ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৪ ১৪৩০

মুজিব কোট ও আমি

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৫:২৭ পিএম, ২৬ মার্চ ২০২৩ রবিবার

১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। ১৯৭২  সালের ১০ জানুয়ারি বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে লন্ডন, ভারত হয়ে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করলেন। মানুষের মনে সেকি উচ্ছ্বাস। চারদিকে জয় বাংলা ও জয় বঙ্গবন্ধু শ্লোগান ধ্বনিতে মুখরিত হলো। স্বাধীনতার পর আমি আমাদের সহপাঠি, বন্ধুদের নিয়ে পাড়ায় মিছিল করা ছিল নিত্যদিনের কাজ।

১৯৭৩ সালে আমার আব্বা আমাকে নিয়ে উনার পরিচিত একটি টেইলার্স গেলেন। এটি ময়মনসিংহের মহারাজা রোডের শুরুতেই সেই টেইলার্স ছিল। সেখান থেকে মুজিব কোট বানিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই মুজিব কোট মাত্র চারদিন পড়তে পরেছিলাম। এরপর ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভয়াবহ কালো রাত এলো। বঙ্গবন্ধুকে সহ পরিবারের ১৮ জন মানুষকে হত্যা করা হলো।সারা দুনিয়া বিস্ময় প্রকাশ করেছিল। মুজিব কোট পড়েছিলাম চারদিন চারটা অনুষ্ঠানে। তখন মোবাইল বা ক্যামারা সবার হাতে হাতে ছিল না।তাই ছবি সংরক্ষণ করতে পারি নি।

বাঙালিরা ১৯৫৮ সালের আইয়ুব খান এর সামরিক শাসন দেখেছে। প্রথমদিকে সারা বাংলায় কারফিউ ছিল। কেউ রাস্তায় বের হতে পারবে না। রাস্তায় তিন বা চার অধিক মানুষ একসাথে দেখলে গুলি করার অর্ডার ছিল।কিযে আতংক ছিল সেই সময় ভাবাই যেতো না।

বাঙালির ললাটে এ অঞ্চলে দ্বিতীয় বারের মতো  সামরিক শাসন জারি হলো ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট।এবার পশ্চিমাগোষ্ঠি নয় স্বয়ং বাঙালিরা।স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার, বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হলো।দেশী বিদেশী আন্তর্জাতিক চক্রান্তে এ জঘন্য অপরাধ সাধিত হলো। সেদিন ভোর থেকেই জেলায় জেলায় আওয়ামী লীগ এর মূল নেতাদের গ্রেফতার করা হলো।সেই কারণে অনেকেই আত্মগোপন করলো। আমার আব্বাও আত্ম  গোপন করেছিলেন।

১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ঢাকার জেলখানায় চার জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ,ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামারুজ্জামান কে হত্যা করা হলো।ভয় ভীতি জনমনে তুঙ্গে।প্রায় সারে ছয় বছর মেজর জিয়া ক্ষমতায় থাকলেন।১৯৭৫ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত সামরিক শাসন ছিল।এরপর দুটি নির্বাচন ১. প্রেসিডেন্ট ২. জাতীয় সংসদ।

তখন ঘাতকচক্র বঙ্গবন্ধুকে সর্বক্ষেত্রে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল।দলীয় রাজনীতি বন্ধ করে দিয়েছে।সেই সময় আমার মুজিব কোটের বেহাল দশা।আম্মা আমার সেই মুজিব কোট লুকিয়ে রেখে দিয়েছিলেন।আমি অনেক খুঁজেছি।পাইনি।আরো বছর দুয়েক পরে একটি ট্রাংক থেকে আমার মুজিব কোট আবিস্কার করলাম।ততদিনে আমার মুজিব কোট ছোট হয়ে গেছে অর্থাৎ আমি ততদিনে গায়ে গতরে বড় হয়ে গিয়েছি।

এরপর বাংলাদেশে দ্বিতীয়বারের মতো সামরিক শাসন জারি করা হলো ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ।রক্তপাতহীন এক অভ্যূথ্থানের  মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এলেন জেনারেল হোসেইন মোহাম্মদ এরশাদ। আমরা তখন অনার্স পড়ি। রাজপথে শ্লোগান দিলাম "জেনারেল নয় দেশের মালিক, দেশ চালাবে কৃষক শ্রমিক।"
নয় বছর কেটে গেলো। বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকুরীতে যোগদান করলাম।ব্যাংকে থেকেও দমিত হইনি। বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে বুকে ধারণ করে চাকরিজীবনে বিভিন্ন  সংগঠনের কাজ করে গেছি। বঙ্গবন্ধু পরিষদ, মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্ম কমান্ড, জাতীয় শ্রমিক লীগ প্রমুখ।

১৯৮৫ সালের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে শহিদ হলেন  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের মেধাবী ছাত্র , তৎকালীন জাতীয় ছাত্রলীগ এর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ সম্পাদক রাউফুন বসুনিয়া।
রাউফুন বসুনিয়া শহিদ হলে লিখেছিলাম-

লাশ পড়ছে লাশ
একদিন নয়, দু'দিন নয় 
মাসের পর মাস
লাশ পড়ছে লাশ।
চাল চুলুহীন 
লেবাস বিহীন
করছে মানুষ বাস
অন্যদিকে বেজন্মারা
করছে উল্লাস
লাশ পড়ছে লাশ।

প্রতি বছর তার স্মরণে বসুনিয়া তোরণে শ্রদ্ধা নিবেদন ও আলোচনা সভা করি। একবার স্মরণ সভায় মুজিব কোট পড়ে আসি। আমাদের ৯০ এর গণঅভ্যুত্থানের লড়াকু ছাত্রনেতা ডা. জাহাঙ্গীর সাত্তার টিংকু বললেন, সখা ভাই আপনিও মুজিব কোট পড়লেন? আমি বললাম, এবারই প্রথম নয়। ১৯৭৩ সালে মুজিব কোট পড়েছি।

এখন জাতীয় দিবসগুলোয় মুজিব কোট পড়ে বক্তব্য দেই। এখনো আমার মনে পড়ে ছোট্রবেলার সেই মুজিব কোট এর কথা। মুজিব নেই।আজ কোটি কোটি বাঙালি মুজিব কোট পড়ে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বেঁচে থাকবেন বাঙালির হৃদয়ে দীর্ঘদিবস, দীর্ঘ বছর।
কেআই//