ঢাকা, শনিবার   ১২ অক্টোবর ২০২৪,   আশ্বিন ২৭ ১৪৩১

যে কারণে হয় করোনারি হৃদরোগ

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০২:৫৯ পিএম, ২০ আগস্ট ২০২৩ রবিবার

চিকিৎসাবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী ও সমাজবিজ্ঞানীরা করোনারি হৃদরোগের জন্যে ঝুঁকিপূর্ণ কয়েকটি কারণকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করেছেন।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, বয়স যত বাড়তে থাকে হৃদরোগের আশঙ্কাও তত বাড়তে থাকে। আমরা যদি দেখি, হৃদরোগ সাধারণত কোন বয়সে হয়? অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এটি হয় বয়স ৪০-এর কোঠায় এসে বা তার পরে। কেন?

সমাজবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীরা এর একটি কারণ খুঁজে বের করেছেন। ৪০ হচ্ছে এমন একটি বয়স, যে বয়সে এসে একজন মানুষ জীবনের অঙ্ক মেলাতে শুরু করে—কী চেয়েছিলাম, কী পেলাম আর কী হারালাম?

বিষয়টা আরেকটু স্পষ্ট করা যাক। শৈশব থেকে মানুষের জীবনের প্রতিটি পর্যায়েই তার কিছু স্বপ্ন থাকে। তারুণ্যে পৌঁছে সে দেখে একটি সমৃদ্ধ জীবনের স্বপ্ন—এমন একটি চাকরি বা ব্যবসা করব, এরকম একটি সামাজিক অবস্থান আমার হবে কিংবা এমন একজন জীবনসঙ্গী বা সঙ্গিনী হবে। একসময় সে বাস্তব জীবনে প্রবেশ করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শুরু হয় স্বপ্নের সাথে বাস্তবতার দ্বন্দ্ব। স্বপ্নের পরিধিও ছোট হতে থাকে ক্রমশ। বাড়তে থাকে না-পাওয়ার অতৃপ্তি আর কষ্ট।

একসময় বয়স ৪০ বছর পার হয়, সে তখন ফিরে তাকায় ফেলে আসা জীবনের দিকে। নিজেই বুঝতে পারে—যা চেয়েছিলাম তার অনেক কিছুই পাওয়া হয় নি। ভেতরে শুরু হয় এক ধরনের অতৃপ্তি আর অশান্তি। কেউ ভোগে না-পাওয়ার বেদনায়, কেউ ভুগতে থাকে বিষণ্নতায়। দিনের পর দিন  এই যে কষ্ট, এটি শুধু মনেই সীমাবদ্ধ থাকে না। এই বিষণ‌্ন-ব্যথাতুর  হৃদয়ের প্রভাব নিশ্চিতভাবেই পড়ে তার হৃদযন্ত্রেও।

অন্যান্য মনোদৈহিক রোগগুলোর মতো করোনারি হৃদরোগের অন্যতম কারণও মূলত এই হাহাকার। একবার যদি এ অতৃপ্তি ভেতরে জেঁকে বসে আর সর্বক্ষণ মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকে যে, যা চেয়েছিলাম তা পেলাম না, কেন পেলাম না, না পেয়ে কী হারালাম—তবে আর রক্ষা নেই। আপনার সমস্ত অর্জন তখন আপনার কাছে ফিকে হয়ে যেতে পারে। ব্যর্থতার অনুভূতি আপনাকে তাড়িয়ে বেড়াতে পারে প্রায় সারাক্ষণই, যা দীর্ঘমেয়াদে নানা শারীরিক-মানসিক রোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

হৃদরোগের প্রবণতা পুরুষদের মধ্যে তুলনামূলক বেশি। তবে মহিলাদের ক্ষেত্রে মেনোপজের বা ঋতুচক্র বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর হৃদরোগের আশঙ্কা বাড়তে থাকে। মহিলাদের মধ্যে যারা নিয়মিত জন্মবিরতিকরণ ওষুধ সেবন করেন, তাদের করোনারি হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।

মা-বাবার হৃদরোগ থাকলে তাদের সন্তানদেরও হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। গবেষকদের মতে, এর মূল কারণ পারিবারিক ভুল খাদ্যাভ্যাস, অতিরিক্ত ওজন, শারীরিক পরিশ্রমের অভাব ও ধূমপানের ইতিহাস। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ একজন মানুষ শৈশব থেকে প্রায় সব ব্যাপারেই পারিবারিক রীতি আচার ও ঐতিহ্যে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। যেমন : মা-বাবা বেলা করে ঘুম থেকে উঠলে সন্তানও সেভাবেই বেড়ে ওঠে। মা-বাবা ব্যায়াম বা হাঁটাহাঁটি না করলে সন্তানও ব্যায়ামের প্রতি আগ্রহী হয় না। বাবা ধূমপায়ী হলে সন্তানেরও ধূমপায়ী হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

খাদ্যাভ্যাসও তেমনই একটি উল্লেখযোগ্য পারিবারিক অভ্যাস। পরিবারে যে ধরনের খ্যাদ্যাভ্যাস চালু থাকে, জীবনের শুরু থেকেই মানুষ সাধারণত সে খাদ্যাভ্যাসে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। তাই পারিবারিক অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস বংশগত হৃদরোগের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ।

যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা ইউনিভার্সিটির স্কুল অব পাবলিক হেলথ ও সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির এক যৌথ গবেষণা রিপোর্টে বলা হয়েছে, অল্প বয়সেই হার্টের রক্তনালী সংকুচিত হয়ে যাওয়া এবং হার্ট অ্যাটাকের জন্যে যে-সব কারণকে দায়ী করা হয়, তার মধ্যে ধূমপানের অবস্থান শীর্ষে।

এ-ছাড়াও হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ৪০ বছরের কম বয়সী রোগীদের ওপর একটি জরিপে দেখা গেছে, তাদের শতকরা ৮৫ ভাগই ছিল ধূমপায়ী।

হৃদরোগ হওয়ার পেছনে রিফাইন্ড ফুড অর্থাৎ তেল, চিনি, সাদা চাল, সাদা ময়দার ভূমিকা এখন প্রমাণিত। এ সকল খাবার একদিকে যেমন ওজন বৃদ্ধি এবং কোলেস্টেরল ও ট্রাইগ্লিসারাইড বাড়ার জন্যে দায়ী; অন্যদিকে এসব খাবারে নেই কোনো ভিটামিন, মিনারেল বা ফাইটোকেমিক্যাল। ফলে এসব খাবার হৃদরোগসহ বিভিন্ন জটিল রোগ সৃষ্টি করে।  

হৃদরোগ হওয়ার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে পাশ্চাত্যের খাদ্যশিল্প ধূমপান

যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা ইউনিভার্সিটির স্কুল অব পাবলিক হেলথ ও সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির এক যৌথ গবেষণা রিপোর্টে বলা হয়েছে, অল্প বয়সেই হার্টের রক্তনালী সংকুচিত হয়ে যাওয়া এবং হার্ট অ্যাটাকের জন্যে যে-সব কারণকে দায়ী করা হয়, তার মধ্যে ধূমপানের অবস্থান শীর্ষে।

এ-ছাড়াও হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ৪০ বছরের কম বয়সী রোগীদের ওপর একটি জরিপে দেখা গেছে, তাদের শতকরা ৮৫ ভাগই ছিল ধূমপায়ী।

হৃদরোগ হওয়ার পেছনে রিফাইন্ড ফুড অর্থাৎ তেল, চিনি, সাদা চাল, সাদা ময়দার ভ‚মিকা এখন প্রমাণিত। এ সকল খাবার একদিকে যেমন ওজন বৃদ্ধি এবং কোলেস্টেরল ও ট্রাইগিøসারাইড বাড়ার জন্যে দায়ী; অন্যদিকে এসব খাবারে নেই কোনো ভিটামিন, মিনারেল বা ফাইটোকেমিক্যাল। ফলে এসব খাবার হৃদরোগসহ বিভিন্ন জটিল রোগ সৃষ্টি করে।  

হৃদরোগ হওয়ার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখছে পাশ্চাত্যের খাদ্যশিল্প (Food Industry)। পুষ্টিবর্জিত এসব খাবারে (চিপস, ক্র্যাকার্স, ফাস্ট ফুড, টিনজাত ও প্যাকেটজাত খাবার, কোমল পানীয়, জ্যাম, জেলি, জুস ইত্যাদি) ব্যবহৃত হয়ে থাকে পাঁচ ধরনের ১৫ হাজার কেমিক্যাল, যা মানবদেহের জন্যে অত্যন্ত ক্ষতিকর। যেমন : ফুড কালার, ফুড টেস্টার, ফ্লেভার, ফ্যাটেনার ও অ্যাডিক্টার। কেমিক্যালযুক্ত এসব খাবার ক্যান্সার, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও কিডনি রোগের অন্যতম কারণ।

তৈলাক্ত চর্বিযুক্ত ভাজাপোড়া খাবার রক্তের টোটাল কোলেস্টেরল ও ক্ষতিকর এলডিএল কোলেস্টেরল বাড়ায়—যা হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ ও স্ট্রোকের  ঝুঁকি তৈরি করে।  

ভুল খাদ্যাভ্যাস এবং ভুল পদ্ধতিতে রান্নার কারণে খাবারের মধ্যে থাকা ভিটামিন, মিনারেল ও ফাইটোকেমিক্যাল নষ্ট হয়, যা সুস্থতার জন্যে অত্যন্ত প্রয়োজন। তাজা ফল, কাঁচা সালাদ, কাঁচা সবুজ পাতা, বাদাম, বীজ, বিন এবং অর্ধসেদ্ধ শাকসবজিতে এই উপাদানগুলো পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যায়।

করোনারি হৃদরোগের একটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কারণ অনিয়ন্ত্রিত রক্তচাপ। ধমনীর ভেতর দিয়ে রক্ত প্রবাহিত হওয়ার সময় এটি ধমনীর গায়ে একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় চাপ দেয়। আর এই চাপ যদি স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেড়ে যায়, সেটিই উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন। অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ থাকলে করোনারি ধমনীর অভ্যন্তরে ক্ষতের সৃষ্টি হয়। রক্তপ্রবাহে ভেসে বেড়ানো অতিরিক্ত কোলেস্টেরল সেই ক্ষতের জায়গাটিতে আটকে যায়। এভাবে রক্ত চলাচলের পথে পরবর্তীতে আরো কোলেস্টেরল একটু একটু করে সেই একই জায়গায় জমতে থাকে। যার ফলাফল করোনারি ব্লকেজ।

ডায়াবেটিস একটি নীরব ঘাতক। শরীরের প্রায় সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ওপরই এর  রয়েছে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর প্রভাব। হৃৎপিন্ড ও এর ব্যতিক্রম নয়। তাই ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে করোনারি হৃদরোগের ঝুঁকি অনেক বেশি। ডায়াবেটিস একাই হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায় প্রায় ৩৩%। আর এর সাথে উচ্চ রক্তচাপ যোগ হলে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৬৬%।

যখন রক্তে মোট কোলেস্টেরল (ঞড়ঃধষ ঈযড়ষবংঃবৎড়ষ), এলডিএল কোলেস্টেরল (Total Cholesterol) ও ট্রাইগ্লিসারাইডের (LDL Cholesterol) পরিমাণ বেড়ে যায়, তখন হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ে। অন্যদিকে উপকারী এইচডিএল কোলেস্টেরলের (HDL Cholesterol) পরিমাণ কমে গেলেও হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ে। আর এ সবকিছু ঘটে মূলত ভুল খাদ্যাভ্যাস, ধূমপান, মেদস্থূলতা এবং ব্যায়াম বা শারীরিক পরিশ্রমের অভাবের কারণে।

অতিরিক্ত ওজন যাদের, তাদের শরীরে রক্ত সরবরাহ করতে হৃৎপিন্ডকে তুলনামূলক বেশি কাজ করতে হয়। এটিও হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। মূলত খাবার থেকে প্রাপ্ত ক্যালরির পরিমাণ ও সে ক্যালরি ব্যবহারে অসামঞ্জস্যতাই অতি-ওজনের কারণ। অত্যধিক ওজনের ফলে উচ্চ রক্তচাপ, কোলেস্টেরলের আধিক্য ও ডায়াবেটিসের ঝুঁকিও বেড়ে যায় অনেক গুণ।

আধুনিক ও নাগরিক সুযোগ-সুবিধাপূর্ণ জীবনে আমরা সবাই কমবেশি গা ভাসিয়ে দিয়েছি। অথচ শারীরিকভাবে নিষ্ক্রিয় ও পরিশ্রমহীন অলস জীবনযাপনে অভ্যস্ত যারা, তাদের অকালমৃত্যু ও হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার হার কায়িক পরিশ্রমে অভ্যস্তদের চেয়ে তুলনামূলক বেশি। তাই বলা হয়ে থাকে ‘যত আরাম তত ব্যারাম’।

সবমিলিয়ে এগুলোই করোনারি হৃদরোগের অন্যতম প্রধান ঝুঁকি ও কারণ। যদি একজন মানুষের জীবনে একাধিক ঝুঁকি বিদ্যমান থাকে, তবে তার হৃদরোগের আশঙ্কাও সেই অনুপাতে বাড়ে।

অবশ্য করোনারি হৃদরোগের কারণ আলোচনায় এটিই শেষ কথা নয়; চিকিৎসাবিজ্ঞানের সাম্প্রতিক গবেষণাগুলোও তা-ই বলছে। কারণ কারো কারো ক্ষেত্রে দেখা যায়, অতিরিক্ত ওজন, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস কিংবা মাত্রাতিরিক্ত কোলেস্টেরল—এর কোনোটিই নেই, অথচ তিনি করোনারি হদরোগে আক্রান্ত হয়েছেন। আবার দেখা গেল, ৮০ বছর বয়সেও বাবার হৃদযন্ত্র দিব্যি সুস্থ, কিন্তু ছেলের ৪০ না পেরোতেই হার্ট অ্যাটাক!

করোনারি হৃদরোগের পেছনে কি তাহলে এগুলো ছাড়াও কোনো গুরুত্বপূর্ণ ও উল্লেখযোগ্য কারণ আছে? আছে বৈকি। সেটি হলো, জীবন সম্পর্কে আমাদের ভুল দৃষ্টিভঙ্গি এবং এ থেকে সৃষ্ট স্ট্রেস বা মানসিক চাপ, যাকে আমরা সহজ ভাষায় বলতে পারি টেনশন। পরবর্তী অধ্যায়ে এ বিষয়টি আমাদের কাছে আরো স্পষ্ট হয়ে উঠবে।

লেখাটি ডা. মনিরুজ্জামান ও ডা. আতাউর রহমান এর লেখা এনজিওপ্লাস্টি ও বাইপাস সার্জারি ছাড়াই ‘হৃদরোগ নিরাময় ও প্রতিরোধ’ শীর্ষক বই থেকে নেয়া হয়েছে। 

এমএম//