ঢাকা, মঙ্গলবার   ৩০ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ১৭ ১৪৩১

গ্রীষ্মের রঙিন ফুলে বর্ণিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৬:৪৬ পিএম, ২৯ মে ২০২২ রবিবার

পাহাড়ের কোলে অকৃত্রিম মায়াময়ী সৌন্দর্যে মোড়ানো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। উদার প্রকৃতি লাবণ্যতায় ভরিয়ে দিয়েছে চবিকে। প্রকৃতির নিজ হাতে শৈল্পিক আবরণে তৈরি চবি ক্যাম্পাসে ষড়ঋতুর পালাবদল খুব সহজেই হৃদয়াঙ্গম করা যায়। শহর থেকে বেশ খানিকটা দূরে চবি ক্যাম্পাস কৃষ্ণচূড়ার লাল, সোনালুর হলুদ-সোনালি রঙের সঙ্গে জারুলের নীলাভ-বেগুনি মনোহরে ছেঁয়ে গেছে।

শাটলের ক্যাম্পাস খ্যাত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে অজস্র সোনালু, কৃষ্ণচূড়া ও জারুল যেন ভূস্বর্গে পরিণত করেছে। যেন স্বর্গদেবী হৃদয়ের সমস্ত প্রেম নিয়ে গড়েছে এ ফুলেল স্বর্গরাজ্য। যখন গ্রীষ্মের কাঠফাঁটা রৌদ্রে লোকারণ্যে অস্বস্তি বিরাজ করছে, ঠিক তখনই কৃষ্ণচূড়া, সোনালু ও জারুলের মনোরম দৃশ্য হৃদয় জাগানিয়া প্রশান্তির ডাক দেয়।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একুশ'শ একরের বিশাল ক্যাম্পাসের পুরোটা যেন কৃঞ্চচূড়ার রঙে রেঙেছে। সূর্যের সবটুকু উত্তাপ যেন কেড়ে নিয়েছে টুকটুকে লাল এই ফুল। ক্যাম্পাসে প্রবেশের আগেই ট্রেন স্টেশনে ডালপালা মেলে বিশাল আকৃতির কৃষ্ণচূড়া গাছটির শাখায় শাখায় রক্তবর্ণ ফুলের সমাহার যেনো অভ্যর্থনা জানাচ্ছে পথিককে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে ডানে-বাঁয়ে তাকালে কৃষ্ণচূড়া নজরে পড়বেই। তবে আইন অনুষদ, আইইআর ইন্সটিটিউট, কেন্দ্রীয় মসজিদ ছাড়াও টিচার্স কলোনির ওখানে বেশি চোখে পড়ে।

উষ্ণ আবহাওয়ায় দৃষ্টি ও মনকে শান্তির পরশ বুলিয়ে দিতে টকটকে লাল কৃষ্ণচূড়া ফুলের জুড়ি নেই। কৃষ্ণচূড়ার সৌন্দর্য উপলব্ধি করে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন, ‘কৃষ্ণচূড়ার রাঙা মঞ্জুরি কর্ণে-আমি ভুবন ভুলাতে আসি গন্ধে ও বর্ণে’। 

কৃষ্ণচূড়ার আদিনিবাস মাদাগাস্কার হলেও আবহমান বাংলার গ্রামে কিংবা শহরে অহরহ কৃষ্ণচূড়ার দেখা মেলে। বসন্তের শেষে গ্রীষ্মের আগমনী বার্তা নিয়ে চবি প্রকৃতিকেও নতুন করে সাজিয়ে তুলেছে রক্তিম কৃষ্ণচূড়া। কবিগুরু যথার্থই লিখেছেন ‘গন্ধে উদাস হওয়ার মতো উড়ে/ তোমার উত্তরী কর্ণে তোমার কৃষ্ণচূড়ার মঞ্জুরী।’এই পঙ্ক্তিমালাই চবির কৃষ্ণচূড়ার মোহনীয় রূপে মিশে আছে।

গ্রীষ্মের আগুন ঝরা ঝলমলে রোদে প্রস্ফুটিত হয় সজীব ও স্নিগ্ধ জারুল। ঘন সবুজ পাতার সন্নিবেশে থোকায় থোকায় অজস্র ফুলের সমারোহ। এই জারুল ফুলের ইংরেজি নাম ‘প্রাইড অব ইন্ডিয়া’। চবিতে জারুলের মনোরম বিচরণ হৃদয়ে আবেদন সৃষ্টি করে। প্রসঙ্গত, কবি জীবনানন্দ দাস রচিত পঙক্তিদ্বয় মনে পড়ে যায়- 'ভিজে হয়ে আসে মেঘে এ-দুপুর-চিল একা নদীটির পাশে/জারুল গাছের ডালে ব'সে ব'সে চেয়ে থাকে ওপারের দিকে।'

এক কথায় জারুল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে দৃষ্টিনন্দন ও মুগ্ধতার সন্নিবেশ গড়ে তুলেছে। চবিতে বর্ষার পূর্বমুহূর্তে গ্রীষ্মের এক অনন্য উপহার জারুল ও সোনালু। এই সোনালু ঠিক যেন কিশোরীর কানে হলুদ ঝুমকোর ন্যায় ঝুলছে। সোনালী রঙের ফুলবিশিষ্ট বৃক্ষে সোনালু ফুটে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর নাম দিয়েছিলেন অমলতাস। এ ফুলের আদিনিবাস হিমালয় অঞ্চল ধরা হলেও বাংলাদেশের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে শহরে সর্বত্রই সোনালুর দর্শন মেলে। তেমনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও তার ব্যতিক্রম নয়।

স্বর্ণালী রঙের সৌন্দর্য-শোভায় চবি ক্যাম্পাসকে আরো নয়নাভিরাম রূপে সাজায় সোনালু ফুল। থোকায় থোকায় প্রস্ফুটিত সোনালুতে সূর্যের কিরণ ঠিকরে পড়ে। সোনালু, জারুল আর কৃষ্ণচূড়ার আবহে যেন মৌ মৌ করছে। দৃষ্টি যতদূর যায় এই ত্রি-ফুলের শোভা হৃদয়কে শোভিত করবে।

জিরো পয়েন্ট থেকে শুরু করে পথের ধারে, পাহাড়ে বর্ণিল আভায় বিচরণ কৃষ্ণচূড়া, সোনালু ও জারুলের। গ্রীষ্মের তপ্ত রোদে বৃক্ষের ঢালে ঢালে কৃষ্ণচূড়া এক একটা আগুনের ফুলকির মতো। কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত বলেছেন, এই যে কুসুম শিরোপরে, পরেছি যতনে,/মম শ্যাম-চূড়া-রূপ ধরে এ ফুল রতনে!/বসুধা নিজ কুন্তলে পরেছিল কুতূহলে/এ উজ্জ্বল মণি,/রাগে তারে গালি দিয়া,/লয়েছি আমি কাড়িয়া-মোর কৃষ্ণ-চূড়া কেনে পরিবে ধরণী?

দিনের শেষান্তে সূর্য যখন পশ্চিমাকাশে হেলে পড়ে, তখন চবিতে জারুলকে দেখে মনে হয় এক টুকরো বেগুনাভ মেঘ আকাশ ছুঁয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের জারুলতলা, জয় বাংলা চত্বর, সমাজবিজ্ঞান অনুষদ, বিজ্ঞান অনুষদের সড়ক, আইন অনুষদ প্রাঙ্গণ, আইইআর ইনস্টিটিউটের সক্রেটিস চত্ত্বর, কেন্দ্রীয় খেলার মাঠ প্রাঙ্গণ এবং দক্ষিণ ক্যাম্পাসসহ প্রায় পুরো ক্যাম্পাস সজ্জিত হয়েছে জারুল, কৃষ্ণচূড়া ও সোনালুর সমারোহে। দিনভর সকল বয়সি লোক ভীড় করে ফুলের সঙ্গে
নিজের একটি মুহূর্তকে বন্দি করতে।

প্রত্যহ ভোরে সুউচ্চ বৃক্ষরাজির নিচে সহস্র জারুল, কৃষ্ণচূড়া ঝরে পড়ে। ঝরে পড়া জারুলের মাঝেই দেখা মেলে কপোত-কপোতীর মুক্ত বিচরণ। জারুল যেন তাদেরই অনিন্দ্য প্রেমের সাক্ষ্য বহন করে। প্রেমিক যুগল হাত ধরে হাঁটার মুহূর্তে এক থোকা কৃষ্ণচূড়া কিংবা সোনালুই হয় তাদের গল্পের নির্বাক শ্রোতা।এ যেন "কৃষ্ণচূড়া লাল হয়েছে ফুলে ফুলে, তুমি আসবে বলে' গানের ই বাস্তব প্রতিফলন। শুধু প্রেমিক যুগলই নয়, পড়ন্ত বিকেলে চবিতে হাঁটতে আসা প্রবীণদেরও হৃদয়েও
ফুলেল সমারোহ স্নিগ্ধতা জাগায়। টকটকে লাল কৃষ্ণচূড়া তাঁদের ভরাট যৌবনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।

উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী রিমু দেবী বলেন, রঙিন ফুলে ফুলে আচ্ছাদিত হয়েছে পুরো ক্যাম্পাস। ফুটন্ত কৃষ্ণচূড়া ক্যাম্পাসের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে বহুগুণে। বিশ্ববিদ্যালয় জুড়ে কৃষ্ণচূড়া, জারুল, সোনালু ফুলে যে রঙ ছড়িয়েছে তা চোখে না দেখলে ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। সারাদিনের ক্লাস-পরীক্ষা শেষে ডিপার্টমেন্ট থেকে হলে ফেরার পথে এসব বাহারী ফুল আমাদের দুদণ্ড শান্তি দেয়।

লেখক-চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ স্টাডিজ বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।