ঢাকা, মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ১০ ১৪৩১

বেবী আপা স্মৃতিতে অম্লান

দুলাল আচার্য

প্রকাশিত : ১১:০৮ এএম, ২৪ জুলাই ২০২১ শনিবার | আপডেট: ১১:৩৩ এএম, ২৫ জুলাই ২০২১ রবিবার

আজ (২৫ জুলাই) সাংবাদিক ও সাহিত্যিক বেবী মওদুদের প্রয়াণ দিবস। জীবনের শেষ কয়েকটা বছর ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করে ২০১৪ সালের এই দিন মৃত্যুর কাছে হার মানেন তিনি।

সাংবাদিক, সাহিত্যিক, নারী নেত্রী, সাংস্কৃতিক কর্মী, সচেতন রাজনৈতিক কর্মী নানা অভিধায় তাকে মূল্যায়ন করা যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে অনার্সসহ মাস্টার্স করেছেন।

মুক্তিযুদ্ধের আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য হিসেবে ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। নব্বইয়ের দশকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলনেও সোচ্চার ছিলেন তিনি। কর্মজীবনে ‘সাপ্তাহিক ললনা’, ‘দৈনিক সংবাদ’, ‘দৈনিক ইত্তেফাক’, ‘দৈনিক মুক্তকণ্ঠ’ ও ‘বিবিসি’-তে কাজ করেছেন। বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার ‘বাংলা বিভাগ’টি গড়ে তুলেছেন তিনি। প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাকালীন প্রধান বার্তা সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বপালন করেছেন। ছিলেন শেখ রেহানা প্রকাশিত ও সম্পাদিত ‘সাপ্তাহিক বিচিত্রা’র ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকও। জীবনের শেষ দিকে বিডিনিউজটোয়েন্টিফোরডটকমের স্যোসাল এফেয়ার সম্পাদক ছিলেন। নবম জাতীয় সংসদের একজন সম্মানিত সদস্য হিসেবে জনপ্রতিধিত্ব করেছেন বেবী মওদুদ।

বেবী মওদুদ প্রচুর লেখালেখি করেছেন। তবে শিশুসাহিত্যিক হিসেবেই তাঁর খ্যাতি ব্যাপক। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো- মনে মনে (ছোট গল্প), শেখ মুজিবের  ছেলেবেলা, দীপ্তর জন্য ভালোবাসা, পবিত্র রোকেয়া পাঠ, টুনুর হারিয়ে যাওয়া, দুঃখ-কষ্ট ভালোবাসা, গণতন্ত্রের মানসকন্যা শেখ হাসিনা, শান্তুর আনন্দ, এক যে  ছেলে আনু, মুক্তিযোদ্ধা মানিক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও তার পরিবার, আমার রোকেয়া ও কিশোর সাহিত্য সমগ্র, নিবন্ধ সমগ্র ‘অন্তরে বাহিরে’।

বিচিত্রার কাজ করতে গিয়ে বেবী আপার কিছু লেখালেখির কাজ খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে আমার। আমি এসবে যুক্ত থাকতে পেরে এখনও গর্ববোধ করি। শিশুতোষ বই ‘দীপ্তর জন্য ভালোবাসা’ বেবী আপার ছোট ছেলে শফিউল হাসান দীপ্তর (আমাদেও পুটু মামা) জীবনের ছায়া অবলম্বনে। একজন প্রতিবন্ধী শিশুর বেড়ে ওঠার গল্প। লেখাটির প্রুফ দেখতে গিয়ে আমি অনেকবার কেঁদেছি। অটিজম শিশুদের নিয়ে ‘দীপ্তর জন্য ভালোবাসা’ বইটি ছোটদের জন্য অসাধারণ দৃষ্টান্ত। এক সময় দেখতাম বেগম রোকেয়ার নিজের লেখা এবং তাঁর সম্পর্কীয় রেফারেন্সের কয়েকটি বই বেবী আপা অফিসে পড়ছেন। আর প্রতিদিনই কিছু কিছু পয়েন্ট চম্পকদাকে (সাপ্তাহিক বিচিত্রার কর্মী) কম্পোজ করতে দিতেন। কিছুদিন পর দেখলাম এগুলো সংযুক্ত করে হয়ে গেল ‘পবিত্র রোকেয়া পাঠ’। বেগম রোকেয়াকে সহজভাবে উপলব্ধি করার একটা অসাধারণ পুস্তিকা।

বেবী আপা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রচুর কাজ করেছেন। বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীর প্রথম দিককার কাজগুলোতে তাঁর শ্রম খুব কাছ থেকে দেখেছি। এই কাজের সাথে আমাকেও যুক্ত করেছিলেন তিনি। বিচিত্রার শেষের পাতায় প্রতি সপ্তাহে বেবী আপার একটি নিয়মিত কলাম বের হতো। ‘অন্তরে বাহিরে’ নামে এই লেখাগুলো সঙ্কলিত হয়ে পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। যাতে বেবী আপার ব্যক্তি জীবনের ছায়া ছিল।

তাঁর সুদীর্ঘ কর্মময় জীবন মূল্যায়ন করার মতো সঠিক ব্যক্তি বা যোগ্য মানুষ আমি নই। তবে আমার কাছে তিনি ছিলেন একজন স্নেহময়ী মা, বড় বোনের প্রতীক। শেখ রেহানা সম্পাদিত সাপ্তাহিক বিচিত্রায় কাজ করতে গিয়ে বেবী আপাকে অনেক কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল আমার। একই সঙ্গে তাঁর স্নেহধন্য হওয়ায় অনেক স্মৃতিময় ঘটনায় নিজেকে সম্পৃক্ত করার সৌভাগ্য হয়েছিল। আজ বেবী আপা নেই কিন্তু তাঁকে ঘিরে অনেক কথা, অনেক স্মৃতি মনে পড়ছে। বিশেষ করে মনে পড়ছে ২০০৭ সালের ১৬ জুলাইর কথা। তখন বেবী আপা বিচিত্রার টিভি রুমে। সিএসবি চ্যানেলে সরাসরি শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার, আদালতে নেয়াসহ নানা দৃশ্য সম্প্রচার করছে। আদালত এলাকায় গাড়ি থেকে নামানোর সময় টানাহেঁচড়ার দৃশ্য টিভিতে দেখে বেবী আপা হাঁউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। প্রিয় বন্ধুর জন্য বন্ধুর এমন ভালবাসা ক’জনের থাকে জানি না? তবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য তাঁর দু’চোখ বেয়ে পানি ঝরছে! সেদিনের সেই দৃশ্য আজও বিস্মৃত।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর কাছে এক বড় আবেগের জায়গা ছিল। সুধাসদনকে মনে করতেন তাঁর সেকেন্ড হোম। প্রতিদিন সুধাসদনে যাওয়া যেন বেবী আপার রুটিন ছিল। 

সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় শেখ হাসিনার গ্রেফতারে তিনি প্রচণ্ডভাবে ভেঙ্গে পড়েন। নিঃসঙ্গ মনে হতো তাঁকে। অসহায়ের মতো বিচিত্রা অফিসে আসতেন। কারও সঙ্গে খুব একটা কথা বলতেন না। সময়টা এতটাই বৈরি ছিলো যে তখন আমাদের সবার মনেই এক অজানা আতঙ্ক। বিচিত্রা অফিসের চারদিকে সব সময়ই গোয়েন্দা বিভাগের লোকজন ঘুর ঘুর করত। অফিসে আসা-যাওয়ার মাঝেই বিষয়টা আমরা বুঝতে পারতাম। ইতোমধ্যে অনেক লেখক রহস্যজনক কারণে বিচিত্রায় লেখা বন্ধ করে দেন। এমনকি আয়ের উৎস যে বিজ্ঞাপন তাও অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছিল তখন। একদিন বেবী আপা বললেন, আর পারছি না। পত্রিকাটি বুঝি আর চালানো যাবে না। কোথায় পাব এত টাকা? সে বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর বিচিত্রা বন্ধ হয়ে যায়।

উল্লেখ্য, ১৯৯৮ সালের ১ অক্টোবর থেকে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাড়ি থেকে শেখ রেহানার সম্পাদনায় নতুনভাবে, নতুন ব্যবস্থাপনায় চলা শুরু হয় বিচিত্রার। একই বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর থেকে বেবী আপার প্রত্যক্ষ নির্দেশে বিচিত্রায় আমারও পথচলা। ২০০৭ সালের ওয়ান ইলেভেন সরকারের সময় পত্রিকাটি বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত বিচিত্রায় সহ-সম্পাদক ছিলাম আমি। 

এবারের বিষয়টি নিতান্তই আমার ব্যক্তিগত। সময়টা ২০০৯ সাল। খবর পাঠালেন আমি যেন তাঁর সঙ্গে দেখা করি। একদিন সন্ধ্যায় লালমাটিয়ার তখনকার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরডটকম অফিসে তাঁর সঙ্গে দেখা করলাম। তিনি আমাকে একটি খাম দিয়ে বললেন এটা রাখো, মাওলা ব্রাদার্স লেখক সম্মানী দিয়েছে। আমিতো অবাক! আমি যে বিষয়টা বুঝিনি বেবী আপা সেটা বুঝতে পারলেন। তিনি ড্রয়ার থেকে একটি বই বের করে বললেন নাও। দেখলাম মাওলা ব্রাদার্স থেকে প্রকাশিত ‘নি:সঙ্গ কারাগারে শেখ হাসিনার ৩৩১ দিন’ বইটি। বেবী আপা সম্পাদিত। বললেন এই বইয়ের প্রথমদিককার লেখাগুলো তোমার। উল্লেখ্য, বিচিত্রায় দিনলিপি কলামে প্রতিদিনকার ঘটনা লেখা হতো। গ্রন্থটিতে আমি ছাড়াও বেবী আপা এবং রঞ্জন দার (রঞ্জন সেন, একুশে টিভির প্রধান বার্তা সম্পাদক) লেখা ছিল।

প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে যুক্ত না হয়েও রাজনীতির মাঠ পর্যায়ের একজন কর্মীর মতোই কাজ করতেন তিনি। ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর বিএনপি-জামায়াতের দেশব্যাপী তান্ডব, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পর এবং সর্বোপরি ২০০৭ সালে ওয়ান ইলেভেন সময় শেখ হাসিনার গ্রেফতার আন্দোলনে দল তার নিরলস সংগ্রাম নানাভাবে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। তখন রাজনৈতিক কর্মী নয়, সংবাদকর্মী হিসেবে তার পাশে আমাদের কাজ করার সুযোগ হয়েছিল।

সীমিত আয় দিয়েও যে কিভাবে স্বাচ্ছন্দ্য জীবনযাপন করা যায়; এই বিষয়টি আমরা বিচিত্রার অনেকেই তাঁর ব্যক্তিগত জীবন থেকে শিক্ষা নিয়েছিলাম। সাদামাটা জীবন যে কতটা আনন্দের হতে পারে বেবী আপাকে দেখে সেটা উপলব্ধি করেছি। জীবনে যত বেশি চাহিদা থাকবে জীবন তত জটিল হবে। সুতরাং চাহিদাকে কমিয়ে এনে জীবনকে আরও স্বাচ্ছন্দ্যময় করে তোলা- বেবী আপার কাছ থেকে আমি এবং আমার মতো অনেকেই এ শিক্ষা পেয়েছিলাম। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এত কাছের আপনজন হয়েও তিনি রিক্সায় চড়তেন। একটা গাড়ি কেনার সাধ বা সাধ্য তখন তার ছিল না।

কর্মময় জীবনই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। সাংবাদিক-সাহিত্যিক বেবী মওদুদ তার স্বীয় কর্মের মাধ্যমেই বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল। তবে সাংবাদিক মহলে বেবী আপাকে নিয়ে উপলব্ধি ভাল-মন্দ মিলিয়েই। মনের দিক থেকে সহজ-সরল হলেও প্রচন্ড অভিমানী ছিলেন তিনি। অনেক ক্ষেত্রে তা ক্ষণস্থায়ী হলেও অন্যায় বা অনিয়মের সাথে আপোষ করতেন না কখনও। সে কারণে অনেকের বিরাগভাজনও ছিলেন। তবে আমি কাছ থেকে যে বেবী আপাকে দেখেছি সেই আপা একজন সৎ, নিষ্ঠাবান ও শ্রদ্ধাশীল আদর্শ। বেবী আপা, আমাদের যা শিখিয়েছেন তা আমরা নতুন প্রজন্মের সাংবাদিকরা কখনই ভুলব না। অন্যায়কে অন্যায়, অসত্যকে অসত্য বলার দৃঢ় সাহস আমরা তাঁর কাছে শিখেছি। আমার কাছে তার স্মৃতি আজও অম্লান। তাঁর ৭ম মৃত্যুবার্ষিকীতে প্রার্থনা- যেখানেই থাকুন ভাল থাকুন।
লেখক : সাংবাদিক

এসএ/এনএস//