হৃদয়ের ব্যামো সারাতে সরকারি হাসপাতালে পদে পদে টাকা!
কাবেরী মৈত্রেয়
প্রকাশিত : ০৭:১৫ পিএম, ১৭ ডিসেম্বর ২০২২ শনিবার | আপডেট: ০৭:১৬ পিএম, ১৭ ডিসেম্বর ২০২২ শনিবার
![](https://www.ekushey-tv.com/media/imgAll/2020June/Untitled-4456999-2212171315.jpg)
হঠাৎ করে বুকে তীব্র ব্যথা অনুভব করায় আমার পরিচিত একজনের মা’কে কয়েকদিন আগে জাতীয় হৃদরোগ ইনিস্টিটিউট ও হাসপাতাল-এনআইসিভিডিতে নিয়ে যাওয়া হয়। সঠিক সময়ে প্রয়োজনীয় সেবা পাওয়ার আশায় অফিসের জেষ্ঠ্য এক সহকর্মীকে দিয়ে চিকিৎসকের সময় নিয়েছিলেন তিনি।
যথাসময়ে ডক্তারের দেয়া নির্দিষ্ট সময়ে তারা উপস্থিত হন। রোগীকে আন্তরিকতার সাথে দেখে তিনি রেফার করলেন আরেক চিকিৎসকের কাছে। ভর্তি করার পরামর্শও দিলেন। তার পরামর্শ মতো সেই চিকিৎসকের রুমের সামনে গিয়ে তিন ঘন্টা অপেক্ষা করার পরও দেখা মিললো না। রেফারেন্স দেবার পর অ্যাসিসটেন্ট এগিয়ে এলেন, জানালেন উনি না থাকায় সহযোগীদের দিয়ে আগের করা রিপোর্ট পরীক্ষা করিয়ে ভর্তির তারিখ দেবেন। সে অনুযায়ী, সকল ব্যবস্থা নেবার পর জানানো হলো, ঠিক দশদিন পর ভর্তি করিয়ে রিং পড়ানো হবে।
তারিখ মনে রেখে আগে অ্যাসিসটেন্টকে ফোন দিলে উনি সিরিয়াল দিলেন, খরচও কেমন হবে তার একটি সম্ভাব্য নমুনা মিললো। নির্ধারিত দিনে মাকে নেয়া হলো আবারো হাসপাতালে। এরপর যেনো যুদ্ধ। সকাল আটটায় হাসপাতালে গিয়ে কেবিন পেতে সময় লাগলো দুপুর তিনটা। আশেপাশে যারা কেবিন পাচ্ছিলেন এদের বেশিরভাগ-ই তদবির করে আর না হয় দালাল ধরে, প্রতি কেবিনের ভাড়া দিনে ১ হাজার ১শ ৭৫ টাকা হলেও অনেকেই দালালদের দিয়েছেন সাড়ে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত।
সে যাই হোক, হার্টের ব্লকগুলো তুলনামূলক শক্ত হয়ে যাওয়ায় অপারেশনের দিন প্রায় ৩ ঘন্টারও বেশি সময় ধরে এনজিওগ্রাম আর রিং পরিয়ে রোগীকে বের করা হলো। এর আগে অপারেশন থিয়েটারের (ওটির) সামনের করিডোরে স্বজনরা উদ্বিগ্ন অবস্থায় ঘোরা ফেরা করতে থাকে। অপারেশন রুমের প্রবেশ দ্বারের সামনে যে অপেক্ষমান জায়গাটা সেখানে কেবল একজন রোগীর স্বজন থাকার অনুমতি রয়েছে। অথচ হার্টে রিং ব্যবসায়ীদের এজেন্ট দেখা গেলো ৫০ জনের বেশি। আছে তাদের জন্য বসার ব্যবস্থাও।
চিকিৎসকদের পক্ষ থেকে যখন যোগাযোগ করা হচ্ছে তখন কে সবার আগে তার নিজস্ব কোম্পানির রিং এগিয়ে দেবেন সেটি নিয়েও চলছে প্রতিযোগীতা। রোগীর একজন স্বজনের বাইরে যদি দুজন ওটির সামনে যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করা মাত্র-ই নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা প্রহরীকে দিতে হবে গুনে ৫০টি টাকা। আর না দিলে প্রবেশের কোন ব্যবস্থা দেখা গেলো না। এমনকি রোগীকে যখন অপারেশন থিয়েটার থেকে বের করে পরবর্তী ধাপের কাজগুলোর জন্য পাশের কক্ষে নিলেন নার্সরা তখন তারা আবদার করে বসলেন টিপস দিতে হবে, আয়াদের পাশাপাশি তাদেরও।
ওটি ফির পাশাপাশি বাজেটের চেয়ে বাড়তি দামে রিং কেনায় এমনিতে তখন স্বজনদের কপালে দু:শ্চিন্তার ভাঁজ। বোঝা যাচ্ছে না রোগীর অবস্থাও। কেননা এরই মধ্যে চিকিৎসকদের পরামর্শে নেয়া হচ্ছে সিসিইউতে (ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটে)। তারপরও সবটা মিটিয়ে রওয়ানা হলো সিসিইউ-১ এর দিকে। সেখানে গিয়ে দেখা গেলো সারি সারি বেডে কাতরাচ্ছেন রোগীরা, বিপরীতে নার্স এবং ডাক্তার একেবারে অপ্রতুল, এর ওপর আবার জরুরি বিভাগ থেকেও পাঠানো হচ্ছে রোগী যাদের জন্য নেই আপদকালীন তাৎক্ষনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা। আছে আয়াদের দৌরাত্ম, টাকা ছাড়া যেনো এতোটুকুও সেবা দিতে রাজি নন তারা। ফলে, অসুস্থ রোগীরা চোখের সামনে ধুকেঁ ধুকেঁ মরতে দেখছেন অন্যরোগীকে।
সেদিন ওই ইউনিটে দিন রাত মিলিয়ে মারা গিয়েছিলো অন্তত ২১ জন রোগী। চোখের সামনে প্রিয় মুখটির চিকিৎসাবিহীন এমন নিথর দেহ দেখে যে কান্নায় ভেঙ্গে পড়বেন সেটিরও অবস্থা নেই। প্রতিদিন এতো মৃত্যুর মিছিল, যে এখানকার কতর্ব্যরত মানুষগুলোও নির্বিকার। তবে সবাই যে চিকিৎসা পান না বিষয়টি এমন না। যদি আপনি সমাজে একজন হেভিয়েট ব্যক্তি হোন, কিংবা চিকিৎসকের পরিবারের কেউ; তাহলে একজনের পরিবর্তনে ১০জন সেবা দিতে হাজির, মিলছে সকল সুযোগ সুবিধা। এই যেমন সিসিইউ গুলো তুলনামূলক সংবেদনশীল হবার কারণে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের স্পষ্ট নির্দেশনা রোগীর সাথে একজন সবসময় থাকতে পারবে, সাক্ষাতের সময়ও নির্দিষ্ট। কিন্তু যদি প্রভাবশালী হোন তাহলে এমন রক্ষণশীল এরিয়াতে দশজনও থাকতে পারেন আর সাধারণ হলে নিরাপত্তা কর্মীতে প্রতি ভিজিটে দিতে হবে ২০ থেকে অন্তত ৫০ টাকা।
রোগীর মৃত্যু হলে অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া থেকে শুরু করে যাবতীয় কার্যক্রমেও কিন্তু দিতে হবে বাড়তি টাকা, চলে কমিশনের ব্যবস্থাও। সে যেই হোক, রোগীটির পরিবার যেহেতু তুলনামূলক প্রভাব খাটিয়ে কেবিনের ব্যবস্থা করতে পেরেছিলো, সেহেতু দু’দিন সিসিইউতে থাকার পর অবস্থার উন্নতি হলে নেয়া হলো কেবিনে। কিন্তু এই কেবিন পর্যন্ত নিতে যতজন রোগীকে সহায়তা করেছে প্রত্যেককেই দিতে হলো ১০০ টাকা করে। রুম পরিস্কার থেকে শুরু করে সব খাতেই ১শ টাকার নিচে নামেন না তারা। এমনকি সকাল দুপুর এবং রাত মিলিয়ে সরকারী খাদ্য সরবরাহকারীদেরও দিতে হয় টাকা।
আলট্রাসনোগ্রাম, এক্সরেসহ যাবতীয় পরীক্ষা করতেও লাগছে দিনমান, চিকিৎসক বা বাইরের হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের রাজনৈতিক পরিচয়ে যদি প্রভাব খাটানো সম্ভব হয় তাহলে মিলতে পারে সিরিয়াল। হাসপাতালের ভেতরে যখন রোগীদের সেবা নিতে যখন পদে পদে গুনতে হচ্ছে টাকা তখন শান্তি নেই বাইরেও। এক হালি কলা কিনতে গেলে খরচ করতে হচ্ছে ৮০ টাকা, কমলা ৪শ টাকা কেজিতে মিলছে, অন্যান্য সদাই-পাতির কথা তো বাদ-ই দিলাম। অথচ দেশে স্বল্প ও নিম্ন আয়ের মানুষের হৃদয়ে ব্যামো সারাতে সরকারী যে কটি হাসপাতাল রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম জাতীয় হৃদরোগ ইনিস্টিটিউট ও হাসপাতাল-এনআইসিভিডি। যেখানে হার্টের চিকিৎসার জন্য আছে আধুনিক সকল যন্ত্রপাতি সুযোগ সুবিধা।
বলে রাখা ভালো, গেল এক দশকে চিকিৎসকরা দক্ষ এবং প্রশিক্ষিত কিংবা হাসপাতালগুলোতে উন্নত যন্ত্রপাতি এলেও স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় চিকিৎসা খরচ বহন করতে গিয়ে অসংখ্য মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে। চিকিৎসা খরচের ৬৭ শতাংশের বেশি ব্যক্তির পকেট থেকে যাচ্ছে। এ ছাড়া স্বাস্থ্য খাতে বৈষম্য বাড়ছে, যা খুবই দুঃখজনক। অনেক দেশে যেখানে বিনা মূল্য ও অতি সহজ উপায়ে জনগণকে চিকিৎসা ও ওষুধ দেওয়া হয়, সেখানে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে। স্বাস্থ্যনীতি থাকলেও সেটি কার্যকর নয়। এ ছাড়া অন্যান্য দেশে জিডিপির বড় একটা অংশ স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় করলেও বাংলাদেশ সেখানে ১ শতাংশেরও কম। ফলে বিনিয়োগ না বাড়ায় অনেক কিছু অগ্রগতি হলেও পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ।
বিগত বছরগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায়, স্বাস্থ্য খাতের পরিচালন বরাদ্দের ৩ থেকে ৫ শতাংশ এবং উন্নয়ন বরাদ্দের ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ অব্যয়িত থাকে। যেটা খরচ হয়, তা-ও অনেক ক্ষেত্রে গুণগত মানের নয়। খরচ করতে না পারলে বাজেট বাড়ানোর যৌক্তিকতা কোথায়?
লেখক: সিনিয়র রিপোর্টার, একাত্তর টেলিভিশন
এসি