ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৪ ১৪৩০

আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী: স্বাধিকার সংগ্রামের ৭৩

ড. অখিল পোদ্দার

প্রকাশিত : ১২:১১ পিএম, ২৩ জুন ২০২২ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ১২:৫৯ পিএম, ২৩ জুন ২০২২ বৃহস্পতিবার

শত সংগ্রাম, আন্দোলন, ঐতিহ্য আর অর্জনের নাম আওয়ামী লীগ; শুধু যে দক্ষিণ এশিয়া তা কিন্তু নয়, পৃথিবীর বহু দেশের মানুষের কাছে আওয়ামী লীগের ইতিহাস-বিকাশ ও রাজনীতি ঐতিহ্যের স্মারকও বটে।

বৃটিশ ভারত থেকে পাকিস্তান জন্মের পর ১৯৪৯ এ ঢাকায় মুসলিম লীগের রাজনীতি দেখভাল করতেন মাওলানা আকরাম খান আর খাজা নাজিমুদ্দিন। কালিক পরিক্রমায় ৪৭ সালে হয়েছিল দেশ ভাগ। আর কাছাকাছি সময়ে অর্থাৎ ৪৬ সালে শেখ মুজিবের গ্রাজুয়েশন। তাই কলকাতা ছাড়তে হয়েছিল ইসলামিয়া কলেজের তরুণ-তুখোর ছাত্র মুজিবের। পূর্ব বাংলায় ফিরে ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বরে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিভাগ আইন। রোল ১৬৬। সমসাময়িক আড্ডার জায়গাটি ছিল চকমোগলটুলি। বাড়ির হোল্ডিং নম্বর ১৫০। সেখান থেকে বাইসাইকেলে ক্লাস করতে আসতেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। মোগলটুলির ঐ বাড়িটিতে যাঁরা আসা যাওয়া করতেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আর মুক্তচিন্তার প্রতীক আবুল হাশেম। 

উদারপন্থী এসব নেতাদের রাজনৈতিক ব্যানার তখন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ হলেও দলের অভ্যন্তরেই এঁরা ছিলেন কোণঠাসা। কারণ মুসলিম লীগের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে মেধাবী দলটি ছিলেন সদা সোচ্চার।  রাজনৈতিক অন্ধকার থেকে বের হতে সুচিন্তার নেতৃবৃন্দ নিজেদের মধ্যে দেনদরবার শুরু করেন। রক্ষণশীল অংশ মুসলিম লীগের মতো গতানুগতিক ধারায় রাজনীতি করার পক্ষে মত দিলেও প্রগতিশীলরা সামন্ত  ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী গণতান্ত্রিক দল গঠনের পক্ষে সোচ্চার হন। তাই তারা দলের নাম থেকে 'মুসলিম' শব্দটি বাদ দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ দল গঠনের পক্ষপাতী ছিলেন। ঐ শিবিরে তখন যোগ দিয়েছিলেন সদ্য কলকাতা ফেরত শেখ মুজিবুর রহমান। যিনি দিনে দিনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিলেন দলের অন্যদের কাছে।  

প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ পদত্যাগ করলে টাঙ্গাইলের আসনে উপনির্বাচন হয়। দু’দফায় মুসলিম লীগ প্রার্থীকে হারিয়ে দেন মওলানা ভাসানী আর শামসুল হক। এরপরও তখনকার নির্বাচন কমিশন এদের ফল বাতিল করে অবৈধ ঘোষণা করে সে নির্বাচন। পোড় খাওয়া নেতা ভাসানী আর শামসুল হক অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে বিকল্প খোঁজেন। জড়ো হন ১৫০ মোগলটুলির অসাম্প্রদায়িক চেতনার স্রোতে। এ বাড়ির মালিক ছিলেন শওকত আলী। শোষণমুক্ত দেশ ও সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কর্মী শিবিরের সঙ্গে তিনিও স্বপ্ন দেখেন নতুন ভাবনা আর নতুন কোনো দেশের। মুসলিম লীগের দমননীতি আর অসহিষ্ণু কার্যকলাপ, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির উপর আক্রমণ, জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি, পূর্ব বাংলার দুর্ভিক্ষ মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। দেশ পরিচালনায় মুসলিম সরকারের ব্যার্থতা অন্যদেরকে ভাবিয়ে তোলে। রাজনৈতিক দমননীতি ঐ সময় শিক্ষিত ও প্রগতিশীল সমাজকে উদ্বিগ্ন করে তোলে। মুসলিম কর্মীরা মিলে নয়া রাজনৈতিক দল গঠনের অভিপ্রায় ব্যক্ত করলে সভা ডাকার সিদ্ধান্ত হয়। যার প্রস্তুতি কমিটির সভাপতি ছিলেন মওলানা ভাসানী। সাধারণ সম্পাদক হন ইয়ার মোহাম্মদ খান। সবকিছু ঠিকঠাক। কিন্ত সভা করবেন কোথায়? এই নিয়ে সবার মধ্যে আলোচনা-গুঞ্জন।  

পুরোন ঢাকার কে এম দাশ লেনের দৃষ্টিনন্দন বাড়ি তখন রোজ গার্ডেন। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন বিকেলে প্রায় তিনশ লোকের উপস্থিতিতে আদর্শবাদী দল গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। যে দলের নাম হয় ‘পুর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ।’ সভাপতি হন মওলানা ভাসানী আর সাধারণ সম্পাদক হন শামসুল হক। পুরো পাকিস্তানের জন্য দলটির নাম রাখা হয় নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ। যার সভাপতি নির্বাচিত হন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী।

ঐ সময় পূর্ব পাকিস্তান সরকারের এডভোকেট জেনারেল ছিলেন এ কে ফজলুল হক। কিছুক্ষণের জন্য তিনিও উপস্থিত ছিলেন রোজ গার্ডেনের সভায়। তাঁর পদটি এটর্নি জেনারেলের মর্যাদাসম্পন্ন হওয়ায় অল্প সময় থেকে তিনি সভাস্থল ত্যাগ করেন।

দলটির নয়া সভাপতি পরদিন অর্থাৎ ২৪ জুন বিকেলে আরমানিটোলা মাঠে প্রকাশ্য জনসভা ডাকেন। যেখানে প্রায় ৪ হাজার লোক উপস্থিত ছিলেন। হিংসার বশবর্তী হয়ে মুসলিম লীগের কর্মীরা সে জনসভায় হামলা করে। শেখ মুজিবুর রহমান তখন কারাগারে। জেলে থেকেই তিনি যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন আওয়ামী মুসলিম লীগের। কমিটি হয় ৪০ জনের। কোষাধ্যক্ষ হয়েছিলেন ইয়ার মোহাম্মদ খান। রোজ গার্ডেনের মালিকও ছিলেন তিনি। 

দল গঠনের পর কেউ কেউ কথা তুলেছিলেন মুসলিম শব্দটি বাদ দেয়ার। কারণ ঐ সময় নির্বাচন হতো হিন্দু মুসলমান আসনে আলাদাভাবে। যে কারণে ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে সমঝোতা হয়েছিল, এই দলটি হবে পরিপূর্ণ অসাম্প্রদায়িক। যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে বিজয়ের পর ১৯৫৫ সালের ২১ থেকে ২৩ সেপ্টেম্বর ঢাকার সদরঘাটের রূপমহল সিনেমা হলে আওয়ামী মুসলিম লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ঐ সম্মেলনে মুসলিম শব্দ বাদ গেলে অমুসলিমরাও যোগ দিতে শুরু করেন। সর্বধর্মের রাজনৈতিক প্ল্যাটফরম হিসেবে পরিগনিত হয় আওয়ামী লীগ। সেই থেকে বাঙালির অধিকার আদায়ের সংগ্রামে গণমানুষের সংগঠনে রূপ নেয় আওয়ামী লীগ। প্রবাসী সরকারের নথিপত্রে ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’ শব্দ ব্যবহার শুরু হয় স্বাধীনতা ঘোষণার পর থেকে।  

নেপথ্যের ইতিহাস বলছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দলটির সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন ১৯৫২ সালে। দলের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক অসুস্থ হয়ে পড়লে বঙ্গবন্ধু ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব পালন করেন। পরের বছর অর্থাৎ ১৯৫৩ সালে দলের প্রথম কাউন্সিলে সভাপতি হন মওলানা ভাসানী আর সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন শেখ মুজিবুর রহমান। মুকুল সিনেমা হলে অনুষ্ঠিত হয়েছিল আওয়ামী মুসলিম লীগের সেই সম্মেলন। 

টানা ৬৬ সাল অব্দি দলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন শেখ মুজিব। মওলানা ভাসানী পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেন ১৯৫৭ সালের ১৮ মার্চ। গঠন করেন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপ। ঐ সময় ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হন মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ। মুজিব সাধারণ সম্পাদক পদেই থাকেন। ১৯৬৪ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়াদীর মৃত্যুর পর আওয়ামী লীগ আবার পূনর্গঠন হয়। ঐ বছরে অনুষ্ঠিত কাউন্সিলে তর্কবাগীশ পুরোপুরি সভাপতি নির্বাচিত হন। মুজিব আবার হন সাধারণ সম্পাদক। ১৯৬৬ সালে ছয় দফা কর্মসূচি ঘোষণা হলে আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশসহ অনেকেই ৬ দফার বিরোধিতা করেন। দলের কাউন্সিল অধিবেশনে প্রথমবারের মতো শেখ মুজিবুর রহমান সভাপতি নির্বাচিত হন ১৯৬৬ সালে। সাধারণ সম্পাদক হন তাজউদ্দিন। যারা ছয় দফার বিরোধিতা করেছিলেন তাদের অনেকেই আওয়ামী লীগ ছেড়ে চলে যান। অথচ ছয় দফার পক্ষের নেতাদের হাত ধরেই পরবর্তীতে স্বাধীন হয় বাংলাদেশ।   

এ দলের নেতাদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহনে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে বিজয়, ১৯৬২ সালের শিক্ষা অধিকার আন্দোলন, ৬৪ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে শেখ মুজিবসহ অন্যদের সক্রিয় ভূমিকা আজও ইতিহাসের অনন্য উপাদান। ১৯৬৫ সালে সংগঠিত ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের বাস্তব অভিজ্ঞতা মাথায় রেখে পরের বছর ৬৬ সালের ফেবরুয়ারিতে বাঙালির মুক্তির সনদ হিসেবে শেখ মুজিব ৬ দফা কর্মসূচি উত্থাপন করেন। এরই রূপরেখায় ৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে আওয়ামী লীগ। এই দলটির তত্ত্বাবধানে পরবর্তীতে অনুষ্ঠিত হয় স্বাধীনতা যুদ্ধ। 

১৯৪৯ সালের ২৩ শে জুন দৃষ্টিনন্দন রোজ গার্ডেনে আওয়ামী লীগ নামের যে রাজনৈতিক ফুল ফুটেছিল, কাঁটাবিছানো বহু পথ পাড়ি দিয়ে সেই দল এখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রদায়িত্বে। উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন রাজনৈতিক দলটি গোলাপের মতোই সৌন্দর্য আর ঘ্রাণ ছড়াচ্ছে দেশ পেরিয়ে বিশ্বময়। ৪২ বছর ধরে এ দলের অন্যতম কাণ্ডারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা।

লেখক: প্রধান বার্তা সম্পাদক, একুশে টেলিভিশন।