ঢাকা, শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ৬ ১৪৩১

বর্ষা দিনের গান

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১২:৩১ পিএম, ১৫ জুন ২০২১ মঙ্গলবার | আপডেট: ১২:৩৭ পিএম, ১৫ জুন ২০২১ মঙ্গলবার

‘এই মেঘলা দিনে একলা/ঘরে থাকে না তো মন/ কাছে যাব, কবে পাব/ওগো তোমার নিমন্ত্রণ’- বর্ষাকে নিয়ে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া এ এক চমৎকার জনপ্রিয় গান। গানটি অনেক পুরনো। তবে সব সময়ই সমান জনপ্রিয়। বর্ষাকে নিয়ে এমন অনেক বাংলা গান রয়েছে যা মানুষের মনে দোলা দেয়। সে মাতাল হয়ে যায় সুরের ধারায়। এর একটা কারণ অবশ্য রয়েছে। বর্ষা এমনই এক ঋতু যার রিমঝিম ছন্দ কানে বাজার সঙ্গে সঙ্গে হৃদয়ের স্পন্দন সুরের মায়া খেলে। আর এ জন্যই কালে কালে গীতি কবিরা লিখে গেছেন বর্ষার গান। বাংলা সঙ্গীত ভুবনে বর্ষাকে নিয়ে এমন অসংখ্য গান রয়েছে। সেই সব গানের মধ্য থেকে কিছু জনপ্রিয় গান নিয়ে আজকের এই প্রতিবেদন। লিখেছেন- সোহাগ আশরাফ 

 

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীত ও কবিতার ভাষায়- ‘নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে/ওগো আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে/বাদলের ধারা ঝরে ঝরো ঝরো ঝরো, আউশের ক্ষেত জলে ভরো ভরো/কালিমাখা মেঘে ওপারে আঁধার ঘনিয়েছে দেখ চাহি রে...’।

রবীন্দ্রসাহিত্যে, কাব্যে আষাঢ়-শ্রাবণ এই দু’মাস অর্থাৎ বর্ষাকাল গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। রবীন্দ্রগানে আরো আছে ‘বজ্রমানিক দিয়ে গাঁথা, আষাঢ় তোমার মালা/তোমার শ্যামল শোভার বুকে বিদ্যুতেরই জ্বালা...।’

রবীন্দ্রনাথ বর্ষাপ্রকৃতির বিচিত্র রূপসজ্জার ছবি অত্যন্ত নিপুণ হাতে এঁকেছেন। তাঁর ‘মানসী’ কাব্যের ‘বর্ষার দিনে’ ও ‘মেঘের খেলা’ দু’টি কবিতাই ‘বর্ষা’। ‘বর্ষার দিনে’র প্রথম তিনটি স্তবক তিনি সুরারোপ করে গানেও রূপান্তর করেছেন। ‘বর্ষার দিনে’ কবিতার এ তিন স্তবক হলো-
এমন দিনে তারে বলা যায়,
এমন ঘন ঘোর বরিষায়।
এমন মেঘস্বারে বাদল-ঝরঝরে
আপনহীন তমসায়।

এমনি আরো গান, কবিতা গদ্যে বিধৃত হয়েছে বর্ষার বন্দনা।

শুধু রবীন্দ্রনাথই নন, বাংলা সাহিত্যের খ্যাত-অখ্যাত বহু কবিই বর্ষা রূপ ঐশ্বর্যে মোহিত মুগ্ধ, বর্ষা আবাহনে উচ্ছ্বসিত এবং মুখর। 

জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের কাছে বর্ষাকে মনে হয়েছে ‘বাদলের পরী’। তিনি লিখেছেন- ‘রিমঝিম রিমঝিম ঘন দেয়া বরষে/কাজরি নাচিয়া চল, পুর-নারী হরষে…।’

জাতীয় কবি কাজী নজরুলের কবিতায় বর্ষা যেন প্রেম আর বিরহের উৎসারক। কে ভুলতে পারে সেই অমর গান—
শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে/বাহিরে ঝড় বহে... নয়নে বারি ঝরে।
ভুলিও স্মৃতি মম নিশিথ স্বপন সম/ আঁচলের গাথা মালা ফেলিও পথ পরে
বাহিরে ঝড় বহে... নয়নে বারি ঝরে।

আবার শাওন রাতে প্রিয়তমকে মনে করে কবি গেয়েছেন—
এ ঘোর শ্রাবণ-নিশি কাটে কেমনে।/হায়, রহি রহি সেই পড়িছে মনে॥
বিজলিতে সেই আঁখি/ চমকিছে থাকি থাকি,/ শিহরিত এমনই সে বাহু-বাঁধনে॥

অসম্ভব রকমের বর্ষাপ্রীতি ছিলেন দেশের জননন্দিত কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ। তিনি তার অনেক লেখাতেই বৃষ্টির বন্দনা করেছেন খুবই রোমান্টিকভাবে। গাজীপুরের পিরুজালির নুহাশপল্লীতে বসে লিখেছেন-

‘যদি মন কাঁদে তুমি চলে এসো এক বরষায়’।

এই গানটি তিনি লিখেছিলেন কোনো এক বর্ষার দিনে এবং কোনো এক বর্ষার রাতে। তিনি আরও লিখেছেন-

বাদলা দিনে মনে পড়ে ছেলেবেলার গান
বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদে এলো বান
যদি ডেকে বলি, এসো হাত ধরো
চলো ভিজি আজ বৃষ্টিতে
এসো গান করি মেঘো মল্লারে
করুনাধারা দৃষ্টিতে।

হুমায়ূন আহমেদের আরেকটি গান- ‘বরষার প্রথম দিনে ঘন কালো মেঘ দেখে, আনন্দে যদি কাঁপে তোমার হৃদয়, সেদিন তাহার সাথে করো পরিচয়।’ 

বর্ষা নিয়ে লতা মুঙ্গেশকরের গাওয়া ‘আষাঢ় শ্রাবণ মানে না তো মন/ঝর ঝর ঝর ঝর ঝরেছে/তোমাকে আমার মনে পড়েছে’- গানটি সবার কাছে বেশ জনপ্রিয়।

আষাঢ় ও কার্তিক মাসের কথা উঠলেই মনে পড়ে উকিল মুনশির কথা। হাওরাঞ্চলে যিনি ‘বিরহী বাউল গাতক’ নামে সুপরিচিত। তার বহুল প্রচলিত গান-
আষাঢ় মাইস্যা ভাসা পানি রে
পুবালি বাতাসে-
বাদাম দেইখ্যা চাইয়া থাকি
আমারনি কেউ আসে রে।

সতিনাথ মুখার্জির চমৎকার রোমান্টিক গান-
আকাশ এতো মেঘলা যেও নাকো একলা
এখনি নামবে অন্ধকার
ঝড়ের জল-তরঙ্গে নাচবে নটি রঙ্গে
ভয় আছে পথ হারাবার।।

দেশের প্রখ্যাত শিল্পী রুনা লায়লার গাওয়া-
এই বৃষ্টি ভেজা রাতে চলে যেও না
বৃষ্টির ছন্দে বকুলের গন্ধে
আমায় তুমি ফেলে যেও না।

এছাড়া শিল্পী নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরীর- ‘আজ এই বৃষ্টির কান্না শুনে, মনে পড়লো তোমায়।’ 

লীলাময় পাত্রের লেখা এবং শ্রীকান্ত আচার্যের গাওয়া- ‘আমার সারাটা দিন মেঘলা আকাশ।’

শিল্পী হৈমন্তীর গাওয়া- ‘ওগো বৃষ্টি আমার চোখের পাতা ছুঁয়ো না।’ শিল্পী তৌসিফের- ‘বৃষ্টি ঝড়ে যায়, দু’চোখে গোপনে।’ 

তরুণ প্রজন্মের সঙ্গীত শিল্পী কণার গাওয়া-
মেঘের গায়ে, নূপুর পায়ে, নাচে বরষা
বৃষ্টি কি তার ছন্দ জেনেছে
শ্রাবণ কি তার মন্ত্র বলেছে
দু’হাত তুলে কোমল সুরে
ডাকে কুয়াশা ভেজে বরষা। 

জলের গানের গাওয়া বৃষ্টি নিয়ে জনপ্রিয় একটি গান-
বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদেয় এলো বান,
বানের জলে ভাসলো পুকুর ভাসলো আমার গান।
বন্ধু আইসোরে...
কোলেতে বসতে দেবো, মুখে দেবো পান। 
অন্যতম জনপ্রিয় বর্ষার গান। বর্ষা নিয়ে কত গল্প, ছড়া, কবিতা, গান আছে তার কোন হিসেব নেই।

আদিকাল থেকেই বৃষ্টির সাথে সবার প্রেম। বৃষ্টি অনেকের কাছে প্রথম প্রেমিক, প্রথম প্রেমিকা। বাঙ্গালীর অনেক রোমান্টিক স্মৃতির সাক্ষী এই বৃষ্টি। নগর জীবনে ছুটে চলা ব্যস্ত মানুষটাও বর্ষার দিনে আকাশের দিকে তাকায়। তাকিয়ে একবারের জন্যে হলেও তার প্রিয় বর্ষার গানটি গুনগুন করে। আর কে না জানে বর্ষা উদযাপনে প্রধান উপকরণ বর্ষার গান। 

এসএ/