ঢাকা, শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ৬ ১৪৩১

ওআইসি অধিবেশনে পাকিস্তানের অভিসন্ধি

অয়নাংশ মৈত্র

প্রকাশিত : ০১:৫৫ পিএম, ৪ জানুয়ারি ২০২২ মঙ্গলবার | আপডেট: ০১:৫৬ পিএম, ৪ জানুয়ারি ২০২২ মঙ্গলবার

মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের আন্তর্জাতিক সংগঠন অরগানাইজেশন অফ ইসলামিক কোঅপারেশনের (ওআইসি) বিদেশমন্ত্রীদের বিশেষ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল গত ১৯ ডিসেম্বর পাকিস্তানের ইসলামাবাদে। এবারের ওআইসির মূল চৌদ্দতম অধিবেশনে চেয়ার ছিল সৌদি আরব। ওআইসির সভায় যোগ দিতে দীর্ঘ নয় বছর পর বাংলাদেশের সরকারি প্রতিনিধি পা রাখেন পাকিস্তানে। পাকিস্তান সরকারের বিবৃতি অনুযায়ী এই মহাসমাবেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং জাতিসংঘ মিলিয়ে প্রায় ৭০ জন প্রতিনিধি ইসলামাবাদে হাজির ছিলেন। ছিল তালিবানের প্রতিনিধিত্ব।
 
তালিবানদের ক্ষমতা দখলের পর আন্তর্জাতিক স্তরে আফগানিস্তান নিয়ে এত প্রকাণ্ডমানের আয়োজন এই প্রথম। মুসলিম রাষ্ট্রপুঞ্জের বিদেশমন্ত্রীদের নিয়ে ডাকা কাউন্সিল অফ ফরেন মিনিস্টার্সের ১৭তম জরুরি সেশনে ওআইসির মহাসচিব আফগান প্রতিনিধিদলকে আফগান নাগরিকদের স্বার্থ, তাদের জীবন রক্ষা, হিংসাউন্মুক্ত পরিস্থিতি এবং শান্তির নিশ্চিতকরণের দাবি জানান।

আফগানিস্তানে শান্তি সুনিশ্চিতকরণের সহায়তা ওআইসির পক্ষ থেকে অক্ষুণ্ন থাকবে বলেও তিনি নিশ্চয়তা দেন। কাবুলস্থিত ওআইসির অফিস মারফত আর্থিক, মানবিক এবং অন্যান্য সহায়তা পৌঁছে দেয়া হবে বলে তিনি অবহিত করেন। সমস্ত সদস্য রাষ্ট্রকে মানবিক সহায়তা দেওয়ার জন্য তিনি আবেদন জানান। জাতিসংঘের মানবিক বিষয়ক উপমহাসচিব মার্টিন গ্রিফিথ ইসলমাবাদে এসে আফগান সংকট মোচনে ওআইসির ভূয়সী প্রশংসা করেন। 

ওআইসি মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের অনুদান নিয়ে আফগানিস্তানে দারিদ্র্য ও অনাহার দূরীকরণে একটি তহবিল গঠন করে। করোনার করালগ্রাস, এবং তালিবানদের অভ্যুত্থান আফগানিস্তানকে দুমড়ে-মুচড়ে দিয়েছে দারিদ্রতায়; দৈন্যতায়। ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড আগস্ট মাসের ২৩ তারিখে প্রায় ৪৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পরিমাণ অর্থ তালিবানদের স্পর্শের বাইরে রাখে। আফগানিস্তানে ক্রমশ বেড়ে চলছে অনাহার। ভয়াবহভাবে বেড়ে চলছে বুভুক্ষুর সংখ্যা। ৩৮ মিলিয়ন জনসংখ্যার মধ্যে ২২.৮ মিলিয়ন আফগান খাদ্য সঙ্কটে ভুগছে অথবা অপুষ্টির শিকার। 

ওআইসি মিটিংয়ে তালিবানদের বিদেশমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকী উপস্থিত থাকলেও ওআইসি তালিবান সরকারকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেয়নি। ওআইসি রাষ্ট্রগুলোর প্রতিনিধিরা সমবেতভাবে যে আলোকচিত্র প্রকাশ করেন তাতেও বহির্ভূত থাকেন তালেবান প্রতিনিধি। মুত্তাকী তার স্বীকৃতির দাবি এক প্রকার অধিকার হিসেবেই পেশ করেন। 

ওআইসির সভায় আফগানিস্তানে মানবিক সহায়তা প্রদানের ঘোষণা করে বাংলাদেশ। এই সফরকালে ইসলামাবাদস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস প্রাঙ্গণে বঙ্গবন্ধু কর্নার উন্মোচন করেন বাংলাদেশের বিদেশ সচিব মাসুদ বিন মোমেন। 

মূলসভা ব্যতীত অর্গানাইজেশন অফ ইসলামিক কোঅপারেশনের মহাসচিব এইচ ই হসেইন ইব্রাহিম ত্বহা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সঙ্গে  দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় আফগানিস্তান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। আফগান জনগণকে সমর্থন ও সাহায্য প্রদানের জন্য প্রচেষ্টা চালানোর গুরুত্ব এবং নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা অর্জনের জন্য জরুরি সহায়তা প্রদানের প্রসঙ্গ তাদের আলোচনার অন্তর্ভূক্ত ছিল।

মূলত আফগানিস্তান নিয়ে ওআইসি অধিবেশনের আবডালে পাকিস্তানের অভিসন্ধি ছিল কাশ্মীর এবং ভারত। ২০১৯ সালে ভারত কাশ্মীরে স্বশাসন ধারা প্রত্যাহার করলে পাকিস্তানের ভারত বৈরিতা বাড়ে। সেই থেকেই পাকিস্তান আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারত বিরোধিতা করে চলেছে। 

ওআইসির অধিবেশনে সৌদি বিদেশমন্ত্রী ফারহান আল সৌদের সঙ্গে সংলাপের সময় পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর প্রধান জেনারেল কোমর জাভেদ বাজয়া কাশ্মীরের প্রসঙ্গ তোলেন এবং বলেন আঞ্চলিক স্থিতাবস্থা এবং শান্তির জন্য কাশ্মীর প্রসঙ্গ অত্যন্ত জরুরি। 

অতীতে ওআইসি স্পষ্টতই জানিয়েছে পাকিস্তান তাদের সংকীর্ণ স্বার্থ কায়েম করতে কোনোভাবেই ওআইসিকে ব্যবহার করতে পারবে না। ওআইসি ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কে সমঝোতায় আসার প্রস্তাব দিলে ভারত, সংযুক্ত আরব আমিরশাহী, বাংলাদেশ এবং মালদ্বীপকে তাদের পদক্ষেপকে ধন্যবাদ জানায়।  

গত জুলাই মাসে মহাসচিব ইউসুফ আল উসাইমীন এবং ভারতে সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূত ড. সাঈদ জম্মু-কাশ্মীর বিষয় আলোচনায় বসেন। 

ওআইসি পূর্বে অরগানাইজেশন অফ দ্য ইসলামিক কনফারেন্স নামে পরিচিত ছিল। মূলত জাতিসংঘের পর এটি কোনো সর্ববৃহৎ আন্তর্জাতিক সংস্থা, যার সদস্য ৫৭টি রাষ্ট্র। এই সংগঠনের মূল লক্ষ্যই হলো আন্তর্জাতিক স্তরে শান্তি এবং সম্প্রীতি বজায় রাখা। রাশিয়া এবং থাইল্যান্ড এই সংগঠনের অবজারভার মেম্বার। 

২০১৮ সালে ওআইসির ৪৫তম বিদেশমন্ত্রীদের সম্মেলনে ভারতকে ওআইসির পর্যবেক্ষক সদস্য করতে বাংলাদেশ প্রস্তাব রাখলে পাকিস্তান তার ঘোরতর বিরোধিতা করে। উল্লেখ্য, ভারতে বসবাসকারী মুসলিমের সংখ্যা ১৮৫ মিলিয়নের উপরে, যা দুনিয়ার মুসলিম জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশ। ভারত প্রশাসিত কাশ্মীরে পুলওয়ামা হামলার পর ২০১৯ সালে আবুধাবিতে ভারতের বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ ওআইসির বিদেশমন্ত্রী সম্মেলনে বিশেষ অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত হলে পাকিস্তান তার তীব্র বিরোধিতা করে। এমনকি পাকিস্তানের বিদেশমন্ত্রী শাহ মোহাম্মদ কুরেশি নির্দিষ্ট সভায় যোগদানে বিরত থাকেন।

ক্রমাগত মুদ্রাস্ফীতি এবং অতি আবশ্যক পণ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির জেরে পাকিস্তান নাজেহাল। জনতার ক্ষোভে ইমরান খানের সরকার। অন্যদিকে পাক সরকার, কোনো সুষ্ঠু সমঝোতায় আনতে পারছেনা দুই উগ্রবাদী সংগঠন তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান এবং তেহেরিক-ই লাব্বাইককে। 

ওআইসির সভায় ভারত প্রশাসিত কাশ্মীরে মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী উৎকণ্ঠা প্রকাশ করলেও পাকিস্তানের বালুচ, পশতুন এবং সিন্ধিদের দাবি তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। 

চীন এবং পাকিস্তানের মধ্যে বিশেষ অর্থনৈতিক করিডর চায়না পাকিস্তান ইকনমিক করিডর (সিপিইসি) থেকে বঞ্চিত বালুচিস্তান।  স্বাভাবিকভাবেই স্থানীয় বালুচরা গদরে আন্দোলন করে উগরে দিয়েছে তাদের ক্ষোভ। 

সেখানে বালুচদের জন্য শুধু বেড়েছে বঞ্চনা; একের পর এক চেক পোস্ট। আফগান সঙ্কটের সুরাহা হেতু বিদেশমন্ত্রীদের জরুরি সভা আয়োজন পাকিস্তানের অবশ্যই হিতৈষী ভাবনার এক প্রতিফলন। আফগানিস্তানের অচলাবস্থা নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে দক্ষিণ এশিয়ায়। ক্রমাগত বিচলিত করবে গোটা দুনিয়াকে। 

বলবাহুল্য আফগান সঙ্কট দূরীকরণে ওআইসির পদক্ষেপ ও কর্মসূচিসমূহ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। যুদ্ধের দূর্গ থেকে এক শান্তির নীড় আফগানিস্তানের ভবিষ্যতের মানচিত্র আঁকতে পারে ৫৭টি সংঘবদ্ধ মুসলিম রাষ্ট্র। ওআইসি পাকিস্তানকে কখনই সংকীর্ণ স্বার্থসিদ্ধির জন্য গোটা মুসলিম দুনিয়াকে ব্যবহার করতে প্রশয় দেবেনা। 

লেখক- ভারতীয় সাংবাদিক এবং কূটনীতি গবেষক।

এনএস//