ঢাকা, শনিবার   ১৮ মে ২০২৪,   জ্যৈষ্ঠ ৪ ১৪৩১

অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার যোদ্ধা

এম. নজরুল ইসলাম

প্রকাশিত : ০৪:৫৪ পিএম, ১৬ মে ২০২৩ মঙ্গলবার | আপডেট: ১১:৩৬ এএম, ১৯ মে ২০২৩ শুক্রবার

কৈশোরোত্তীর্ণ তরুণ বয়সেই তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসের অংশ। বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছিলেন তাঁর স্কুল জীবনেই। স্কুলের পাঠ নিতে নিতেই নিয়েছিলেন প্রগতিশীল রাজনীতির পাঠ। আধুনিক মনস্ক মানুষটি মননে প্রগতিশীল। ১৯৫২ সালে কলম ধরেছিলেন পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে। প্রতিবাদ করেছিলেন। আজও সমান প্রতিবাদী তিনি। যখনই প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চেয়েছে, দেশের অপরাজনীতি যখন অপপ্রচারকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে, তখনই প্রতিবাদী হয়ে উঠেছে তাঁর কলম। দুই চোখ জুড়ে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখা এই মানুষটির নাম আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। 

একটি কবিতা লিখেই বাংলাদেশের ইতিহাসের অংশ হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের প্রথম সোপান বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন স্পর্শ করেছিল তাঁকে। লিখেছিলেন এক অমর কবিতা। অমর সুরকার আলতাফ মাহমুদের সুরে তা আজ গীত হয় বিশ্বজুড়ে একুশের প্রভাতফেরির গান হিসেবে। একুশে ফেব্রুয়ারির সঙ্গে, ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে এভাবেই নিজেকে যুক্ত করে ফেলেছিলেন তিনি। বাঙালি চিরদিন স্মরণ করবে এই গানটি। আর স্মরণ করবে এই গানের গীতিকার
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীকেও। যতদিন বাঙালী জাতি টিকে থাকবে, একুশের প্রভাতফেরি হবে। প্রভাতফেরিতে গীত হবে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’। আজ সারা বিশ্বে গানটি গাওয়া হয়। বিশ্বের নানা ভাষায় অনূদিত হয়েছে গানটি। গাওয়া হয়েছে। বেরিয়েছে রেকর্ড। বাঙালির জন্য এ এক অনন্য সম্মান। 

ছবি- লেখক: এম. নজরুল ইসলাম

তাঁর নামের সঙ্গে পরিচয় শৈশবে, যখন থেকে একুশের প্রভাতফেরিতে যাচ্ছি, তখন থেকেই। তাঁকে চিনি কলেজের ছাত্রজীবন থেকে। চিনি বলতে দূর থেকে দেখেছি। সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর সুযোগ কিংবা সাহস হয়নি তখন। তিনি তখন দূরের নক্ষত্র। সামনাসামনি জানাশোনা আমার প্রবাস জীবনের শুরুতেই। তখন থেকেই তাঁর সান্নিধ্য পেয়েছি। তিনি থাকতেন লন্ডনে, আমি ভিয়েনায়। ব্রিটেন ও অস্ট্রিয়া, ইউরোপের দুই দেশের মধ্যে দূরত্ব যতই থাক না কেন, দিনে দিনে নৈকট্য বেড়েছে। একুশের প্রভাতফেরির গানের রচয়িতা, খ্যাতিমান সাহিত্যিক-সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর সঙ্গে অপরিচয়ের দূরত্ব ঘুঁচে যেতে সময় লাগেনি। একসময় যাঁকে খুব দূরের বলে মনে হতো, তিনি আমাকে কাছে টেনে নিয়েছেন অপত্য স্নেহে। তাঁর স্নেহে-সাহচর্যে আমি ঋদ্ধ হয়েছি।আমাদের গাফ্ফার ভাই ছিলেন সহজ-সরল এমনই একজন মানুষ, যিনি সবাইকে আপন করে নেওয়ার অসামান্য ক্ষমতা রাখতেন। তাঁর সঙ্গে দেশের ভালোমন্দ, রাজনীতির বর্তমান-ভবিষ্যত নিয়ে কথা হতো, এ ছিল আমার অনেক বড় পাওয়া। লন্ডনে গেলে তাঁর সঙ্গে দেখা করা ছিল আমার নিত্য রুটিন। বিদেশেও অনেক জায়গাতে গিয়েছি তাঁর সঙ্গে। ভিয়েনাতে এসেছেন তিনি। আমার আতিথ্য গ্রহণ করেছেন, এ আমার অনেক বড় পাওয়া। মনে আছে, ‘পলাশী থেকে ধানমন্ডি’ নাটকের প্রদর্শনী হয়েছিল ভিয়েনায়। হলভর্তি দর্শক বিষ্ময়-বিমুগ্ধ হয়ে উপভোগ করেছিল নাটকটি। বোধহয় সেটাই ছিল লন্ডনের বাইরে ‘পলাশী থেকে ধানমন্ডি’ নাটকের প্রথম প্রদর্শনী।  

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ইতিহাসের সাক্ষী, সঙ্গীও। ব্রিটিশ ভারত থেকে পাকিস্তান হয়ে বাংলাদেশের জন্ম, এই ইতিহাসের অনেক কিছুরই সাক্ষী তিনি। জন্মেছিলেন বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার উলানিয়া গ্রামে, ১৯৩৪ সালের ১২ ডিসেম্বর। বিখ্যাত রাজনীতিবিদ, অবিভক্ত বাংলার কংগ্রেস কমিটি ও খেলাফত কমিটির বরিশাল জেলা শাখার সভাপতি প্রয়াত হাজি ওয়াহেদ রেজা চৌধুরী তাঁর বাবা, মা জোহরা খাতুন। উলানিয়া জুনিয়র মাদ্রাসা ও উলানিয়া করোনেশন হাই ইংলিশ স্কুলে লেখাপড়া করেছেন। ঢাকা কলেজের ছাত্র ছিলেন। পড়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে। স্কুলজীবনেই নিয়েছিলেন রাজনীতির পাঠ। ছাত্রজীবনেই লেখালেখিতে হাতেখড়ি। মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন সম্পাদিত মাসিক সওগাত পত্রিকায় তাঁর গল্প প্রকাশিত হয় ১৯৪৯ সালে।১৯৫২ সালে সাময়িকপত্রে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম উপন্যাস চন্দ্রদ্বীপের উপাখ্যান। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি ছাত্রজীবনেই। ঢাকা কলেজের ছাত্র থাকাকালীন যোগ দেন দৈনিক ইনসাফ পত্রিকায়। ১৯৫১ সালে যোগ দেন খায়রুল কবীর সম্পাদিত দৈনিক সংবাদের বার্তা বিভাগে। তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া সম্পাদিত দৈনিক ইত্তেফাকে যোগ দেন ১৯৫৬ সালে।   

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী কলমযোদ্ধার ভুমিকায় অবতীর্ণ হন। জয়বাংলা পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে মডারেটরের ভ‚মিকাও পালন করেছেন। স্বাধীনতার পর ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক জনপদের প্রধান সম্পাদক ছিলেন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী।  

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ছিলেন সেই স্বল্প সংখ্যক সাংবাদিকের একজন, যাঁর কলামের অপেক্ষায় থাকতো দেশের সিংহভাগ পাঠক। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী কলামে যে মত প্রকাশ করতেন, তার সঙ্গে অনেক পাঠকেরই হয়ত মতের মিল ছিল না। কিন্তু তিনি কী লিখছেন, কী ভাবছেন, তা জানার আগ্রহ পাঠকেদের ছিল। এমনকি তাঁর বিরুদ্ধ রাজনৈতিক মতবাদের মানুষও আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর কলাম পড়তেন সমান আগ্রহে।  

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীকে শুধুই একজন সাংবাদিক কিংবা কলাম লেখকের পরিচয়ে সীমাবদ্ধ করে ফেলা যাবে না। নন্দিত কথাশিল্পী তিনি। একাধারে লিখেছেন, ছোটগল্প, উপন্যাস। লিখেছেন গান ও কবিতা। তাঁর পাঠকনন্দিত ছোটগল্পের বই ‘সম্রাটের ছবি’। পেয়েছেন ইউনেস্কো পুরস্কার। ভ‚ষিত হয়েছেন, বাংলা একাডেমি পুরস্কারেও। পেয়েছেন একুশে পদক ও স্বাধীনতা পুরস্কার। আবদুল গাফ্ফার  চৌধুরীর সবচেয়ে  বড় পুরস্কার ছিল তাঁর পাঠকপ্রিয়তা। অসাধারণ এক কথক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। শব্দ বয়নের অসামান্য দক্ষতায় তিনি পাঠককে টেনে নিয়ে যেতেন। সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণে সঠিক দিক নির্দেশনা দিতে তাঁর জুড়ি ছিল না। লেখার দায়ে নয়, লেখাকে তিনি অর্পিত দায়িত্ব হিসেবে মনে করতেন তিনি। পাঠকের প্রতি দায়বদ্ধতাই তাঁর লেখার অনুপ্রেরণা, একথা প্রায়ই বলতেন। প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে নিয়ম করে লিখতে বসতেন। লেখা ছিল তাঁর কাছে সাধনার মতো। লেখার আগে ঢাকা ও অন্যান্য স্থানে ফোন করে জেনে নিতেন, সর্বশেষ খবরটি। যে কারণে বিদেশে থাকলেও তাঁর কলামে দেশের সর্বশেষ পরিস্থিতির চুলচেরা বিশ্লেষণ পাওয়া যেত। আজ তাঁর প্রয়াণের প্রথম বার্ষিকী। 

অসাম্প্রদায়িক, উদারনৈতিক বাংলাদেশ গড়ার কাজে তাঁর মতো গ্রগতিশীল মানুষকে আরো কিছুদিন খুব প্রয়োজন ছিল আমাদের। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের পতাকাবাহী আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর কলম থেমে গেছে। যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন গাফ্ফার ভাই।

লেখক: এম. নজরুল ইসলাম, সর্বইউরোপিয় আওয়ামী লীগের সভাপতি