ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৪ ১৪৩০

মন ও ব্রেনে সজীবতা ফেরায় মেডিটেশনঃ প্রফেসর স্টিভেন

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৯:১২ পিএম, ২৩ আগস্ট ২০২১ সোমবার | আপডেট: ১১:৫৯ এএম, ২৪ আগস্ট ২০২১ মঙ্গলবার

নিউরোসায়েন্স বা স্নায়ুবিজ্ঞান গবেষণায় এ-কালের একজন নেতৃস্থানীয় ও সুপরিচিত গবেষক স্টিভেন লরিস। বর্তমানে তিনি বেলজিয়ামের ইউনিভার্সিটি অব লিজ-এ একটি গবেষক দলের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

দুই দশক ধরে তিনি কাজ করেছেন মস্তিষ্কের বিভিন্ন সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায় নিয়ে। গবেষণা করেছেন মন ও মস্তিষ্কের ওপর মেডিটেশনের ইতিবাচক প্রভাব নিয়েও। ২০২১ সালে প্রকাশিত হয়েছে তার বই দ্য নো-ননসেন্স মেডিটেশন : অ্যা সায়েন্টিস্ট’স গাইড টু দ্য পাওয়ার অব মেডিটেশন।

৩ এপ্রিল ২০২১ যুক্তরাজ্যভিত্তিক বিজ্ঞান সাময়িকী নিউ সায়েন্টিস্টকে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ব্রেনকে রি-টিউন করার পাশাপাশি মহামারির সুদূরপ্রসারী ও ক্ষতিকর নানা প্রভাব থেকে আমাদের মুক্তি দিতে মেডিটেশন চর্চা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তার কথায় আরো উঠে এসেছে রোগ নিরাময়, অস্থিরতা ও স্ট্রেসমুক্তি, শিশু মনের বিকাশসহ নানা ক্ষেত্রে মেডিটেশনের উপযোগিতার বিষয়টি। উল্লেখযোগ্য অংশ এখানে তুলে ধরা হলো। 

‘মেডিটেশনের কথা যদি আরো আগে জানতাম!’

আমাদের হাসপাতালে এমন অনেক রোগী আছেন যারা দীর্ঘদিন ধরে ব্যথা-বেদনা, দুশ্চিন্তা ও বিষন্নতায় ভুগছেন। তাদের অসুস্থতা ও কষ্ট আরো বেড়ে গেছে কোভিডের সময়। প্রচলিত চিকিৎসার পাশাপাশি আমরা তাদেরকে মেডিটেশনে উদ্বুদ্ধ করে থাকি।

এই রোগীরা প্রায়ই আক্ষেপ করে বলেন, ‘খুব ভালো হতো যদি মেডিটেশনের কথা আরো আগে জানতে পারতাম।’ আসলে দেহে রোগবালাই বাসা বাঁধার পরে নয়; বরং আরো আগেই যদি মেডিটেশনের চর্চা শুরু করা যায়, তাহলে রোগ-জীবাণু প্রতিহত করাটা অনেক সহজ হবে।

মেডিটেশনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, এর চর্চা ব্রেনকে রি-টিউন করে। সহজ ভাষায় মেডিটেশন হলো ব্রেনের ব্যায়াম। যখন কেউ নিয়মিত দৌড়ায়, স্বাভাবিকভাবেই তার পায়ের পেশি মজবুত হয়; আবার যখন কেউ সাঁতার কাটে, তার হাতের পেশির শক্তি বাড়ে। তেমনি আমরা যখন মেডিটেশন করি, মস্তিষ্কের ভেতরেও আসে নানা ইতিবাচক পরিবর্তন।

মেডিটেশন চর্চাকারীদের ব্রেন-স্ক্যান করে দেখা যায়, দীর্ঘদিন নিয়মিত মেডিটেশনের ফলে গ্রে ম্যাটারের পরিমাণ বাড়ে, যা মনোযোগ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। সেইসাথে বিস্তৃত হয় ব্রেনের হিপোক্যাম্পাস অংশ, যা স্মৃতিশক্তির জন্যে গুরুত্বপূর্ণ। পরিবর্তন আসে ইনসুলার কর্টেক্স ও লেফট প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্স-এ, যা আমাদের অনুভূতি এবং আবেগের ভারসাম্য বজায় রাখে।

দুশ্চিন্তামুক্তিতে মেডিটেশন অব্যর্থ

অনেকে প্রশ্ন করেন, মেডিটেশন কি কোভিড-১৯ থেকেও আমাদের রক্ষা করতে পারে? আসলে দেহের ওপর এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ওপর মনের যে প্রভাব, তা আমরা অল্পদিন হলো বুঝতে শুরু করেছি। তবে একথা সত্য যে, দুশ্চিন্তা-উদ্বিগ্নতা আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দুর্বল করে দেয়। তাই দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত থাকতে মেডিটেশন একটি অসাধারণ প্রক্রিয়া। আর এটাও প্রমাণিত যে, যে-কোনো ভ্যাকসিন (বা রোগের চিকিৎসা) কতটা কার্যকরী হবে, তা অনেকটাই নির্ভর করে ব্যক্তির মানসিক অবস্থার ওপর। সেই বিচারে বর্তমান সময়ে মেডিটেশন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

আমরা সবাই জানি, এই মহামারির প্রভাব থেকে শিশুরাও মুক্ত নয়। তাদেরও স্বাভাবিক প্রাণবন্ত জীবনে ফিরিয়ে আনতে অবশ্যই মেডিটেশনের শিক্ষা দিতে হবে। আশ্চর্য হলেও সত্য, আমাদের স্কুলগুলোতে জ্ঞানচর্চায় উদ্বুদ্ধ করার জন্যে অনেক শিক্ষক আছেন, শারীরিক শিক্ষা ও ফিটনেসের জন্যেও শিক্ষক আছেন, তাহলে মনের যত্ন কীভাবে নিতে হবে—সেই শিক্ষা দেয়ার জন্যে কোনো শিক্ষক কেন থাকবেন না? এ বিষয়টি আমাদের সমাজে দীর্ঘদিন ধরেই অবহেলিত।

যদি আমার কথাই ধরি—আমাকে শেখানো হয়েছে, কীভাবে চিকিৎসক হওয়া সম্ভব। কিন্তু কেউ শেখায় নি কীভাবে আমি নিজেকে ভালো রাখব। মেডিটেশন হয়তো আমাদের চারপাশের ঘটনাগুলোকে বদলে ফেলতে পারবে না। কিন্তু প্রত্যাশিত-অপ্রত্যাশিত প্রতিটি ঘটনায় আমার দেহ-মন কীভাবে প্রভাবিত হবে—সেই বিষয়টির ওপর নিয়ন্ত্রণ এনে দেবে মেডিটেশন। আমি বিশ্বাস করি, একসময় আমাদের প্রচলিত চিকিৎসাব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে পরিণত হবে মেডিটেশন।

আমি রোগীদের মেডিটেশন করার পরামর্শ দেই

বাস্তবতা হলো, আমরা আসলে ততটুকুই করতে পারি যতটুকু আমাদের সামর্থ্য। সাধারণ আর দশটা মানুষের মতো আমার জীবনেও অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। আমার পাঁচটি সন্তান। ব্যক্তি হিসেবে নানা সীমাবদ্ধতা আছে, সেইসাথে আছে হাসপাতালের ব্যস্ততা, বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ। আমার স্ত্রীও একজন কর্মজীবী। যে-সব ধ্যানী সাধকদের সাথে আমি বিভিন্ন সময় কাজ করেছি, তাদের মতো আমি হয়তো হতে পারি নি।

তবে আমি রোগীদের মেডিটেশন করার পরামর্শ দেই। যে-কোনো সময় যে-কোনো জায়গায় মেডিটেশন করা সম্ভব। যানজটে বসেও একজন মানুষ নিজের ভেতরে ডুব দিতে পারে। এতে আমাদের অস্থির-চঞ্চল মনটার ওপর এক ধরনের নিয়ন্ত্রণ চলে আসে। সেইসাথে আমরা বর্তমানে মনোযোগী হতে পারি।

আর যখনই বর্তমানের চিন্তা ও আবেগগুলোর প্রতি আমরা দৃষ্টি দেই, আমাদের হার্ট রেট কমতে থাকে, ব্লাড প্রেশার নিয়ন্ত্রণে থাকে, একইসাথে হ্রাস পায় স্ট্রেস হরমোন কর্টিসল। আর এই প্রতিটি বিষয়ই আমাদেরকে দারুণভাবে সাহায্য করতে পারে কোভিড মোকাবেলার ক্ষেত্রেও।