ঢাকা, মঙ্গলবার   ০৮ অক্টোবর ২০২৪,   আশ্বিন ২৩ ১৪৩১

করোনা মোকাবেলায় প্রয়োজন সঠিক খাদ্যাভ্যাস

শামসুন নাহার স্মৃতি

প্রকাশিত : ০৮:৩৭ এএম, ১ জুলাই ২০২১ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ০১:৩৮ পিএম, ২৪ জুলাই ২০২১ শনিবার

দিনকে দিন বেড়েই চলছে করোনা ভাইরাসের প্রকোপ। একইসঙ্গে চলছে ভাইরাসটির দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলার প্রস্তুতিও। করোনা প্রতিরোধে ধাপে ধাপে দেয়া হচ্ছে লকডাউন। নেয়া হচ্ছে বিভিন্ন ধরণের বিধিনিষেধ। যতই লকডাউন দেয়া দেয়া হোক না কেন, আমরা নিজেরা যদি সচেতন না হই, এই মহামারি ঠেকানো যাবে না কোনওভাবেই। 

বিভিন্ন ধরণের ভাইরাস প্রতিরোধে রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা এক অনন্য ভূমিকা পালন করে। তাই করোনা ভাইরাস প্রতিরোধের প্রথম ধাপ হলো- ব্যক্তিগত সচেতনতা গড়ে তোলা এবং সঠিক সুষম খাদ্যাভাসে প্রত্যেকের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করা। এর ফলে করোনা ভাইারাস সংক্রমণের যে মারাত্মক লক্ষণ, যেমন- শ্বাসযন্ত্র এবং পরিপাকতন্ত্রের সংক্রমণ সহজে প্রতিরোধ করা সম্ভব। তাই রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে আ্যন্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার খেতে  হবে প্রতিদিন। 

আ্যন্টিঅক্সিডেন্ট হলো- ভিটামিন, মিনারেল ও এনজাইম-এর সমন্বয়, যা শরীরের ক্ষতিকর ফ্রি র‌্যাডিকেলের বিরুদ্ধে লড়াই করে শরীরকে সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করে। রোগ প্রতিরোধক প্রধান আ্যন্টিঅক্সিডেন্ট হলো- বিটা ক্যারোটিন, ভিটামিন এ, সি, লাইকোপেন, সেলেনেয়িাম ইত্যাদি। 

গাঢ় ও উজ্জল রং-এর শাক-সবজি ও ফলমূলে রয়েছে পর্যাপ্ত পরিমাণে আ্যন্টিঅক্সিডেন্ট। তাই করোনাকালীন ভাইরাস প্রতিরোধে স্বাস্থ্যকর ও পুস্টিকর খাবারের সমন্বয় যেন থাকে প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায়। আমাদের প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় খাদ্য উপাদানের ৬টি পুষ্টি উপাদানই যেন পর্যাপ্ত পরিমাণে উপস্থিত থাকে এবং এর সাথে অবশ্যই প্রতিদিন ৮-১০ গ্লাস বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে।

আ্যন্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার
আমাদের দৈনিক খাদ্য তালিকায় পর্যাপ্ত পরিমাণে আ্যন্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার-এর সমারোহ ঘটাতে হবে সঠিক পরিমাণে। প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় লাল, বেগুনী, নীল, সবুজ, কমলা ও হলুদ রং-এর শাক সবজি ও ফলমূল যেন থাকে পর্যাপ্ত পরিমাণে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। করোনার এই সময়ে যেন প্রাতিদিনের খাদ্যে তালিকায় শাক সবজি হিসেবে করলা ভাজি, ঢেঁড়স ভাজি ও পাচঁ মিশালি সবজি,  টমেটো, ব্রোকলি, বিট কপি, গাজর, মিষ্টি আলু, লাল, হলুদ, সবুজ রং-এর ক্যাপসিকাম, লাল শাক, পালং শাক ইত্যাদি খাদ্য উপাদানের যেন সমারোহ থাকে। 

দৈনিক খাদ্য তালিকায় আ্যন্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ ফলের সমারোহ যেন থাকে পর্যাপ্ত পরিমাণে, যেমন- খাদ্য তালিকায় পাকা আম, মাল্টা, পাকা পেঁপে, লাল ও সবুজ আঙুর, আনার, তরমুজ, কালোজাম, কমলা লেবু, ইত্যাদি গাঢ় ও উজ্জল রং-এর ফলমূল।

ভিটামিন-সি যুক্ত খাবার
ভিটামিন সি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে অন্যতম ভূমিকা পালন করে। পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন সি গ্রহণে সর্দি, কাশি, ঠাণ্ডা, প্রদাহ জনিত সংক্রমণ রোগ থেকে শরীরকে সুস্থ রাখতে সাহয্য করে। এই করোনা নামক মহামারি ঠেকাতে ভিটামিন সি-এর কোনও বিকল্প নেই। তাই আমাদের প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় যেন পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন সি যুক্ত খাবার থাকে। যেমন- আমলকি, লেবু, কমলা, সবুজ শাক-সবজি, করলা, সবুজ রং-এর কাচা মরিচ। আর কিছু না হলেও প্রত্যেকের খাদ্য তালিকায় যেন অন্তত এক টুকরা করে লেবু থাকে।

ভিটামিন এ যুক্ত খাবার
আ্যন্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ ভিটামিন এ যুক্ত খাবার ইমিউনিটি বুষ্ট করে। যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলে খুব সহজেই। তাই উজ্জল ও গাঢ় রং-এর খাবার, যেমন- কুসুমসহ ডিম, লাল, হলুদ, কমলা ও বেগুনী রং-এর খাদ্য উপাদানগুলো যেন খাদ্য তালিকায় পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকে। এখন পাকা আম ও কাঠালের সময়। তাই এই সময়ে আমাদের প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় যেনও অন্তত ১টি পাকা আম এবং পরিমিত পরিমাণে কাঠালের কোষ থাকতে পারে। তবে কারো যদি ব্লাড সুগার বেশী থাকে অথবা ইলেট্রোলাইট-এর অসামঞ্জস্য থাকে বা কিডনি রোগ থাকে, তাদেরকে পুষ্টিবিদের পরামর্শে পরিমিতভাবে ফল দুটি গ্রহণ করতে হবে।

ভিটামিন ই যুক্ত খাবার
এই মহামারি ঠেকাতে ভিটামিন ই যুক্ত খাবার শরিরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তুলতে পারে দ্বিগুণভাবে। তাই এই সময়ে আমাদের খাদ্য তালিকায় ভিটামিন ই যুক্ত কাঠ বাদাম, চিনা বাদাম, পেস্তা বাদাম, অলিভ ওয়েল, জলপাই-এর আচার, সবুজ রং-এর বিভিন্ন ধরনের শাক ইত্যাদি রাখতে হবে।

প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে উচ্চমানের প্রোটিনের বিকল্প নাই। প্রথম শ্রেণির প্রোটিন ভিআই-বি৬, ভিআই১২ ও জিংক সমৃদ্ধ হওয়ায় আমাদের শরীরের জীবাণুর বিরূদ্ধে লড়াইয়ের জন্য অনেক প্রয়োজনীয় যৌগ তৈরী করে। শরীরের রোগ প্রতিরোধক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে উচ্চমানের প্রোটিন। দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার গ্রহণে ক্ষতিগ্রস্ত কোষ ও টিস্যু দ্রুত সুস্থ হয়ে যায় এবং নতুন টিস্যু তৈরিতে সাহায্য করে। তাই এই মহামারি ঠেকাতে প্রতিদিনের খাদ্যে অন্তত ১টি ডিম, ১ গ্লাস দুধ বা দুগ্ধ জাতীয় খাবার মাছ, মাংস, ডাল ও ডাল জাতীয় খাবার, সামুদ্রিক মাছ, মাশরুম, বাদাম ইত্যাদি যেন থাকে।

সরল ও জটিল সর্করা ও শষ্য জাতীয় খাবার
ইদানিংকালের হাল ফ্যাশন হচ্ছে- নো কার্ব ডায়েট, যা শরীরের জন্য মোটেও সুফল বয়ে আনে না। কারণ খাদ্য উপাদানের মধ্যে শর্করা খাদ্য উপাদানটি ছাড়া ইমিউনিটি বুষ্টকারী খাবারের ঘাটতি থেকেই যাবে। অর্থাৎ অপরিহার্য এই খাদ্য উপাদানটি ছাড়া শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো অসম্ভব। তাই যারা কার্বোহাইড্রেটকে সম্পূর্ণ বাতিলের খাতায় রেখেছিলেন এতদিন, তাদের উদ্দেশ্যে বলছি- রোগ প্রতিরোধ  ক্ষমতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে ভিটামিন বি১, বি২, বি১২, বি৬, জিংক সমৃদ্ধ চাল, আটা, গম, ওটস, বিচি ও বিচি জাতীয় খাবারের বিকল্প নাই। তাই আমাদের প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় যেনও পর্যাপ্ত পরিমাণে ভাত, রুটি, ওটস, চিড়া, মুড়ি ইত্যাদি যেন থাকে।

এছাড়া রোগ প্রতিরোধক হিসেবে বিভিন্ন ধরণের মসল্লার বিকল্প মেলা ভার। যেমন- আদা, রসুন, হলুদ, দারুচিনি, লবন, গোলমরিচ, কালোজিরা ইত্যাদি। সাধারণত বাসায় নিজেদের নিত্যদিনের রান্নায় এইসব মসল্লার সমারোহ থাকে পর্যাপ্ত পরিমাণে। এছাড়া ঠাণ্ডা, সর্দি-কাশিতে আদা, লবঙ্গ, তেজপাতা, দারুচিনি, দিয়ে মসল্লা চা খেলে খুব সহজেই এইসব সংক্রমণ রোগ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। 

এছাড়া প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় এক কাপ অথবা দুই কাপ গ্রীন-টি রাখা যেতে পারে লেবু ও পুদিনা পাতা দিয়ে। এতে করে শরীরের ইমিউনিটি পাওয়ার আরও সমৃদ্ধশালী হবে।

পানি
এই করোনাকালে শরীর যেনো পানিশূন্য না হয়ে যায়, আবার পানি বাহিত কোনও রোগও যেন বাসা না বাধে শরীরে, সেই দিকে খেয়াল রাখতে হবে। একজন সুস্থ ও প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের কমপক্ষে ৮/১০ গ্লাস বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে। এছাড়া বিভিন্ন ধরণের মৌসুমি ফলের জুস কিংবা কচি ডাবের পানি পান করা উচিত, যাতে করে শরীরে পুষ্টিগুণের পাশাপাশি শারীরিক তাপমাত্রার ভারসাম্য রক্ষা হবে। এবং যতটা সম্ভব চিন্তা মুক্ত থাকতে হবে। দৈনিক পর্যাপ্ত পরিমাণে বিশ্রাম এবং ৭/৮ ঘণ্টা ঘুমাতে হবে।

যে সব খাবার খাওয়া নিষেধ
যে সব খাবার শরীরের উপকার না করে অপকারই বেশি করে সেইসব খাবার যতই পছন্দের তালিকায় থাকুক না কেন, এই মহামারি ঠেকাতে সেই সব খাবার ত্যাগ করাই শ্রেয়। এই সময়ে অতিরিক্ত চিনি ও  চিনি যুক্ত খাবার না খাওয়াই ভালো। এছাড়া বাইরের ফাষ্টফুড, জাং ফুড, সফট ড্রিঙ্কস, চিপস, স্ট্রিট ফুড  যেমন- চটপটি, ফুসকা, ঠাণ্ডা জাতীয় খাবার, যেমন- আইসক্রিম, অতিরিক্ত তেলে ভাজা পোড়া খাবার না খাওয়াই ভালো। কারণ এই সব খাবার শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তো বাড়াবেই না বরং শরীরে নানাবিধ রোগের সৃষ্টি করবে।

তাই আসুন, জোর করে কোনও লকডাউন না। সবার আগে মনের লকডাউন মেনে নেই অর্থাৎ ব্যক্তি বিশেষে আরও সচেতন হই, সুষম ও পুষ্টিকর ঘরের তৈরী খাবারে অভ্যস্থ হই এবং অস্বাস্থ্যকর খাবারকে না বলি। তবেই আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে এবং আমরা এই ভাবেই করোনা ভাইরাসের মোকাবিলা করতে পারব এবং অবশ্যই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে সাবধানতা অবলম্বন করে নিজে ও আপন জনের সুস্থতা নিশ্চিত করি।

লেখক- ক্লিনিক্যাল নিউট্রিশনিষ্ট এন্ড ডায়েটিশিয়ান, উত্তরা ক্রিসেন্ট হসপিটাল এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার, উত্তরা, ঢাকা।

এনএস/