ঢাকা, সোমবার   ০৬ মে ২০২৪,   বৈশাখ ২৩ ১৪৩১

যেখানে এমবাপ্পেই সেরা, এমবাপ্পেই অনন্য!

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০২:৪৭ পিএম, ১৯ ডিসেম্বর ২০২২ সোমবার

৩৬ বছরের আক্ষেপ মিটিয়ে বিশ্বকাপের শিরোপা ঘরে তুলেছে আর্জেন্টিনা। গোটা একটা প্রজন্মের স্বপ্নসারথি হয়ে থাকা লিওনেল মেসির হাত ধরেই পরম আরাধ্য সোনালী ট্রফিটা নিজেদের করে নিয়েছে আলবিসেলেস্তারা। 

টানটান উত্তেজনায় ঠাসা এই ফাইনালে দুর্দান্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখায় ফ্রান্সও। নির্ধারিত ও অতিরিক্ত সময় মিলিয়ে ১২০ মিনিটে ৩-৩ ব্যবধানে সমতা বিরাজ করলে টাইব্রেকারেই নির্ধারণ হয় সেরা দলের ভাগ্য। যেখানে ৪-২ ব্যবধানে পরাজিত হয় গতবারের চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স।

খেলায় তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতার একটা ব্যাপার থাকলেও ৭০ মিনিট পর্যন্ত ম্যাচে খুঁজে পাওয়া যায়নি মেসির প্রতিদ্বন্দ্বি এমবাপ্পেকে। ফরাসিদের ঘিরে তখন সংশয়, এ যে বিশ্বকাপ ফাইনাল, ফ্রান্স কি তা জানে! প্রথমার্ধে মেসি আর ডি মারিয়ার গোলে আর্জেন্টিনা ২-০ ব্যবধানে এগিয়ে, অথচ তাড়না তো দূরের কথা, ফ্রান্সের ফুটবলে কোনো প্রাণই নেই!

বাঁ দিক থেকে ঢুকে ৭০ মিনিটে তার শট বারের উপর দিয়ে চলে যায়। যেন জানিয়ে গেল, আড়মোড়া ভাঙছেন এমবাপ্পে।

বিশ্বকাপের ফাইনাল, তাতে ‘মেসি বনাম এমবাপ্পে’ দ্বৈরথে ক্লাব সতীর্থ গোল করে, প্রথমার্ধে আক্রমণে প্রাণ ছড়িয়ে এগিয়ে গেছেন! এমবাপ্পের তা সহ্য হবে কেন! বিশ্বমঞ্চে আলো ছড়ানোর জন্য তো তিনিও কারো চেয়ে কম নন!

রাশিয়ায় নিজের প্রথম বিশ্বকাপেই তা বুঝিয়ে দিয়েছেন। নকআউট পর্বের শুরুতে মেসির আর্জেন্টিনার বিপক্ষেই দুই গোলে বিশ্বকে দিয়েছেন বার্তা- আসছি! সেটা ছিলো এমনই বার্তা যে, ব্রাজিল থেকে পেলের অভিবাদন আসতে দেরি হয় না! ১৯৫৮ বিশ্বকাপে পেলের পর যে নকআউটে কোনো ম্যাচে দুই গোল করা সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় তখন এমবাপ্পেই। সেবার ফাইনালে ফরাসিদের বিশ্বজয়ের পথেও এক গোল ছিল এই তরুণের।

কিন্তু রোববার রাতে লুসাইলে এমবাপ্পে যা করলেন, সেটা সব বিচারেই মিলে যায় স্টেডিয়ামের নামের সঙ্গে- আইকনিক! ৭০ মিনিট পর্যন্ত ঘুমিয়ে থাকা এমবাপ্পে যখন জাগলেন, আর্জেন্টিনা প্রমাদ গুণেছে। নয় মিনিট পর আর্জেন্টিনা বিপদের গন্ধ পেয়েছে। ৭৯ মিনিটে কোলো মুয়ানির এনে দেয়া পেনাল্টি থেকে গোল এমবাপ্পের!

তাতে ব্যবধান কমেছে, তবু আর্জেন্টিনা তো এগিয়ে। এমবাপ্পের কাজ তখনো বাকি। সেটা সেরে নিতে লেগেছে মাত্র ৯৭ সেকেন্ড! আর্জেন্টিনা গুছিয়ে নিয়েছে কী নেয়নি, আবার গোল ফ্রান্সের! আবার সেই এমবাপ্পে! এবার মার্কাস থুরামের সঙ্গে দেয়া-নেয়ার পর দুর্দান্ত ভলিতে লক্ষ্যভেদ! ২-২ সমতা! দশ মিনিট আগেও এমন কিছু কারও দূরতম কল্পনাতেও ছিল না নিঃসন্দেহে!

দুই গোলে একটা রেকর্ড হলো ফ্রেঞ্চ তারকার। গতবারের চার গোলের পর এবারের বিশ্বকাপে সাত গোল মিলিয়ে ২৩ বছর ৩৬৩ দিন বয়সী এমবাপ্পের তখন ১১ গোল বিশ্বমঞ্চে। এর চেয়ে কম বয়সে বিশ্বকাপের ইতিহাসে দশ বা তার বেশি গোল আর কারও নেই। ইতিহাস রাঙিয়ে সংখ্যাটা ১২ হয়ে গেল কয়েক মিনিট পরেই।

অতিরিক্ত সময়ে মেসির গোলে আবার এগিয়ে গেল আর্জেন্টিনা। মনে হলো, বুঝি ‘টু গুড টু বি ট্রু’ গল্পটাই সত্যি হচ্ছে। মেসির শেষ বিশ্বকাপ, মেসির হাতে বিশ্বকাপ এবার নয়তো কখনো নয়! সেই মেসির গোলেই যখন আবার এগিয়ে গেল আর্জেন্টিনা... এর চেয়ে দারুণ কোনো গল্প তো আর হতেই পারে না। 

কিন্তু এমবাপ্পে নামের টুইস্টের যে তখনো বাকি! আবার পেনাল্টি! অতিরিক্ত সময়ে গড়ানো ম্যাচের তখন আর মাত্র দুই মিনিট বাকি! এমবাপ্পেরই শট লাগে আর্জেন্টিনার বক্সে থাকা মন্টিয়েলের হাতে। পেনাল্টি থেকে আবার গোল এমবাপ্পের। হ্যাটট্রিক! 

আগের বিশ্বকাপে ’৫৮-র পেলের রেকর্ড নিয়ে টানাটানি শুরু করেছিলেন, রেকর্ডের খেয়ালে ছুটতে থাকা এমবাপ্পে এবার ডেকে নিয়ে এলেন ১৯৬৬ বিশ্বকাপের জিওফ হার্স্টকে। ফাইনালে হ্যাটট্রিকের রেকর্ডে এতদিন শুধু হার্স্টই একা ছিলেন, এমবাপ্পে যোগ দিলেন তার চায়ের টেবিলে।

শেষ পর্যন্ত ৩-৩ সমতায় শেষ ম্যাচে টাইব্রেকারে এমবাপ্পেই ফ্রান্সের প্রথম শট জালে জড়ালেন। কিন্তু পরের দুই শটে কোমান আর চুয়ামেনি ব্যর্থ হতেই স্পষ্ট হয়ে গেল, কাতার বিশ্বকাপ মেসিকেই রাঙাচ্ছে।

তবে শ্বাসরুদ্ধকর ১২০ মিনিটের পর টাইব্রেকারের রুদ্ধশ্বাস নাটক শেষে যখন হাঁফ ছেড়ে বসার সুযোগ হয়েছে ফুটবলপ্রেমীদের- তা তিনি আর্জেন্টিনারই সমর্থক হোন বা ফ্রান্সের- নিশ্চিত, বারেবারে মন ফিরেছে এমবাপ্পের হ্যাটট্রিকেই। ফরাসি এই ফুটবল তারকার হার না মানার প্রত্যয়ে যে কুর্নিশ না করে থাকা যায় না!

মিরোস্লাভ ক্লোসা একটু নড়েচড়ে বসেছেন নিশ্চিত। দুই বিশ্বকাপে পেলে আর হার্স্টের স্মৃতি ফিরিয়েছেন যে এমবাপ্পে, ক্লোসার বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি (১৬) গোলের রেকর্ডও যে আর মাত্র চারটি গোল দূরে! অবশ্য রেকর্ডটা এমবাপ্পের ঝুলিতে গেলে ক্লোসারও হয়তো আক্ষেপ থাকবে না।

রেকর্ড আর এমবাপ্পে- শব্দ দুটি যে একে অন্যের সম্পূরক! যা কেবল তারই, অন্য কারও নয়। এই এমবাপ্পে অনন্য, সবার সেরা।

এনএস/এএইচ