ঢাকা, মঙ্গলবার   ৩০ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ১৬ ১৪৩১

নির্বাচন এবং আর্ট অব অ্যাসোসিয়েটিং টুগেদার

ড. অরুণ কুমার গোস্বামী

প্রকাশিত : ০৩:২৭ পিএম, ৩ সেপ্টেম্বর ২০২২ শনিবার

দৃশ্যপট ১: ১৯৭৫ সালের মধ্য আগস্ট। স্বাধীন বাংলাদেশের বয়স তখন মাত্র সাড়ে তিন বছর। এর আগে কন্সটিটিউয়েন্ট এসেম্বলিতে ১৯৭২ সালে দেশটির সংবিধান অনুমোদিত হয়েছে। সেই সংবিধান অনুযায়ী ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সুতরাং পঁচাত্তরের মধ্য আগস্টে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সেই নির্বাচিত সরকারই দেশ পরিচালনা করছিলেন। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচিত সরকারের মেয়াদ পাঁচ বছর। হিসাব অনুযায়ী প্রথম জাতীয় সংসদ এবং প্রথম জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকারের মেয়াদ ছিল ১৯৭৮ সালের ৭ মার্চ পর্যন্ত।

কিন্তু ষড়যন্ত্রকারী এবং বাংলাদেশ বিরোধীগোষ্ঠী গণতন্ত্রে বিশ্বাস রাখে নাই। যদিও ভণ্ডামী করে মুখে তারা গণতন্ত্রের কথা বলেছে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে এবং আসলে তারা নির্বাচনের মাধ্যমে পরিবর্তনের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী নয়। তাই তারা নির্বাচিত সরকার প্রধান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে। এইসব খুনি ও তাদের সমর্থক-বেনিফিশিয়ারিগণ এবং হত্যার শিকার রাষ্ট্রপ্রধানের বেঁচে যাওয়া সন্তান ও অনুসারীদের অ্যাসোসিয়েটেড বা একত্রে থাকা এবং একত্রিত হওয়া বা অ্যাসোসিয়েটিং টুগেদার একটি অসম্ভব ব্যাপার নয় কি? খুনিদের সমর্থক এবং খুনের শিকার ভিক্টিমদের অনুসারীদের একত্রিত হওয়ার এবং একত্রে থাকা বা মেলামেশা করার কোনো শিল্প বা আর্ট হতে পারে কী? যদিও বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত এই জাতি-রাষ্ট্রের অধিবাসী এবং নাগরিকদের একত্রিত হওয়ার এবং থাকার জন্য একটি আর্ট বা শিল্প প্রয়োজন! কিন্তু তা কীভাবে সম্ভব?

দৃশ্যপট ২: ২০০৪ সালের আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহ। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকদের নির্মম বুলেটে নিহত নির্বাচিত সরকার প্রধানের সুযোগ্য সন্তান এবং অনুসারীগণ ২০০৪ সালে বিরোধী দলে। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের হোতা, বেনিফিশিয়ারি ও সমর্থক বিএনপি-জামাত গোষ্ঠী তখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়।  এবারেও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে ব্যবহার করে বিরোধী আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য তথা নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্র করে ২১ আগস্ট বিরোধী দলের সভায় প্রকাশ্যে গ্রেনেড হামলা করে ২৪ জন নেতা-কর্মীকে হত্যা করা এবং দলীয় প্রধান বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনাসহ কয়েকশ’ নেতা-কর্মী আহত হয় এবং জীবনের তরে পঙ্গু হয়ে যায়। ১৯৭৫ এর মত ২০০৪ সালের এই আক্রমণ কোনো বিবেচনাতেই গণতন্ত্রসম্মত নয়! আক্রমণকারী সেসময়ের বিএনপি-জামাত জোট সরকার মুখে গণতন্ত্রের কথা যতই বলুক কার্যক্ষেত্রে ষড়যন্ত্রকারী, অগণতান্ত্রিক এবং স্বৈরাচারী গোষ্ঠী হিসাবেই তাদের পরিচিতি দেশের গণতন্ত্রের ইতিহাসে ঠাঁই করে নিয়েছে। এখানেও সেই একই প্রশ্ন ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা এবং হত্যার শিকার হওয়া ব্যক্তিবর্গের ভাই-বোন, মাতা-পিতা, আত্মীয়-স্বজন এবং আহত হওয়া নেতা-কর্মী ও তাদের কোটি কোটি অনুসারীদের পক্ষে হামলার হোতা বিএনপি-জামাত জোটের সাথে অ্যাসোসিয়েটেড বা একত্রিত হয়ে মেলামেশা করা কীভাবে সম্ভব? অথচ একই সমাজে বিরোধী মতামত থাকলেও তাদের আর্ট অব অ্যাসোসিয়েশন খুবই প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধু যেমনটি বলতেন, ‘যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে সংখ্যায় একজনও যদি সে হয়, তাহলেও তার কথা আমরা মেনে নেব।’ কিন্তু হত্যাকারী এবং হত্যার শিকার এই দুই পক্ষ এক সাথে মিলেমিশে এক সমাজে কীভাবে থাকতে পারে?

যাহোক, যে অগণতান্ত্রিক ও দেশ-বিরোধী গোষ্ঠী উপরোল্লিখিত ঘটনাগুলো ঘটিয়েছে বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য, তারাই আরও ১৯ বার ষড়যন্ত্রমূলক আক্রমণ করেছে। স্রষ্টার অসীম দয়ায় এবং নেতাকর্মীদের কারণে তিনি বেঁচে গিয়েছেন। ফলে তার নেতৃত্বের সুফল বাংলাদেশ, বাংলাদেশের জনগণ এবং আমরা পাচ্ছি। এই পরিস্থিতিতে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে পরবর্তী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সমাগত। নির্বাচনকে সামনে নিয়ে উপরোল্লিখিত অগণতান্ত্রিক গোষ্ঠী আবার ‘মুখে’ গণতন্ত্রের খই ফুটাচ্ছে। কিন্তু অতীতের ঘটনাগুলো তাদের ষড়যন্ত্রমূলক অগণতান্ত্রিক কর্মকান্ডের সাক্ষ্য প্রদান করছে। এহেন পরিস্থিতিতে, এক দিকে দেশের জন্য কল্যাণ ও উন্নতি বয়ে আনা বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা, অপরদিকে উপরোল্লিখিত অগণতান্ত্রিক শক্তির ষড়যন্ত্রমূলক তৎপরতা। এর ফলে কোন ধরনের আর্ট অব অ্যাসোসিয়েশন গড়ে ওঠবে?

অগণতান্ত্রিক শক্তির দাবি হচ্ছে, অনির্বাচিত সরকারের অধীনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। এটি মূলত বাংলাদেশের রাজনীতিতে অবিশ্বাস বা অনাস্থাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার দাবি। গণতন্ত্রের অন্যতম অবলম্বন বিশ্বাস বা আস্থার সূত্র ধরেই আসে আর্ট অব অ্যাসোসিয়েটিং টুগেদার বা একত্রে মেলামেশা করার শিল্পর প্রসঙ্গ।

বিষয়টি উপলব্ধি করেই অ্যালেক্স ডি টকভিল (১৮০৫-১৮৫৯) বলছেন, ‘মানব সমাজকে শাসন করে এমন আইনগুলোর মধ্যে এমন একটি রয়েছে যা অন্য সবগুলোর চেয়ে আরও সুনির্দিষ্ট এবং স্পষ্ট বলে মনে হয়। মানুষকে যদি সভ্য থাকতে হয় বা হতে হয় তাহলে একত্রে মেলামেশার শিল্পকে (আর্ট অব অ্যাসোসিয়েটিং টুগেদার) অবশ্যই বৃদ্ধি ও উন্নত করতে হবে।’ 

টকভিল উনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ফরাসি ভাষায় প্রকাশিত দি লা দেমোক্র্যাচি ইন আমেরিকে, এবং পরে ইংরেজিতে ডেমোক্র্যাসি ইন আমেরিকা (১৮৩৫-১৮৪০) শীর্ষক ধ্রুপদী গ্রন্থে এই কথা বলেছেন। এই বইটির মাধ্যমে টকভিল গণতন্ত্রের সবচেয়ে সমৃদ্ধ, সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় এবং গভীরতম প্রতিফলন উপস্থাপন করেছেন। এই বইটি লেখার মূল উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক সমাজের কার্যকারিতা এবং রাজনৈতিক অ্যাসোসিয়েশনের বিভিন্ন রূপ বিশ্লেষণ করা। যদিও সুশীল সমাজের পাশাপাশি রাজনৈতিক ও সুশীল সমাজের মধ্যে সম্পর্কের বিষয়েও এই বইতে কিছু প্রতিফলন আছে। এভাবে বিশ্বের সর্বাধিক উন্নত গণতান্ত্রিক দেশ হিসাবে স্বীকৃত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র সম্পর্কে ধ্রুপদী বইতে টকভিল গণতন্ত্রকে শুধুমাত্র স্বশাসিত (অর্থাৎ নির্বাচিত) সরকার হিসেবে নয় বরং একটি ব্যাপকার্থবোধক জীবনধারা হিসেবে বুঝাতে চেয়েছেন। সুনির্দিষ্টভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র সম্পর্কে লেখা বইটির বিষয়বস্তু সাধারণীকরণের মাধ্যমে আমরা বিষয়টির গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা বাংলাদেশসহ অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশেও প্রযোজ্য বলে গণ্য তথা উপলব্ধি করতে পারি। 
 
সঙ্গত কারণেই এই বইতে গণতন্ত্রকে একটি সার্বজনীন মতবাদ হিসাবে বুঝাতে যেয়ে আর্ট অব অ্যাসোসিয়েটিং টুগেদার প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন টকভিল। পরস্পর বিশ্বাস বা আস্থাই হচ্ছে এই আর্ট বা শিল্পর মূল ভিত্তি। 

প্রথম নির্বাচিত সরকার প্রধান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে হত্যা; ৩ নভেম্বর জেলখানায় চার জাতীয় নেতাকে হত্যা; ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউস্থ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে বর্বরোচিত গ্রেনেড হামলা এবং ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসে কৃত্রিমভাবে বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়ার জন্মদিন পালন প্রভৃতির মাধ্যমে একত্রে মেলামেশার পরিবেশকে কলুষিত করা হয়েছে। 

এভাবে এদেশে বিশ্বাস বা আস্থা নামক গণতন্ত্রের বিশ্বস্ত বৃক্ষকে অবিশ্বাসের বিষবৃক্ষে পরিণত করা হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে বিশ্বাস বা আস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে নির্বাচিত দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে। কারণ এভাবে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মাধ্যমেই কেবল পরস্পরের প্রতি হারানো আস্থা, পুনরায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব। 

কিন্তু যদি মাঝখানে কোনো অনির্বাচিত সরকার ভূমিকা পালন করতে আসে তাহলে একদিকে যেমন পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস বা আস্থার পরীক্ষা দেয়া হলো না, অপরদিকে এ ধরনের অনির্বাচিত সরকারের কাঁধে বন্দুক রেখে ভোট কারচুপির অনেক সুক্ষ্ম মওকা খুবই সহজলভ্য হয়ে ওঠে। যারা ভোট কারচুপির মূল কুশীলব তারা ধরা ছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাবে। ভোট কারচুপির দোষ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারীদের ওপরেই থেকে যায়। অতীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের নির্বাচনগুলোর অভিজ্ঞতা তাই বলে। 

লেখক: সাবেক ডিন, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ এবং সাবেক চেয়ারম্যান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। 

এএইচএস