ঢাকা, বুধবার   ১১ ডিসেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ২৬ ১৪৩১

পাথর যখন ফুল হয়ে পাপড়ি মেলে ফোটে

ইলোরা দে

প্রকাশিত : ০৩:৪৪ পিএম, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২১ সোমবার | আপডেট: ০৬:১৯ পিএম, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২১ সোমবার

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট, ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের এক সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা হয়; উদ্দেশ্য ছিল বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যা করা। আশ্চর্যজনকভাবে তার প্রাণরক্ষা হয়। সর্বশক্তিমান বোধকরি কোনো এক মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে এই অসাধারণ নেত্রীর প্রাণরক্ষা করেছিলেন সেদিন।  

একটা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ প্রতিনিধি হিসেবে চতুর্থবার মনোনীত হওয়া, তাও একজন নারী য়ে, তা নিঃসন্দেহে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।

আরেকটু পেছনে যদি তাকাই, চোখের সামনে আরেকটি দৃশ্য, ১৭ মে, ১৯৮১, রোববার; শেখ হাসিনা ছয় বছরের রাজনৈতিক এসাইলাম কাটিয়ে ঢাকায় ফিরছেন।  প্রবল বৃষ্টির মধ্যে ভারতবর্ষ থেকে শেখ হাসিনাকে নিয়ে একটি উড়োজাহাজ ঢাকার মাটি ছোঁয়। বাংলাদেশের প্রকৃতি জলাধারা দিয়ে বরণ করে তার ভূমিকন্যাকে, যেন বলে উঠেছিল, 
‘এসো আমার ঘরে।
বাহির হয়ে এসো তুমি যে আছো অন্তরে।’   

সারা বাংলাদেশ থেকে, এমনকি প্রত্যন্ত গ্রাম থেকেও, মানুষের ঢল নেমেছিল রাজধানী ঢাকায়, তাদের সকলের প্রিয় মানুষটিকে সুস্বাগতম জানাতে। ধর্মান্ধ সামরিকতার বিরুদ্ধে লাখো কণ্ঠের স্লোগানে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল গোটা রাজধানী। যেন হাতে জাদুকাঠি নিয়ে স্বপ্নের জগতের সেই দেবী আসছেন, যিনি কণ্ঠে স্লোগান তোলা সমস্ত মানুষদেরকে অন্যায়ের হাত থেকে রক্ষা করবেন।  

এর পরবর্তী সময়ে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বস্তরের সদস্যরা এবং কর্মচারীরা সর্বসম্মতিক্রমে শেখ হাসিনাকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করেন। এরপর, বঙ্গবন্ধু-কন্যা অনির্বচনীয় কষ্ট, নিপীড়ন, কারাবাস সহ্য করে, তদানীন্তন সামরিক শাসকের যাবতীয় অত্যাচার সহ্য করে, দৃঢ়তার সাথে আওয়ামী লীগকে সুসংগঠিত করেন।   

সামরিক অপশাসন ও বাংলাদেশের মানুষের ওপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন শেখ হাসিনা। তারই নেতৃত্বে, ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুলভাবে জয়ী হয়। এই সময় থেকে বাংলাদেশের উন্নতির সূচক ওপরে উঠতে শুরু করে। দেশের উন্নতির জন্য শেখ হাসিনা সমস্ত বাঁধাকে অগ্রাহ্য করে কঠিন লড়াই চালিয়ে যান। কোনো বাঁধাই তার চলাকে থামাতে পারেনি, কারণ তা ছিল অশুভর বিরুদ্ধে শুভর লড়াই।

২০০৯ সালে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। তার কিছু পরেই তিনি তার সবচেয়ে কাছের মানুষ, তার স্বামীকে হারান। তার স্বামী ছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন পরমানু বিজ্ঞানী ড. এম ওয়াজেদ মিয়াঁ।

বহু অপেক্ষার পর ২০১০ সালের জানুয়ারিতে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত পাঁচজন প্রাক্তন সামরিক আধিকারিকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। সেই বছরের শেষের দিকে, বাংলাদেশ সরকার প্রথম ট্রাইবুনাল গঠন করে, যা কিনা ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার যুদ্ধের সময়ের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করে। এই সমস্ত সম্ভব হয়েছিল অসামান্য একজন নারী, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে।

লেখক : ইলোরা দে

কী ভীষণ অত্যাচারিত হয়েছেন এই নেত্রী: তিনি যখন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন, তখন জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় ছিলেন। ধানমন্ডিতে, নিজ গৃহে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি শেখ হাসিনাকে। বঙ্গবন্ধুর স্মরণে মাহফিলের আয়োজন করতে দেওয়া হয়নি তাকে। তখন বাধ্য হয়ে তিনি গৃহের সামনে রাস্তায় মিলাদ পাঠ করেছিলেন। জিয়াউর রহমান, তার লোকজনকে নিয়ে একটি প্রতিরোধ কমিটি গঠন করেন, শেখ হাসিনার সবরকমের প্রচেষ্টাকে বাধা দেওয়ার উদ্দেশ্যে।   

জিয়া, এরশাদ ও খালেদা জিয়ার শাসনকালে ১৯ বার হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তু তিনি প্রতিবারই অলৌকিকভাবে বেঁচে যান, এরজন্যই বোধয় বলে, ‘God is never late, but on time.’

ক্ষমতায় আসার পরে, সহস্র প্রতিবন্ধকতার/পরীক্ষার সম্মুখীন হন তিনি। সবথেকে বড় লড়াই ছিল মৌলবাদী শক্তির বিরুদ্ধে। ৫ মে, ২০১৩, হেফাজতে ইসলাম, শেখ হাসিনার সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার আহ্বান জানিয়ে ঢাকা অবরোধ করে। হাসিনা শক্ত হাতে মৌলবাদী এই শক্তিকে দমন করেন।  

২০১৭ সালে, হাসিনার নেতৃত্বকালে, প্রতিবেশী মিয়ানমার থেকে প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা, গণহত্যার অবস্থা থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছিল। শেখ হাসিনা জননীর ন্যায় তাদেরকে আশ্রয় দেন। যদিও তাদেরকে শরণার্থীর মর্যাদা দিতে পারা যায়নি। কিন্তু এই সাত লাখ অসহায় রোহিঙ্গার প্রত্যাবাসনে সাহায্য করেছিল বাংলাদেশ সরকার।

আজকের বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনার অধ্যাবসায়, সংগ্রাম, ধৈর্য্য, ত্যাগ এবং নিরলস পরিশ্রমের ফসল । আজ বাংলাদেশ সারা বিশ্বের চোখে একটি সমৃদ্ধ দেশ। এর পেছনে রয়েছে বঙ্গবন্ধুকন্যার কঠোর অধ্যাবসায়। ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক জীবনে, অল্পবয়স থেকে যা যা আঘাত বঙ্গবন্ধুকন্যা পেয়েছেন, তা সহস্র পাপড়ি মেলে ফুটে উঠেছে।

স্বাধীনতা লাভের মাত্র ৫০ বছরের মধ্যে, বাংলাদেশের বর্তমান উন্নতির সূচক, সারা বিশ্বকে হতবাক করে দিয়েছে। ঠিক যেভাবে শত শত বাঙালি বঙ্গবন্ধুর ডাকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, ঠিক সেভাবেই বঙ্গবন্ধুর কন্যার নেতৃত্বে, বাংলাদেশের মানুষ দৃঢ় পদক্ষেপে উন্নতির শিখরের দিকে এগিয়ে চলেছেন। তারই নেতৃত্বে, অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় বাংলাদেশের অর্থ ও বাণিজ্যের সূচক ঊর্ধ্বগামী । ১৯৯৬ থেকে ২০০১ এর মেয়াদে আওয়ামী লীগের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বাংলাদেশে অর্থনৈতিক বিপ্লব এনে দিয়েছিল। এর পরবর্তী সময়ে ২০০৮ থেকে ধারাবাহিকভাবে তিনটি মেয়াদে, বাংলাদেশের অর্থনীতির ঊর্ধ্বমুখী গতি অটুট থাকে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শক্তিশালী নেতৃত্বের অধীনে।

বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহের গুরুতর সমস্যা ছিল । শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে প্রত্যন্ত গ্রামেও বিদ্যুৎ সরবরাহ পৌঁছে যায়। আজ বাংলাদেশে আর বিদ্যুতের ঘাটতি নেই। বাংলাদেশে বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন ২৪০০০ মেগাওয়াট।  বার্ষিক খাদ্য-শস্য উৎপাদন ৪৫১ লক্ষ টন। বর্তমান সূচক অনুযায়ী, বাংলাদেশ চাল উৎপাদনে বিশ্বের মধ্যে তৃতীয় ও মিঠাপানির মাছ উৎপাদনে চতুর্থ স্থান অধিকার করেছে।

যে পাকিস্তান বাংলাদেশকে ধ্বংস করে দিতে চেয়েছিল, তারা আজ উন্নতির সূচক অনুযায়ী বাংলাদেশের থেকে অনেক পিছিয়ে আছে। স্বাধীনতার পরে ১০০ বাংলাদেশি টাকা, ৩৫-৪০ ভারতীয় টাকার সমান ছিল, এখন ১০০ টাকা ৮৬ রুপির সমান।   
  
আমেরিকার অধুনা রাষ্ট্রপতি জো বাইডেনসহ, বিশ্বের প্রথম সারির সমস্ত নেতারা যখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশংসায় উচ্ছসিত, তখন নিজের কর্তব্যে অটল, চারিদিকের প্রশংসা ও নিন্দা উভয়তেই অবিচলিত হাসিনা শক্ত হাতে লড়াই চালিয়ে গেছেন কোরোনাভাইরাস অতিমারীর বিরুদ্ধে।
বাংলাদেশের আপামর জনতার কাছে তিনি কখনো বা দেশের প্রধানমন্ত্রী, কখনো বিরোধীদলীয় নেত্রী, কখনো মৌলবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে রাজপথে নেমে আন্দোলনের নেত্রী তিনি। কিন্তু যে ভূমিকাতেই থাকুন না কেন বাংলাদেশের কল্যাণে নিবেদিত প্রাণ তার। এই দেশের কল্যাণে প্রাণ দিয়েছেন তার পিতা, পরিবারের বেশির ভাগ সদস্য। এই দেশের কল্যাণ-চিন্তা তো তার মর্মে গাথা। নিজের দেশের প্রতিটি মানুষকে বিশ্বাস করে প্রাণ দিয়েছেন তার পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাই বাংলাদেশের কল্যাণ-চিন্তা তার সংস্কার।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তো শুধুই এক যুদ্ধ নয়, তা বহন করে এক মানবিক চেতনাকে। যে চেতনায় প্রত্যেক দেশবাসীকে জাগ্রত করা ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন। তাই তো তিনি জাতির জনক। আর সেই চেতনাকে বহন করে চলেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা, সমস্ত বাধা-অভিসন্ধিকে অতিক্রম করে, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে, বাবার অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করতে তিনি দৃঢ়বদ্ধ। তিনি নিজেও জানেন এ পথ কতটা পিচ্ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের নির্ভীক নেত্রী এগিয়ে চলেছেন দেশের কল্যাণার্থে। শেখ হাসিনার ৭৫ বছরের এই সুদীর্ঘ লড়াই মনে করিয়ে দেয় প্রাণের কবির সেই লেখাকে,
‘আমার পথে পথে পাথর ছড়ানো, তাই তো তোমার বাণী বাজে ঝর্ণা ঝরানো।’

যত ব্যাথা মানব জীবনে আসে, তত যেন সর্বশক্তিমান নিকট হয়ে ওঠেন, তত যেন জীবন সৌন্দর্য্যে ভ'রে  ওঠে।

২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, শুক্রবার রাতে স্বল্পোন্নত (LDC) তালিকা থেকে বের হয়ে যাওয়ার সুপারিশ পেয়েছে বাংলাদেশ। এ পরম আনন্দের খবর। বাংলাদেশের যে সমস্ত মানুষ পাকিস্তানের কাছে মাথা নিচু করবেন না বলে প্রাণ দিয়েছিলেন, এ তাদের আত্মত্যাগের ফসল।

সেই  আগুনকে নিভতে দেননি শেখ হাসিনা। আজ তিনি সারা বিশ্বের প্রতিটি নারীর কাছে উদাহরণ স্বরূপ। আমি ভারতের তথা পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ এক নারী।  সারা বিশ্ব জুড়ে আমার মতো কোটি কোটি মেয়েদের কাছে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক অদম্য লড়াইয়ের প্রতীক। আমাদের দুই বাংলার প্রাণের কবির ভাষাতেই শুধু বলতে পারি, 

‘সুনীল সাগরের শ্যামল কিনারে 
দেখেছি পথে যেতে তুলনাহীনারে।’
লেখক : ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী সমিতির সাধারণ সম্পাদক। স্বাধীন উদ্যোক্তা, শিক্ষক, ভাষা সম্পাদক, প্রকল্প কো-অর্ডিনেটর। 
এসএ/