ঢাকা, শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ৬ ১৪৩১

শান্তি ও সমৃদ্ধির পথে জম্মু-কাশ্মীর

মোহাম্মদ আবদুল হালিম

প্রকাশিত : ০৪:৩৪ পিএম, ৩ আগস্ট ২০২২ বুধবার | আপডেট: ০৪:৩৫ পিএম, ৩ আগস্ট ২০২২ বুধবার

তিন বছর হয়ে গেল বিশেষ সুবিধার বাইরে ভারতের জম্মু ও কাশ্মীরের মানুষ। কেমন আছে তারা? 

সংবিধানের যে অনুচ্ছেদে কাশ্মীরের জন্য বিশেষ সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছিল ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট সংবিধানের বিশেষ সংশোধনীর মাধ্যমে তা রোহিত করার ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ভারত সরকার। 

সংবিধানের সেই ৩৭০ এবং ৩৫/এ অনুচ্ছেদ রোহিত করার দৃঢ় সিদ্ধান্তের পর পেরিয়ে গেছে তিন বছরের বেশি সময়। তবে অল্প এ সময়ের মধ্যেই সব শঙ্কা দূরে ঠেলে জম্মু-কাশ্মীরে দেখা গেছে উল্লেখ করার মতো বেশকিছু পরিবর্তন। 

বিক্ষুব্ধ পরিস্থিতির কারণে জম্মু ও কাশ্মীর সবসময় আলোচনায় থাকলেও ভারতের অন্যান্য শহরের মতো মৌলিক অবকাঠামোগত উন্নয়ন সহায়তা সেখানে পর্যাপ্ত ছিল না। এর বেশকিছু কারণও ছিল। বিচ্ছিন্নতাবাদ এবং সীমান্ত সন্ত্রাস ছিল একটি বড় অন্তরায়। সেই সঙ্গে রাজ্য নেতাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের দুর্বলতা ও লক্ষ্য নির্ধারণে দক্ষতার অভাবও খানিকটা দায়ী ছিল। 

কিন্তু ৩৭০ ধারা স্থগিত করার ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের পর এ অঞ্চলের অবকাঠামো ও সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে দ্রুত অগ্রগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট রাজ্যটিকে জম্মু-কাশ্মীর এবং লাদাখ নামে আলাদা করার পর থেকেই স্থানীয় কর্তৃপক্ষ সামাজিক কল্যাণমূলক প্রকল্পগুলোর দিকে বিশেষ নজর দিয়েছে।

এর মধ্যে কেন্দ্রশাসিত জম্মু ও কাশ্মীরে প্রধানমন্ত্রীর উন্নয়ন প্যাকেজ-২০১৫ এর আওতায় প্রকল্পগুলোর প্রতি জোর দেওয়া হয়েছে। সড়ক, রেল, সেতু, বিদ্যুৎ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পর্যটন, কৃষি, দক্ষতা উন্নয়নসহ বিভিন্ন খাতে ৫৮,৪৭৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৫টি মন্ত্রণালয়ের ৫৩টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে, যার মধ্যে ২৯টি প্রকল্প ইতিমধ্যেই সম্পন্ন হয়েছে। 

‘অমৃতকাল’ নামে যখন স্বাধীনতার ৭৫ বছর উদযাপন করছে ভারত, তখনও এর রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা রয়ে গেছে ঔপনিবেশিক যুগের। এই পুরনোকে বদলে দিতে ১,৩২৭ কোটি রুপি ব্যয়ে বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু রেলসেতু (চেনাব সেতু) তৈরি হচ্ছে উধমপুর-শ্রীনগর-বারামুল্লা রেল সংযোগ প্রকল্পের অধীনে। প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার পথে।

এছাড়া কাশ্মীর উপত্যকা এবং এর চারপাশ ঘিরে একটি ট্রানজিট করিডোর আগামী চার বছরের মধ্যে গড়ে তোলার পরিকল্পনাও রয়েছে। 

যেকোনো মূল্যে উন্নয়ন- এ লক্ষ্য সামনে রেখে ভারত সরকার এই অঞ্চলের জনগণের জন্য উন্নত অবকাঠামোগত সুবিধা নিশ্চিতে বিশেষ জোর দিয়েছে।

একটি পিছিয়ে পড়া অঞ্চল কতটা দ্রুততার সাথে আত্মনির্ভরশীল হতে পারে তার ওপরই নির্ভর করে সেই অঞ্চলের উন্নয়নযাত্রার অব্যাহত থাকার বিষয়টি। তাই জম্মু-কাশ্মীরের জন্য ১৫ বছর মেয়াদী একটি নতুন কেন্দ্রীয়-আঞ্চলিক পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে। এর আওতায় একটি নতুন ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রমোশন স্কিম বাস্তবায়ন করা হবে। 

এই পরিকল্পনার লক্ষ্য হলো বাণিজ্যের পাশাপাশি ক্ষুদ্র-উদ্যোগের একাধিক সুযোগ তৈরি করা। অর্থাৎ এর মাধ্যমে সরকার আরও ভারসাম্যপূর্ণ আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন মডেল প্রতিষ্ঠা করতে চায়। উদ্দেশ্য, ৫-৬ লাখ কর্মসংস্থান তৈরি করা এবং উৎপাদন ও পরিষেবা খাতে বিনিয়োগে গতি আনা। 

এই ক্ষেত্রে দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প স্বল্প সময়ের মধ্যে সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। একটি জম্মু-শ্রীনগর-লাদাখ জাতীয় মহাসড়কের কাজিগুন্ড-বানিহাল টিউব টানেল এবং আরেকটি সোনমার্গ এবং গাগাঙ্গীরের মধ্যে জেড-মোরহ টানেল।

অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি সামাজিক উন্নয়নেও দৃষ্টি দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সমাজের সব শ্রেণিকে একত্রিত করা এবং সমান আচরণ এবং অধিকার সুরক্ষার ক্ষেত্রে কোনো অযৌক্তিক শ্রেণিবিন্যাস থাকবে না, তা নিশ্চিত করা হয়েছে। 

ঐতিহাতিকভাবেই এ অঞ্চলের বিপুল সংখ্যক দলিত, উপজাতি এবং নারীরা অবহেলিত, পশ্চাৎপদ। এখন তাদের সুরক্ষা এবং সম্মান নিশ্চিত করা হয়েছে। এই ধরনের অনেক অধিকার নিশ্চিতে ১৫৩টিরও বেশি আইন বাতিল করে ১৬০টিরও বেশি কেন্দ্রীয় কল্যাণ আইন প্রবর্তন করা হয়েছে।

সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো- গ্রামীণ নারীদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে তুলতে নেওয়া হয়েছে প্রকল্প, যার ফল এরই মধ্যে কিছু কিছু আসতে শুরু করেছে। 

সন্ত্রাসবাদ থেকে নারীদের সুরক্ষিত রাখার বিষয়টি নিয়ে সরকারের একটি দুশ্চিন্তা ছিল। এজন্য বাস্তবায়ন করা হচ্ছে এসএএটিএইচ প্রকল্প (স্ট্রেনদেনিং অ্যান্ড মেনটরিং ওমেন এসএইজি অব জেঅ্যান্ডকে)।নারী উদ্যোক্তারা যাতে তাদের ব্যবসাকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে এবং নিজিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সেজন্য তাদের দক্ষ করে তোলা হচ্ছে এই প্রকল্পের আওতায়। 

এরইমধ্যে প্রকল্পটির সফলতা মিলতে শুরু করেছে। কয়েক বছর আগেও যেসব অঞ্চলে সন্ত্রাসীদের দাপট ছিল, সেসব এলাকায় উদ্যোক্তা তৈরির মাধ্যমে নারীবান্ধাব একটি ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে।

গেল দুই বছরে জম্মু-কাশ্মীরের স্বাস্থ্যখাতেরও উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন হয়েছে। মূলত বারামুল্লা ও আনন্তনাগে সাতটি নতুন মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার পরই এই পরিবর্তন এসেছে। এসব প্রতিষ্ঠানে ১৪০০ এর বেশি প্যারামেডিক আসন রয়েছে। এছাড়া অবন্তীপুর ও সাম্বায় এআইআইএমএসের (অল ইন্ডিয়া ইন্সটিটিউট অব মেডিকেল সাইন্স) দুইটি কেন্দ্র এবং পাঁচটি নার্সিং কলেজ ও একটি ক্যান্সার ইন্সটিটিউট গড়ে তোলার কাজও চলছে। স্কুলগামী শিশুদের সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা নিশ্চিতে চালু করা হয়েছে স্টুডেন্ট হেলথ কার্ড স্কিম। এরইমধ্যে এ অঞ্চলের ৮ লাখ শিশু এই কার্ডের সুবিধা পেয়েছে। 

এ অঞ্চলের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নেও নজর দিয়েছে কেন্দ্র। এরই মধ্যে কাংক্রম শুরু করেছে ইনডিয়ান ইনিস্টিটিউট অব টেকনলজি জম্মু এবং ইনডিয়ান ইনিস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট জম্মু। স্নাতক এবং প্রকৌশল পর্যায়ের সরকারি কলেজের সংখ্যা ৯৬টি থেকে বেড়ে হয়েছে ১৪৭টি।

এসব উদ্যোগের ফলে প্রশাসনের ওপর জম্মু ও কাশ্মীরের মানুষের আস্থা ফেরানো সম্ভব হয়েছে।ভারত সরকারের নেওয়া সমন্বিত উদ্যোগ একটা সময় এ অঞ্চলের মানুষের মন জয় করতে সক্ষম হবে আশা করা যায়। 

ভারত সরকার এ অঞ্চলে শান্তি, শৃঙ্খলা ও উন্নতির পাশাপাশি জনগণের অর্থবহ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে কতটা উদগ্রীব তা এসব পদক্ষেপেই পরিষ্কার। 

এএইচএস