ঢাকা, বুধবার   ০৮ মে ২০২৪,   বৈশাখ ২৪ ১৪৩১

২৫ মার্চ: নজিরবিহীন গণহত্যা

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৮:২১ এএম, ২৫ মার্চ ২০২২ শুক্রবার

একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে নিরস্ত্র সাধারণ বাঙালির ওপর চলে ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ গণহত্যা।

ঠাণ্ডা মাথায় পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর সেই হত্যাযজ্ঞের দিনটিকে ২০১৭ সাল থেকে ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে স্মরণ করা হচ্ছে।

একটি জনগোষ্ঠীর স্বাধিকারের দাবিকে মাটিতে মিশিয়ে দিতে ঢাকায় চালানো হয় ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামের হত্যাযজ্ঞ।

২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যান।

২৫ মার্চ সকাল থেকেই ঢাকার পরিস্থিতি ছিল থমথমে। মুজিব-ইয়াহিয়া আলোচনা পণ্ড হয়ে গেছে- এ খবর ছড়িয়ে পড়ায় বাঙালি ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনে অবস্থান নেয় নেতার নির্দেশের জন্য।

বঙ্গবন্ধু বেশ কয়েকবার ঘর থেকে বেরিয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে বক্তব্য দেন।

আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে প্রেসিডেন্টকে দেওয়া সংবিধানের খসড়ার চূড়ান্ত প্রতিবেদন পেশ করা এবং অনুমোদনের জন্য সময় নির্ধারণের কথা ছিল এদিন। ইয়াহিয়ার সহযোগী জেনারেল এসজিএমএম পীরজাদা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ফোন করে জানাবেন।

সারাদিন ধরেই আওয়ামী লীগের নেতারা টেলিফোনের অপেক্ষায়, কিন্তু সেই ফোন আর আসেনি।

এদিন সকালে ইয়াহিয়া খান ও জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রেসিডেন্ট ভবনে একান্ত বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে ভুট্টো সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘পরিস্থিতি সঙ্কটজনক’।

ভুট্টোর সঙ্গে বৈঠকের পরই জেনারেল ইয়াহিয়া পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের সামরিক প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খানসহ উচ্চপদস্থ সেনাকর্তাদের সঙ্গে গোপন বৈঠক করেন। 

বেলা ১১টার দিকে হেলিকপ্টারে করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল জানজুয়া, মেজর জেনারেল মিঠঠা খান, মেজর জেনারেল নজর হোসেন শাহ ও মেজর জেনারেল ওমরসহ আরও কয়েকজন ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তা রংপুর, রাজশাহী, যশোর, কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম সেনানিবাস সফর করেন। 

বিকাল থেকেই পাকিস্তানি সেনারা হেলিকপ্টারে টহল দিতে থাকে, সব ধরনের সামরিক সংস্থার সদস্যদের বার্তা দিতে থাকে অবশ্যম্ভাবী এক সামরিক অপারেশনের জন্য প্রস্তুত থাকতে।

জেনারেল ইয়াহিয়া খান গোপনে সন্ধ্যায় পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যেতেই পূর্ব পাকিস্তানে তৎপর হয়ে ওঠে তার বাহিনী।

ইয়াহিয়ার ঢাকা ত্যাগের খবর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পৌঁছে যায় বঙ্গবন্ধুর কাছে। রাত ৯টার দিকে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে দলীয় নেতা, কর্মী, সমর্থক, ছাত্র নেতৃবৃন্দ ও সাংবাদিকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, “আমরা সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানে সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সামরিক ব্যবস্থার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানে বেশি আগ্রহী।”

“এ অবস্থায় আমাদের পথ আমাদেরই দেখতে হবে। সবাইকে সর্বোচ্চ ত্যাগের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।”

দাবানলের মত ঘরে ঘরে খবর পৌঁছে যায় যে ইয়াহিয়া ‘ঢাকা ছেড়ে পাকিস্তান পালিয়ে গেছে’। বাঙালি বুঝে ফেলে- কিছু একটা ঘটবে। রাতেই পথে নেমে আসে ছাত্র-জনতা এবং গড়ে তোলে অসংখ্য ব্যারিকেড।

বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা আত্মগোপনে চলে যান।

রাত ১০টার দিকে ঢাকা সেনানিবাস থেকে সেনাবাহিনীর একটি বড় বহর শহরের দিকে রওনা হয়।

শহরমুখী সেনাবাহিনীর দলটি প্রথম প্রতিরোধের সম্মুখীন হয় ফার্মগেইটে। সেখানে গাছের গুঁড়ি, অকেজো স্টিম রোলার এবং ভাঙা গাড়ির স্তুপ রাখা হয় পথ আটকানোর জন্য। 

গুলি করে এ প্রতিরোধ ভেঙে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ট্যাংকগুলো সামনে এগিয়ে যায়।

রাত সাড়ে ১০টা নাগাদ রেসকোর্স ময়দানের উত্তর ও দক্ষিণ দিকে সেনাবাহিনীর অন্তত ৮০টি সাঁজোয়া যানকে যুদ্ধপ্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষা করতে দেখা যায়।

রাত ১১টা ২০ মিনিটের মধ্যেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি অংশ রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের চারিদিকে অবস্থান নিতে শুরু করে। এ আক্রমণের সংবাদ তাৎক্ষণিকভাবে সারাদেশের জেলা ও সাব ডিভিশনে বেতার বার্তার মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হয়।

রাত সাড়ে ১১টার পর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩২ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের অধিনায়ক কর্নেল তাজের নেতৃত্বে একটি সেনা কনভয় রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে আক্রমণ শুরু করে।

ব্যারাকে অবস্থানরত বাঙালি পুলিশ সদস্যরা সেনাবাহিনীকে লক্ষ্য করে পাল্টা গুলি করে।

একই সময়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২২তম বালুচ রেজিমেন্টের সেনারা পিলখানায় ইপিআর-এর ওপর হামলা করে। ব্যারাকে থাকা বাঙালি সেনারা চরম সীমাবদ্ধতার মধ্যেও প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করেন।

এই দুই জায়গায় আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে পুরো ঢাকার বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শাঁখারি বাজারসহ সমগ্র ঢাকায় শুরু হয় আক্রমণ।

সেনাবাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস, শিক্ষকদের আবাসিক এলাকা, এবং বস্তিবাসীর ওপর নজিরবিহীন নৃশংসতা চালায়।

রাত ১টার পর পাকিস্তানের সেনারা ট্যাংক আর সাঁজোয়া যান নিয়ে ধানমণ্ডির বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। অনেকেই আত্মগোপনে যেতে বললেও বঙ্গবন্ধু যাননি।

তিনি বলেছিলেন, “আমাকে না পেলে ওরা ঢাকা জ্বালিয়ে দেবে।”

বঙ্গবন্ধুর গ্রেপ্তার সম্পর্কে বিবিসির একটি প্রতিবেদনে সৈয়দ বদরুল আহসান রচিত ‘ফ্রম রেবেল টু ফাউন্ডিং ফাদার’ বইকে উদ্ধৃত করা হয়েছে।

লেখকের বর্ণনায়, “কর্নেল জেড এ খানের নেতৃত্বে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটা দল ৩২ নম্বর ধানমণ্ডিতে গিয়েছিল। সেখানে পৌঁছাতেই সেনা সদস্যরা গুলি চালাতে শুরু করে। শেখ মুজিবের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা বাঙালি পুলিশ সদস্য গুলিতে মারা যান।”

বঙ্গবন্ধু দোতলা থেকে চেঁচিয়ে বলে ওঠেন ‘ফায়ারিং বন্ধ কর।’

সাংবাদিক বি জেড খুসরু তার বই ‘মিথস অ্যান্ড ফ্যাক্টস বাংলাদেশ লিবারেশন ওয়ার’- এ লিখেছেন “গুলি বন্ধ হওয়ার পরে কর্নেল খান বাসায় ঢোকেন। দোতলায় যান। মুজিব একটা ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন।

“শেখ মুজিবকে কর্নেল নির্দেশ দেন তার সঙ্গে যাওয়ার জন্য। তিনি জানতে চেয়েছিলেন পরিবারকে বিদায় জানিয়ে আসতে পারেন কিনা। কিছুক্ষণের মধ্যেই পরিবারের সবার সঙ্গে দেখা করে বেরিয়ে এসেছিলেন তিনি।”

খুসরু আরও লিখেছেন, “কর্নেলকে শেখ মুজিব জিজ্ঞাসা করেন, আসার আগে আমাকে জানানো হল না কেন? কর্নেল উত্তর দিয়েছিলেন, সেনাবাহিনী আপনাকে দেখাতে চেয়েছিল যে আপনাকে গ্রেপ্তারও করা যেতে পারে।”

জেড এ খান ‘দা ওয়ে ইট ওয়াজ’ বইতে লিখেছেন, “শেখ সাহেবকে গ্রেপ্তার করার পরে ৫৭ ব্রিগেডের মেজর জাফর ওয়ারলেস মেসেজ পাঠিয়েছিলেন ‘বিগ বার্ড ইন কেইজ, স্মল বার্ডস হ্যাভ ফ্লোন’।”

গ্রেপ্তারের তিন দিন পরে বঙ্গবন্ধুকে ঢাকা থেকে করাচি নিয়ে যাওয়া হয়।

এই রাতে সেনাবাহিনী অগ্নিসংযোগ করে দৈনিক ইত্তেফাক, পিপলস, গণবাংলা ও সংবাদ-এর কার্যালয়ে।
এসএ/