ঢাকা, শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ১২ ১৪৩১

প্রয়াণ বার্ষিকীতে স্মরণীয় শিক্ষানুরাগী-দানবীর অমৃত লাল দে 

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১১:৪৮ এএম, ১৪ জুন ২০২২ মঙ্গলবার | আপডেট: ১২:৫৮ পিএম, ১৪ জুন ২০২২ মঙ্গলবার

তার কাছে ছিল না কোনো জাত-পাতের ব্যবধান। দুই যুগের বেশি আগে লোকান্তরিত হলেও মানুষের প্রতি অসীম ভালোবাসাই তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে এখনো। তিনি প্রখ্যাত দানবীর ও শিক্ষানুরাগী অমৃত লাল দে, যিনি ছিলেন সবার ‘বড় কাকু’।  

মহৎ এই মানুষটির ২৯তম প্রয়াণ বার্ষিকী ১৪ জুন। 

শুধু শ্রমের মাধ্যমে পাহাড়সম দারিদ্র্যকে পেছনে ফেলে তিনি হয়ে উঠেছিলেন অসুস্থ, দরিদ্র শিক্ষানুরাগীদের ভরসার জায়গা। তার সহযোগিতায় এখন শত শত অসহায় রোগী পাচ্ছে বিনামূল্যে চিকিৎসা। তার প্রচেষ্টায় গড়ে উঠেছে অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। 

অমৃত লাল দে ১৯২৪ সালের ২৭ জুন তৎকালীন ফরিদপুর জেলার আঙ্গারিয়া গ্রামের একটি দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম রাসমোহন দে এবং মা সারদা দেবী। বাবা ছিলেন সাধারণ কৃষক। অমৃত লালসহ পাঁচ সন্তান ছিল রাসমোহনের। একান্নবর্তী সংসারের ব্যয়ভার বহন করতে হিমশিম খেতে হতো তাকে। অর্থাভাবে লেখাপড়াও বন্ধ হয়ে যায় অমৃত লালের। অনেকটা বিনা চিকিৎসায় মায়ের মৃত্যু পাল্টে দেয় তার জীবন। ১৯৩৯ সালে ১৫ বছরের কিশোর অমৃত লাল দে পরিবারে দেখেন অভাবের তীব্রতা। অসুস্থ বাবা কাজে যেতে পারতেন না।

তার দূরসম্পর্কের ভাই বলরাম বিড়ির কারখানায় কাজ করতেন। তার সহযোগিতায় কার্তিকপুর বাজারে একটি বিড়ির কারখানায় কাজ শুরু করেন অমৃত লাল। দিন-রাত পরিশ্রম করেও সংসারের অভাব দূর করতে পারলেন না। ১৯৪২ সালে দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। গ্রামে তার বিড়ির কাজ বন্ধ হয়ে গেল। গ্রামে কাজ না থাকায় কাজের সন্ধানে বরিশালে আসেন অমৃত লাল। কাজ নেন কালিবাড়ী রোডস্থ জীবন বিড়ি ফ্যাক্টরিতে। সেখানে প্রতিদিন দুই টাকার মতো আয় হতো তার। জীবন বিড়ি কারখানার ম্যানেজার সুরেশ বাবু কালিবাড়ী রোডে একটি নতুন দোকান নিলেন। সেই দোকানে ম্যানেজারের পদে অমৃত লালের চাকরি হলো মাসিক ৬০ টাকা বেতনে। তার সঙ্গে অতিরিক্তভাবে বিড়ি বেঁধে আরো মাসে ৫০-৬০ টাকা আয় হতো। কিন্তু সংসারে সচ্ছলতা উঁকি দিতেই জীবন বিড়ির মালিক তাকে ম্যানেজারের পদ থেকে সরিয়ে এক নিকটাত্মীয়কে বসান, অমৃত লাল আবার বিড়ি বাঁধার দায়িত্ব পেলেন।

এরই মধ্যে একটি দোকান নিয়েও অর্থাভাবে তা চালু করতে পারছিলেন না। বন্ধু অনন্ত কুমার দাস কলকাতা থেকে ফিরলেন। দুজনে মিলে ঠিক করলেন পান-বিড়ির দোকান খুলবেন। ১২ টাকা পুঁজি নিয়ে গরিব ও দুস্থ মানুষের সেবা, একটি সমৃদ্ধিশালী দেশ গঠন ও শৃঙ্খলাবোধ- এই তিনটি আদর্শকে সামনে রেখে ১৯৪৮ সালে বরিশালের বিবিরপুকুর এলাকায় বন্ধুর সঙ্গে মিলে নিজ হাতে বিড়ি তৈরি করে তা বিক্রি শুরু করেন অমৃত লাল দে। ধীরে ধীরে সেই প্রতিষ্ঠান দক্ষিণ বাংলার অন্যতম বৃহৎ প্রতিষ্ঠানে রূপ নেয়। নাম তার কারিকর বিড়ি ফ্যাক্টরি।

জীবনের অন্তিম অধ্যায়ে অমৃত লাল দে মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি তাঁর সার্থক সমাপ্তি টানলেন। নিজের নামে মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর ১৯৯৩ সালের ১৪ জুন (৩০ জ্যৈষ্ঠ ১৪০০) ক্ষণজন্মা এই মহাপুরুষ পাড়ি জমান পরপারে। তবে তাঁর কীর্তি আর মানবসেবা অনুসরণ করে হাঁটছেন সাদা মনের মানুষ ছোট ভাই বিজয় কৃষ্ণ দে। 

কারিকর বিড়ি ফ্যাক্টরি ও অমৃত ফুড প্রডাক্ট-এর ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর ভানু লাল দে (ভাতিজা) জানান, প্রতিবছর অন্তত অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী অমৃত পরিবারের অনুদানে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করছে।

এরই ধারাবাহিকতায় অমৃত লাল দের ভাই রাখাল চন্দ্র দে ও বিজয় কৃষ্ণ দে নগরে প্রতিষ্ঠা করেছেন অমৃত লাল দে কিন্ডারগার্টেন। ১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেন অমৃত লাল দে আয়ুর্বেদ ও ইউনানি মহাবিদ্যালয় ও অমৃত লাল দে সংগীত একাডেমি। এ ছাড়া অমৃত-যোগমায়া আধ্যাত্ম চর্চা এবং অমৃত লাইব্রেরিও প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।

অমৃত লাল দে শিখিয়েছেন দুস্থ মানুষের পাশে দাঁড়াতে। ১৯৮৮ ও ১৯৯০ সালে বন্যার সময় বানভাসি মানুষের পাশেও ছিলেন তিনি। প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় সিডর যখন দক্ষিণাঞ্চলসহ গোটা দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতিকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে তখন অমৃত পরিবার সাধ্যানুযায়ী ত্রাণসামগ্রী নিয়ে ছুটে গিয়েছে দুর্গত মানুষের পাশে। অমৃত পরিবার সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের হাতে পৌঁছে দেয় ত্রাণসামগ্রী। 

মানুষের প্রতি এই ভালোবাসা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে অব্যাহত রাখতে চায় অমৃত লাল দের পরিবার।  
এএইচএস/ এসএ/