ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ৫ ১৪৩১

ভুল বিনোদন!

পথচারী

প্রকাশিত : ০৮:৫৯ পিএম, ৬ আগস্ট ২০২১ শুক্রবার | আপডেট: ০৯:০১ পিএম, ৬ আগস্ট ২০২১ শুক্রবার

শহর কিংবা মফস্বল যেখানেই হোক, শিশুদের কাছে ভিডিও গেমস, কম্পিউটার গেমস, এসব বর্তমানে আমাদের অত্যন্ত আনন্দের এক পরিচিত জগৎ। সাথে টিভি তো আছে ঘরে ঘরেই। অনেক ব্যস্ত মা-বাবা-অভিভাবক আছেন, যারা তাদের সন্তানদের সময় দিতে না পারার ক্ষতিটুকু পুষিয়ে দিতে, কখনো-বা সন্তানের মন রাখতে, মান রাখতে কিংবা ভুলিয়ে রাখার চেষ্টায় নির্বিচারে টিভি দেখা আর গেমস নিয়ে সময় কাটানোর অবাধ স্বাধীনতা দিয়ে দেন।

আবার অনেক মা খাবার সময় মোবাইল দিয়ে সন্তানকে শান্ত রাখার চেষ্টা করেন। আর এভাবে এক সময় তারা আসক্ত হয়ে পড়েন। কিন্তু শিশু-মনস্তত্ববিদরা এ নিয়ে আমাদের জানাচ্ছেন ভয়াবহ সব তথ্য। করোনাকালীন এ সময়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ছাত্রছাত্রীরা নিজের অজান্তে বিনোদন করতে গিয়ে ভিডিও গেমস বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসক্ত হয়ে পড়ছেন।

করোনাকালে তরুণ প্রজন্ম সবচেয়ে বেশি যে কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার একটি হলো ভিডিও গেম আসক্তি। অনলাইন ক্লাসের সুবাদে হাতে স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট পাওয়ায় অনেক শিক্ষার্থীই পাবজি বা ফ্রি ফায়ারের মতো সহিংস ইন্টারনেট গেমে আসক্ত হয়ে পড়েছে। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, এসব গেম তাদের মনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, তাদের আগ্রাসী করে তুলছে। তাদের মধ্যে সৃষ্টি করছে অসহিষ্ণুতা, ঘৃণা, সহিংসতা ও অপরাধ প্রবণতা।

দীর্ঘসময় গেমিংয়ে হাত ও কনুইয়ের পেশী ও পেশীবন্ধনীতে ব্যথা ও প্রদাহ সৃষ্টি হয়, যা চলতে থাকলে একটা সময় দুর্বলতা ও অসাড়তাসহ স্থায়ী জখম হতে পারে। ব্যথা হতে পারে কাঁধ, ঘাড় ও পিঠেও। গেমাররা কারপেল টানেল সিন্ড্রোমেও বেশি ভোগেন, যার ফলে কব্জিতে ব্যথা ও অসাড়তা দেখা দেয়। চোখ জ্বালাপোড়াসহ দৃষ্টিজনিত সমস্যাগুলোও গেমারদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। একটানা অনেকক্ষণ স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকার কারণে অনেকেই আক্রান্ত হয় কম্পিউটার ভিশন সিনড্রোমে, যার কারণে দৃষ্টি আচ্ছন্ন ও ঘোলা হয়ে আসা, ডাবল ভিশন, চোখ শুকিয়ে যাওয়ার মতো উপসর্গ দেখা দেয়।

লম্বা সময় দৈহিকভাবে নিষ্ক্রিয় থাকায় গেমারদের মধ্যে আরো যে-সব স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে বলে বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেছে তার মধ্যে আছে মাথাব্যথা, মাথা ঘোরা, বমি বমি ভাব, উদ্বেগ-উৎকন্ঠা, বিষন্নতা ইত্যাদি। টিনেজারদের মধ্যে আশংকাজনক হারে মেদস্থূলতা বেড়ে যাওয়ার কারণও এই শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা। আর নিয়মিত রাত জেগে খেলার দরুন গেমারদের বড় একটি অংশ ভুগছে অনিদ্রা ও ঘুমের ব্যাঘাতে।

জার্মানির বিশেষজ্ঞরা সম্প্রতি এক গবেষণায় বলেন, আমাদের মস্তিষ্কের যে অংশটি আবেগ-অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করে, নিয়মিত ভিডিও গেমস খেলার ফলে শিশু-মস্তিষ্কের সে অংশটি প্রায় অসাড় আর অবসন্ন হয়ে পড়ে। শুধু তা-ই নয়, শারীরিক-মানসিক উত্তেজনার সাথে সংশ্লিষ্ট পিঠের অংশটি হয়ে ওঠে অত্যধিক সক্রিয়, যার প্রভাব অত্যন্ত ক্ষতিকর। এর চেয়েও মারাত্মক দুঃসংবাদ এসেছে রাশিয়া থেকে। বছর কয়েক আগে ১২ বছর বয়সী কয়েকজন বালক ক্রমাগত উত্তেজনাকর ভিডিও গেমস খেলার কারণে স্ট্রোক বা মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়ে মারা যায়।

চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা এ-ও বলেছেন, ভিডিও গেমস প্রায়শই শিশুদের কল্পনা ও বাস্তবতার পার্থক্য-রেখাটি ভুলিয়ে দেয়। ভারতের বিশিষ্ট শিশু-মনস্তত্ত্ববিদ হেমাঙ্গি দাভালে বলেন, এসব গেমস শিশুরা নিয়মিতভাবে খেলার ফলে এর সহিংসতাকেই একসময় স্বাভাবিক বাস্তবতা বলে ধরে নেয়। ফলে প্রাত্যহিক জীবনে কখনো কখনো তার এসব প্রয়োগ করার ইচ্ছা জাগে। তখন নিজেকে গেমসের অংশ বলে মনে করে হিংস্র শারীরিক সক্ষমতা ও সহিংসতাকে অনুকরণ করতে চায়। তারা আরো জানাচ্ছেন, ভিডিও গেমস শিশুর অফুরান মনোদৈহিক শক্তি ক্ষয় করে ফেলে। শেষ পর্যন্ত তাকে করে তোলে অবসাদগ্রস্ত। ভারতের আরেকজন শিশু-বিশেষজ্ঞ নির্মলা রাও বলেন, এ ধরনের খেলা শিশুদের মস্তিষ্কের ওপর চাপ বাড়ায় এবং উদ্ধত হয়ে ওঠাসহ নানারকম সমস্যা তৈরি করে।

গেমস নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপনে আমরা প্রভাবিত হচ্ছি। অজ্ঞতার কারণে কেউ কেউ আবার এটাও ভেবে বসি যে, ভিডিও গেমস শিশুদের বুদ্ধিদীপ্ত করে তোলে। আর এ ভয়াবহ অজ্ঞানতার অসহায় শিকার হয় আমাদের কোমলমতি শিশুরা।

বছর কয়েক আগে ভারতে বেশ হৈ চৈ শুরু হয় সেদেশের দুটো টিভি অনুষ্ঠান নিয়ে। ‘বিগ বস ফোর’ আর ‘রাখি কা ইনসাফ’। বড়দের অনুষ্ঠান বলে এ দুটো গভীর রাতে সম্প্রচার করার জন্যে সুপারিশ করেছিলো কেন্দ্রীয় সরকার। কারণ, সে দেশের জাতীয় পর্যায়ের একটি সমীক্ষা অনুসারে, সন্ধ্যা সাতটা থেকে রাত ১০টার মধ্যে যে টিভি সিরিয়াল ও অনুষ্ঠান দেখানো হয় তাতে বিগড়ে যাচ্ছে ছয় থেকে ১৭ বছরের ছেলে-মেয়েরা। এই মতামতকে আবার সমর্থন দিয়েছে দেশটির প্রায় ৯০ শতাংশ অভিভাবক। তারা বলছেন, যত দিন যাচ্ছে ততই শালীনতা হারাচ্ছে এ জাতীয় অনুষ্ঠান আর সিরিয়ালগুলোর সংলাপ এবং ছবি। এদিকে ভারতীয় মনস্তত্ত্ববিদরা জানাচ্ছেন, টিভি দেখার প্রভাবে ক্রমশ হিংস্র হয়ে পড়ছে কমবয়সী ছেলে-মেয়েরা। মা-বাবার সাথে কোনো ধরনের খারাপ ব্যবহার করতেও পিছপা হচ্ছে না তারা এবং এসব ঘটছে এই অনুষ্ঠানগুলোর দৌলতেই।

এখানেই শেষ নয়। বলা হচ্ছে, ছয় বছরের কম বয়সী বাচ্চারা এখন তিন থেকে চার ঘণ্টা টিভি দেখে। করোনাকালে যোগ হয়েছে স্মার্টফোন। শুধু এটুকু হলেও কথা ছিলো, কিন্তু গোল বেঁধেছে অন্য জায়গাতে। মা-বাবারা বলছেন, টিভি দেখার সময় বিজ্ঞাপনগুলো খুঁটে খুঁটে দেখে ওরা। তারপর একগুঁয়ে বায়না-বিজ্ঞাপনে দেখানো খাবারগুলো কিনে দিতে হবে। আর অস্বাস্থ্যকর ওসব খাবারগুলোতে এভাবেই আসক্ত হয়ে পড়ছে বাচ্চারা।

সমীক্ষায় আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উঠে এসেছে। সেটি হলো, বাচ্চারা কার্টুন দেখেই বেশি সময় কাটায়। কিন্তু ওসব কার্টুনেই মজার ছলে ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে হিংসাত্মক ঘটনা। এ ওকে মারছে, সে এসে আবার পাল্টা মার দিচ্ছে ইত্যাদি। এতে তাৎক্ষণিক মজা আছে বটে, কিন্তু দূরপ্রসারী ফল হতে পারে ধ্বংসাত্মক আর ভয়াবহ।

শিশু-বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুর দুরন্ত প্রাণময় শৈশবকে এসব ভুল আর ক্ষতিকর বিনোদনের আগ্রাসন থেকে সচেতনভাবে রক্ষা করা, বাঁচিয়ে রাখা এখন আমাদের সবার জরুরি নৈতিক দায়িত্ব।

গেমিং ডিজ-অর্ডারকে আর দশটা মানসিক অসুস্থতার মতো গ্রহণ করুন। সন্তানকে দোষারোপ, বকাঝকা বা মারধর করবেন না। কারণ এই মুহূর্তে তার নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ নেই। আর নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা আবেগপ্রবণ বিধায় চাপ দিলে ঘটতে পারে অঘটন।

ভালো হয় যদি গেমিংয়ের দুষ্টচক্রে পড়ার আগেই তাকে নিবৃত্ত করেন। এ-জন্যে অনলাইন ক্লাসের বাইরের সময়টাতে তাকে ভালো কাজে সম্পৃক্ত করুন। তা হতে পারে বই পড়া, বাগান করা বা অন্য কোনো সৃজনশীল কাজ।

আর যদি ইতোমধ্যেই গেমিংয়ে আসক্ত হয়ে থাকে তাহলে আপনার কাজ হবে বিচক্ষণতার সাথে পদক্ষেপ নেয়া। জোর করে ডিভাইজ কেড়ে নিলে বা একাউন্ট ডিলিট করাতে গেলে হতে পারে হিতে বিপরীত। তাছাড়া হাতের জিনিসটি কেড়ে নিতে হলে তাকে তো অন্য কিছু হাতে ধরিয়ে দিতে হবে!

সন্তানকে নিয়ে সপরিবারে ঘুরতে যান, তাকে গুণগত সময় দিন। দাবা লুডু ক্যারাম ইত্যাদি ঘরোয়া খেলা শিখিয়ে দিন এবং সম্ভব হলে আপনিও তার সাথে খেলায় অংশ নিন। তবে সবচেয়ে ভালো হয় যদি বন্ধুদের সাথে মাঠের খেলায় সে অংশ নেয়।

সেই সাথে তাকে সাদাকায়নে নিয়ে আসুন। সৃষ্টির সেবামূলক কাজগুলোতে অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ করুন। সঙ্ঘের ইতিবাচক আবহে থাকলে সে নিজেই তৎপর থাকবে অপ্রয়োজনীয় ও ক্ষতিকর কাজ থেকে বিরত থাকতে।

এসি