ঢাকা, শনিবার   ১৮ মে ২০২৪,   জ্যৈষ্ঠ ৪ ১৪৩১

নবীন-প্রবীণদের মিলনমেলায় পরিণত ঢাকা থিয়েটারের সুবর্ণজয়ন্তী

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১০:৩২ এএম, ২৯ জুলাই ২০২৩ শনিবার | আপডেট: ১০:৫০ এএম, ২৯ জুলাই ২০২৩ শনিবার

শুক্রবার বিকেলে রাজনৈতিক উত্তাপ ছাপিয়ে আনন্দ-উচ্ছ্বাস বয়ে যায় ‘ঢাকা থিয়েটার’র নাট্যকর্মীদের মাঝে। জমকালো আয়োজনের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠার ৫০ বছর উদযাপন করছে দেশের অন্যতম এই নাট্যদলটি।

দুই দিন ব্যাপি এই অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পরই সেলিম আল দীনের নাটক ‘প্রাচ্য’ মঞ্চস্থ হয়েছে। নাসির উদ্দীন ইউসুফের নির্দেশনার নাটকটি শনিবারও প্রদর্শিত হবে।

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার মূল প্রবেশদ্বার থেকে সন্ধ্যায় ৭টায় মণিপুরি মৃদঙ্গের তালে সূচনা হয় উদ্বোধনী আয়োজনের। মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ থেকে আগত মণিপুরি মৃদঙ্গশিল্পীরা অংশ নেন পরিবেশনায়।

পরে পরীক্ষণ থিয়েটার হলের লবিতে সাজানো মঞ্চে প্রদীপ জ্বালিয়ে সুবর্ণজয়ন্তীর বছরব্যাপী অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করা হয়। নবীন-প্রবীণ নাট্যশিল্পীদের মিলনমেলায় পরিণত হয় আয়োজনটি।

সঞ্চালক আফজাল হোসেন যখন একে একে অতিথিদের মঞ্চে ডেকে নিলেন, তখন তৈরি হয় অন্যরকম দৃশ্য। বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনের উজ্জ্বল মুখগুলোকে যেন পাওয়া গেলো এক ফ্রেমে।

মঞ্চে তখন পিযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়, ফেরদৌসী মজুমদার, রামেন্দু মজুমদার, মামুনুর রশীদ, ম. হামিদ, সুবর্ণা মুস্তাফা, রাইসুল ইসলাম। এছাড়াও সুভাশিষ ভৌমিক, শহিদুজ্জামান সেলিম, রোজী সিদ্দিকী, ফারুক আহমেদসহ অনেক গুণি শিল্পীকে দেখা যায় দর্শক সারিতে।

তখনই চোখ যায় দলটির অন্যতম স্বপ্নদ্রষ্টা নাসির উদ্দীন ইউসুফের দিকে। সবার বক্তব্যের পর বিশেষ সম্মান দিয়ে তাকে মঞ্চে ডাকা হয়। ৫০ বছরের ঢাকা থিয়েটারের নাট্যযাত্রায় যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাদের অন্যতম একজন নাসির উদ্দীন ইউসুফ।

তবে মঞ্চে এসে নাসির উদ্দীন ইউসুফ স্মরণ করলেন প্রয়াত বন্ধু সেলিম আল দীনকে; বললেন, “সেলিম ছাড়া ঢাকা থিয়েটার এতটা পথ হাঁটতে পারত না।” হুমায়ূন ফরিদীসহ আরও অনেক প্রবীণ শিল্পীদেরও স্মরণ করলেন, যাদের অনেকেই এখন প্রয়াত।

তিনি বলেন, “ঢাকা থিয়েটার নামটি দিয়েছিলেন ম. হামিদ। তিনি এখানে আছেন। শেখ কামাল আমাদের সঙ্গে যুক্ত ছিল। আরও অনেক মানুষ এই ৫০ বছরে যুক্ত হয়েছিলেন, তাদের কথা মনে পড়ছে। এই ৫০ বছরে আমরা থিয়েটারের ২৫ জন মানুষকে হারিয়েছি। তাদের শূন্যতাও অনুভব করছি।”

সমতার বাংলাদেশের প্রত্যাশার কথা জানিয়ে নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলেন, “মঞ্চ আমাদের আশ্রয়। এখানেই মানুষকে খুঁজে পাই, বাংলাদেশকে খুঁজে পাই। আমরা এমন দ্বিধান্বিত বাংলাদেশ চাই না। আমরা সমতার বাংলাদেশ চাই।”

                                                                                       রামেন্দু মজুমদার

মিলনায়তনের সামনের লবিতে ছিল বর্ষপূর্তির কথামালা। এতে ঢাকা থিয়েটারকে শুভেচ্ছা জানিয়ে প্রবীণ নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার বলেন, “ স্বাধীনতার পর ঢাকা থিয়েটার একঝাঁক তরুণকে নিয়ে ঢাকার মঞ্চে যে তারুণ্যের দীপ্তি ছড়িয়েছিল, তা ক্রমেই উজ্জ্বল হয়েছে।” 

                                                                                       পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়

এ সময় ৫০ বছরে যাদের হারিয়েছেন তাদের শূন্যতার কথা বলেছেন বরেণ্য অভিনয় শিল্পী পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ও। 

তিনি বলেন, “যাদেরকে আমরা হারিয়েছি গত ৫০ বছরে, তাদের গভীর শ্রদ্ধা জানাই। আর যারা ছিলেন আমাদেরে সঙ্গে, আজ নেই, ঢাকাতেই আছেন আথবা দেশের বাইরে আছেন তাদেরও স্মরণ করছি।”

                                                                                              সুবর্ণা মুস্তাফা

তখন হুমায়ূন ফরিদীর কথা স্মরণ করে সুবর্ণা মুস্তাফা বলেন, “এই দিনে আমি স্মরণ করছি সেলিম আল দীনকে, স্মরণ করছি ঢাকা থিয়েটারের একনিষ্ঠ কর্মী হুমায়ূন ফরিদীকে। আমি শিমূল ইউসুফের কথা বলতে চাই, যারা নবীন থিয়েটারকর্মী তাদের সামনে এমন একনিষ্ঠ থিয়েটারের মানুষ আছেন- তাদের পথ ধরে নবীনরা ঢাকা থিয়েটারকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে।”

স্বাধীন বাংলাদেশের থিয়েটার চর্চায় ‘পথিকৃৎ’ নাট্যদল ‘ঢাকা থিয়েটার’। যুদ্ধ ফেরত কয়েকজন তরুণ ১৯৭৩ সালের ২৯ জুলাই প্রতিষ্ঠা করেন এই দল।

ওই বছরের নভেম্বরে প্রয়াত নাট্যকার ও অধ্যাপক সেলিম আল দীনের লেখা ‘সংবাদ কার্টুন’ নাটকটি মঞ্চস্থ হয়েছিল ঢাকা জেলা ক্রীড়া সমিতি মিলনায়তনে। ‘ঢাকা থিয়েটারের’ প্রথম সেই নাটকের টিকেটের দাম ছিল দুই টাকা। সেই থেকেই যাত্রা, তারপর পাঁচ দশকের পথ হেঁটে বাংলা নাটকের জমিনকে করেছে সমৃদ্ধ।

সুবর্ণজয়ন্তীতে উপস্থিত আরেক বরেণ্য অভিনয় শিল্পী ফেরদৌসী মজুমদার বলেন, “ঢাকা থিয়েটারের ৫০ বছর উদযাপনে আসতে পেরে আমার ভালো লাগছে। আমার বিয়ে হয়েছে ৫২ বছর হল, আর ঢাকা থিয়েটার ৫০ বছর হল। আগামী বছর এমন আয়োজনে আসতে পারব কিনা জানি না। এখানে এসে ঢাকা থিয়েটারের এই উৎসব দেখে আমার খুব ভালো লাগছে। ঢাকা থিয়েটারের জয় হোক।”

                                                                                            মামুনুর রশীদ

আশির দশকে শিল্প-সংস্কৃতির যে স্বপ্নটি তৈরি হয়েছিল, সেটি এখন নেই উল্লেখ করে মামুনুর রশীদ বলেন, “আশির দশকে আমরা সংস্কৃতিতে যে স্বপ্নটি দেখেছিলাম, সেই স্বপ্নটি এখন ভেঙে খান খান হয়ে যাচ্ছে। এটি আমাদের বেদনার্ত করে। ঢাকা থিয়েটার আমাদের নাট্যচর্চায় নতুন পথ দেখিয়েছে। তাদের অগ্রযাত্রার জয় হোক।”

ঢাকা থিয়েটারের নামকরণ যিনি করেছিলেন, সেই ম. হামিদ বলেন, “এখানে এসে বাংলাদেশের নাটকের উজ্জ্বল সব মুখ দেখে ভালো লাগছে। তাদের সামনে আসতে পেরে আমার ভীষণ ভালো লাগছে।”

উদ্বোধনী আলোচনার পর পরীক্ষণ থিয়েটার মিলনায়তনে মঞ্চস্থ হয় ‘প্রাচ্য’।

নাটক শেষে নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলেন, “ঢাকা থিয়েটারের প্রশংসিত নাটকের একটি হলো প্রাচ্য। অনেক বছর নাটকটি মঞ্চে নিয়মিত ছিল না। সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানকে ঘিরেই নাটকটি আবারও মঞ্চে আনা হয়েছে। এখন থেকে নাটকটি নিয়মিত মঞ্চায়নের পরিকল্পনা রয়েছে।”

১৯৭৩ সালে ঢাকা থিয়েটার মঞ্চে আনে ‘সংবাদ কার্টুন’, ‘সম্রাট ও প্রতিদ্বন্দ্বীগণ’। ১৯৭৪ সালে ‘জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন’, ‘বিদায় মোনালিসা’। এরপর ‘মুনতাসির’ [১৯৭৬], ‘চর কাঁকড়া’, ‘ফণিমনসা’ [১৯৭৭], ‘শকুন্তলা’ [১৯৭৮]।

ঢাকা থিয়েটারের উল্লেখযোগ্য প্রযোজনার মধ্যে আরও রয়েছে- মুনতাসির ফ্যান্টাসি’, ‘ধূর্ত ওই’, ‘কেরামত মঙ্গল’, ‘কিত্তনখোলা’, ‘ত্রিরত্ন’, ‘শকুন্তলা’, ‘হাতহদাই’, ‘যৈবতী কন্যার মন’, ‘চাকা’, ‘বনপাংশুল’, ‘বিনোদিনী’, ‘একাত্তরের পালা’, ‘নিমজ্জন’, ‘মার্চেন্ট অব ভেনিস’ ও ‘দ্য টেম্পেস্ট’।

এমএম//