা সংঘটিত করা কোনও মানবসন্তানের পক্ষে আদৌ সম্ভব কি! মনে মনে খুব করে চাচ্ছিলাম, এটা যেন কোনও বাস্তব ঘটনা না হয়ে মেকিং টাইপ কিছু একটা হয়। বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, দেখতে গিয়ে তিন-তিনবার আমার হাত থেকে মোবাইল পড়ে যায়। আমার হাত কাঁপছিল, আমি মানসিকভাবে অসুস্থ বোধ করছিলাম। অনেক চেষ্টা করেও পুরো ভিডিওটি আর দেখা শেষ করতে পারিনি। যতটুকুই দেখেছি, পরপর দুই রাত আমার ঠিকমতো ঘুম হয়নি।

যা হোক, ভিডিওটি ভাইরাল হবার পর ভারতীয় পুলিশ তৎপর হয়। বাংলাদেশ পুলিশের পক্ষ থেকে ভারতীয় পুলিশের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রেখে গ্রেফতারের বিষয়টি ত্বরান্বিত করার চেষ্টা করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ব্যাঙ্গালুরুতে ৬ জন অভিযুক্ত গ্রেফতার এবং সে সূত্রে পলায়নরত অবস্থায় দুই জন পায়ে গুলিবিদ্ধ হন। নির্যাতনের শিকার তরুণীকেও কেরালা থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। 

এদিকে ঘটনার অন্যতম হোতা টিকটক হৃদয়ের বিরুদ্ধে ধর্ষিতার বাবা বাদী হয়ে ঢাকার মগবাজার থানায় মামলা দায়ের করেন। আশা করছি, ইনশাআল্লাহ, ভিকটিম ন্যায়বিচার পাবেন।

কিন্তু পুরো ঘটনাপ্রবাহ জুড়ে একটি বিষয়ই বারবার আমার মাথায় ঘুরপাক খেয়েছে- কী হত, যদি ভিডিওটি প্রকাশ না পেত? যদি কেউ ভিডিওটি ধারণ না করতেন এবং অন্তর্জাল জগতে ছেড়ে না দিতেন তাহলে কি ভিকটিম তরুণী এর কোনও বিচার পেতেন? কারণ, আমার মনে হয়, তিনি হয়তো কোনও থানায় কিংবা আদালতে বিচারপ্রার্থীই হতেন না, এমনকি কাউকে জানাতেনও না। কেউ কোনদিন  জানতেও পারতেন না, পৃথিবী নামক গ্রহের কোনও এক কোনে চার দেয়ালের মধ্যে জঘন্যতম এই অন্যায়কার্যটি সংঘটিত হয়েছিল। ভিকটিম তরুণীর সকল বুকফাটা আর্তনাদ কংক্রিটের দেয়ালে মৃদু প্রতিধ্বনি তুলেই হয়তো হারিয়ে যেত চিরদিনের মত। 

তাহলে প্রতিনিয়তই কি বিশ্বজুড়ে এমন অজস্র নির্মমতা ঘটে চলেছে অলক্ষে, যা ভিডিও বের না হওয়ায় আমরা দেখি না! ভিকটিমও লোকলজ্জায় আভিযোগ দেন না! কী ভয়ংকর বিষয়, তাই না? সবাইকে বলব, সচেতন হতে, সচেতন করতে। আপনার আমার বোন-বান্ধবী-স্বজনদের কেউ কোনদিন এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হবেন না- কে হলফ করে বলতে পারে! বন্ধ হোক নারী পাচার, বন্ধ হোক নির্মমতা।

আর একটি অনুরোধ- অন্তত মেয়েটির সামাজিক অবস্থান এবং ভবিষ্যত জীবনের কথা ভেবে হলেও দয়া করে এই মুহূর্ত থেকে ভিডিওটি শেয়ার এবং ইনবক্স করা বন্ধ করুন। অন্তত ফেসবুকে আমার সাথে যারা বিভিন্নভাবে যুক্ত আছেন, আপনাদের কাছে আমার বিনীত আরজ- প্লিজ ভিডিওটি চালাচালি বন্ধ করার পাশাপাশি নিজ মোবাইল থেকেও এটি মুছে ফেলুন, আশপাশের সবাইকেও অনুরোধ করুন, যেন তারাও তাদের মোবাইল থেকে এটি মুছে ফেলেন। 

ভয় হচ্ছে- বিকৃত ধর্ষণের দৃশ্য ভাইরাল হবার পর মেয়েটি এই দেশে আবারও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন তো! যদি না পারেন, তাহলে এর শেষ পরিণতি কি হতে পারে! দয়া করে মেয়েটিকে বাঁচতে দিন।

লেখক- বিসিএস (পুলিশ), এএসপি (রাঙ্গুনিয়া সার্কেল), চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ।

এনএস/