ঢাকা, মঙ্গলবার   ১৪ মে ২০২৪,   বৈশাখ ৩০ ১৪৩১

কবি তারেক মাহমুদের অকাল প্রয়াণ ও আমাদের দৈন্যতা

মিলটন রহমান

প্রকাশিত : ০৪:৫৪ পিএম, ২৯ অক্টোবর ২০২৩ রবিবার | আপডেট: ০৪:৫৭ পিএম, ২৯ অক্টোবর ২০২৩ রবিবার

কবি তারেক মাহমুদ আমার প্রথম প্রকাশক। তার সাথে আমার অজস্র স্মৃতি। আজ তিনি নিজেই স্মৃতি হয়ে গেলেন। কিছুটা স্মৃতি তর্পনের মাধ্যমে বাকি কথা বলতে চাই। অনেক কথা মনে পড়ছে। নব্বইয়ের প্রথম ভাগে তার সাথে আমার পরিচয়। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা গেলেই আড্ডা হতো শাহবাগে। কিছুদিন পর ঢাকায় আমিও স্থায়ী হলাম। এরপর প্রায় প্রতিদিনই দেখা হতো। আমরা এক সাথে একটি দৈনিকে কাজ করতাম। তারেক ‘পথিক‘ নামে একটি ছোট কাগজ প্রকাশ করতেন। তাতে লিখেছি আমি। এক সময় আজিজ সুপারের বেইসমেন্টে একটা অফিস নেন। সেখানেই জমতো আমাদের সন্ধ্যাকালীন আড্ডা। সেই আড্ডা কোন কোন সময় মধ্যরাত পার হয়ে যেতো। এক সময় তিনি ‘ছায়ালোক প্রকাশনী‘ শুরু করেন।

২০০১ সালের শেষ দিকে হঠাৎ একদিন বলে বসলেন, ‘গুরু আপনার গল্পের পাণ্ডুলিপি দেন‘। আমি হাসতে হাসতে বললাম, ‘আরে আমার গল্পের বই কে কিনবে‘। তারেক বললেন, ‘কি বলেন, আমি নিজেই আপনার গল্পের মুগ্ধ পাঠক। আপনি পাণ্ডুলিপি দেন‘। মাঝে আরো কিছুদিন যায়। আরেকদিন একই কথা, ‘ভাই পাণ্ডুলিপি কই?‘ আর না করতে পারি নি। বিভিন্ন পত্রিকায় ছাপা গল্পের কাটিংগুলো এনে দিই। কয়েকদিন পর বললেন, প্রচ্ছদ করে দিতে। বললাম, আমার সাথে কোন প্রচ্ছদ শিল্পীর পরিচয় নেই। আপনি করে নিন। এভাবে আরো ক‘টা দিন গেলো। সে সময় আমি ড. রফিকুল ইসলামের ‘কিউবিজম ও অনুসঙ্গ‘ গ্রন্থটি পাঠ করছিলাম। হঠাৎ সেই গ্রন্থের একটি ছবিতে চোখ আটকে গেলো। সেই ছবিটি তাকে দিয়ে বললাম, এটা দিয়ে প্রচ্ছদ করে নিন।

এভাবে ২০০২ সালের একুশে বইমেলায় তারেক প্রকাশ করেন আমার প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘ব্রুটাস পর্ব ও কর্তার শারিরীক অবনতি‘। সেই সময়টি ছিলো আমার জন্য বিস্ময়ের। প্রথম গ্রন্থ বলে কথা। আমার আরো বিস্ময় জাগে যখন তিনি সেই গল্পগ্রন্থটি একুশে বইমেলায় ছায়ালোক স্টলে ৭৩ কপি বিক্রি করেছিলেন! এরপর আমার আর কোন গ্রন্থ প্রকাশ হয়নি ২০১০ সাল অবদি। তারেক মাহমুদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। আমি বহু অনুষ্ঠানে তার কথা বলেছি আমার প্রথম প্রকাশক হিশেবে। তার সাথে আমার এতো বেশি কথা অল্পতে বলা সম্ভব নয়। একটা চা ভাগ করে পান করা। কলা ও বনরুটি দুই ভাগ করে খাওয়া। এমন অনেক স্মৃতি। 

একদিন তার ছায়ালোকে দেখলাম ভীষণ সুন্দরী একটি মেয়ে বসে আছেন। জিজ্ঞেস করলাম কে? সোজা জিজ্ঞেস করলেন, পছন্দ হয়েছে? বললাম হুম, খুব। বললেন, ‘বিয়ে করে ফেলবো নাকি? বললাম, একেবারে কোন কিছু না ভেবেই করা উচিত। সেই মেয়েটিকেই তারেক বিয়ে করেছিলেন।  তারেক পরে ‘ছায়ালোক‘ থেকে নাটক তৈরী করেছেন। নিজে অনেক নাটকে অভিনয় করেছেন। তার অদম্য ইচ্ছে ছিলো অনুকরণীয়।  তারেক মাহমুদের হঠাৎ চলে যাওয়ার সংবাদটি আমি সহজে নিতে পারি নি। তার সাথে আমার যে সময়ের সবচেয়ে বেশি স্মৃতি সে সময় ছিলো ঢাকা শহরে আমাদের অন্যরকম সময়। সে সময় ভুলে যাওয়ার নয়। তার মৃত্যু সংবাদ শুনার পর সব স্মৃতি ভীড় করছে। তারেক জীবদ্দশায় কি কাজ করে গেছেন তার চেয়েও আমার মনে পড়ছে তার সেই সদাহাস্য মুখখানি। কোন কষ্ট তার সে হাসি চাপা দিতে পারে নি। নিশ্চয় তারেক সে হাসি নিয়েই চলে গেছেন পরপাড়ে। ওই হাসির উদ্যান হোক তার সমাধি।

তারেক মাহমুদের মৃত্যুর পর বহু প্রশ্ন আমার মনে জেগেছে। মনে হয়েছে ‘কবি তারেক মাহমুদ‘ আমাদের জন্য একটি প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিসের প্রতীক? শিল্প-সাহিত্য চর্চার মধ্য দিয়ে একজন পরিপূর্ণ ও শুদ্ধ মানুষ হওয়ার চেষ্টা প্রতীক। তারেককে ঢাকা শহরে যারা চেনেন সবাই এক বাক্যে স্বীকার করবেন, তার সততায় কোন গলদ ছিলো না। বহু কঠিন সময় তিনি পার করেছেন। খেয়ে না খেয়ে দিনের পর দিন কাটিয়েছেন। এক কবিতার জন্য পাবনা ছেড়ে রাজধানীতে এসে বোহেমিয়ান জীবন বেছে নিতে দ্বিধা করেন নি। তিনি কেবল কবি হতেই চেয়েছিলেন। সাংবাদিকতায় তার খুব বেশি আগ্রহ ছিলো না। টাকা কড়ির জন্য মাঝে মধ্যে করেছেন। কিন্তু বারবার ফিরে গেছেন কবিতার কাছে। ওই কবিতায়ই তাকে অভূক্ত জীবনের মধ্যে টেনে নামালেও অসৎ হতে দেয় নি। এতো প্রতিকূলতার মধ্যেও তারেকের মুখে হাসি ম্লান হতে দেখি নি কখনো। এক সময় কিছুটা সচ্ছলতার আশায় প্রকাশ করতে শুরু করেন লিটলম্যাগ ‘পথিক‘। যদিও তিনি পথিককে ছোট কাগজ বলতেন না। বলতেন সাহিত্যের বড় কাগজ। প্রচ্ছদে লেখাও থাকতো ‘ব্রু মেগ‘। সে  পত্রিকায় আমার অনেক লেখা ছেপেছেন তিনি। ছাপা হয়েছিলো আমার নেয়া পশ্চিমবঙ্গের কথাসাহিত্যিক আবুল বাশার‘র সাক্ষাৎকার। সে সময় ভারতে সবরমতি ট্রেনে অগ্নিসংযোগের বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর। আবুল বাশার সে সব বিষয় নিয়ে হিন্দুত্ববাদী বিজেপির কড়া সমালোচনা করেছিলেন। ওই সময় এ সাক্ষাৎকার কেউ ছাপতে রাজি হয়নি। সাপ্তাহিক ২০০০ আমাকে দিয়ে সে সাক্ষাৎকার করালেও এনে দেয়ার পর ছাপেনি। দু‘টো জায়গায় সেটি ছাপা হয়। সাপ্তাহিক কাগজ আর পথিক এ।

আমার খুব মনে পড়ে, সাক্ষাৎকারটির বিষয়ে জানানোর পর তারেক অত্যন্ত সাহসীকতার সাথেই বলেছিলেন, ‘সত্য কথা কাউকে না কাউকে বলতে হবে। আমি ছাপবো।‘ এমনই ছিলেন তারেক মাহমুদ। বিয়ে করে কিছুদিন ভালোই ছিলেন। তবে তা বেশিদিন টেকে নি। তারেক আবার একা হয়ে যান। বেঁচে থাকার জন্য নাটকে অভিনয় শুরু করেন। সিনেমা তৈরীতে হাত দেন। এক সময় সেই পথেও কাটে নি তার অন্ধকার। সে আক্ষেপ তার ফেসবুকে বারবার ধ্বনিত হয়েছে। আমরা কেউ কি শুনেছি তার সেইসব হাহকার? শুনি নি। কারণ শুদ্ধ শিল্পের জায়গায় আমরা নেই। আমরা এখন কর্পোরেটবাজিতে ব্যস্ত। শিল্প-সাহিত্যের সেই মার্জিত ভূমিটিকে আমরা পুঁজিবাদের দাস বানিয়েছি। পুঁজিপতিদের কাছে বারবার ধর্ষিত আমাদের সেই শিল্প-সাহিত্য। রাষ্ট্রের কথা আর কিইবা বলি। আমরা ডিজিটাল হয়েছি, আমরা উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে যাচ্ছি। বিশ্বের কাছে আমরা উন্নত দেশ হিশেবে পরিচিতি লাভ করছি। যদিও তারেক মাহমুদের মতো একজন শুদ্ধ মানুষ অভাবের তাড়নায় সিনেমা বানানোতো দূরে থাক,দু‘বেলা ঠিকমতো খেতে পারাটাও ছিলো অনিশ্চিত।

আমরা এতোটাই উন্নয়নে আছি যার ফলে অভাবের তাড়নায়ে একই পরিবারের আট সদস্য আত্মহত্যা করে! জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজীবন শুদ্ধ মানুষ খুঁজেছেন। মেধা দেখলেই তাকে ঠিক জায়গায় দাঁড়ানোর সুযোগ করে দিয়েছেন। আমরা তো এখন বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সেই আওয়ামী লীগ চালিত সরকারের অধীনেই আছি। তাহলে গলদ কোথায়? বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ কি ভুলে গেছে, গরীব অসহায় মানুষের সেবায় তিনি কিভাবে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন? কিভাবে দূর্ভিক্ষের সময় লঙ্গরখানা খুলে মানুষের মুখে আহার তুলে দিয়েছিলেন? সারাদিন মানুষের সেবা করে যিনি পার্টি অফিসের টেবিলেই ঘুমিয়ে পড়তেন। আমরা সেই মহান মানুষটিকে ভুলে গেছি। তাঁর সেই মহত্ব আমরা স্মরণে রাখি নি। আমরা তাঁর নাম ভাঙ্গিয়ে এক একজন শীর্ষ ধনী হওয়ার প্রতিযোগিতায় মত্ত।

বঙ্গবন্ধু ছিলেন শিল্প-সাহিত্যের একনিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষক। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মধ্যেও সেই গুণ বিরাজিত। তাহলে গলদ কোথায়? কেনো আমাদের দেশে এখনো কবি-সাহিত্যিকদের মূল্যায়ন সবচেয়ে নিম্নস্তরে! যার বিরূপতায় বাংলাদেশ এখন প্রায় শিল্প-সাহিত্য শূন্যতার দিকে এগুচ্ছে। বণিক শ্রেণির কিছু মানুষ নিজের নামের সাথে কবি, সাহিত্যিক তকমা লাগিয়ে আর্থিক লাভবান হচ্ছে। নানান আয়োজনের মাধ্যমে সরকারী তহবিল ভোগ করছে। অত্যন্ত নীচুমানের তথা পদলেহন জাতের কিছু অনুষ্ঠান করে তারা সরকারের ছত্রছায়ায় ভালোই কামাই করছে। তারেক মাহমুদ বা তার মতো যারা রয়েছে, যাদের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে প্রকৃতই শিল্প-সাহিত্য করা। তারা প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে করতে হয়রান। তাদের নেই সরকারী কোন পৃষ্টপোষকতা। নেই তাদের খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা। শিল্প-সাহিত্যের সরকারী কিংবা স্বায়ত্বশাসিত যেসব প্রতিষ্ঠান রয়েছে তাতেও কোথাও এদের জায়গা হয় না। কারণ সেসব প্রতিষ্ঠানে যারা একবার আসন গেড়ে বসেছেন তাদের আর সরায় কে! বছরের পর বছর তারা পালের গোদা হয়েই বসে আছেন। ইউরোপ-আমেরিকার কথা বাদই দিলাম, আমাদের পার্শবর্তী দেশ ভারতে শিল্পী-সাহিত্যেকদের যে কদর রয়েছে তার শিকিভাগ আমাদের নেই।

আমি সম্প্রতি ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা‘য় যোগ দিয়েছিলাম। তাদের দেখেছি ভারতের বিপুল সংখ্যক প্রকাশক যোগ দিয়েছেন। যোগ দিয়েছেন ভারতের বিপুল সংখ্যক কবি-সাহিত্যিক। তারা নিজেদের সাহিত্যকে তুলে ধরলেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কাছে। আমাদের শীর্ণকায় একটা স্টল ছিলো। কবি মিনার মনসুর জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র থেকে উপস্থিত ছিলেন সেখানে। তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন সীমিত সাধ্যের মধ্যে অর্জনের পাল্লা ভারি করতে। তাঁকে বারবার বলতে শুনেছি, আগামীতে আরো ভালো করতে চান। এ বিষয়ে সরকারের সহযোগিতা পাবেন বলেই তিনি আশাবাদী। কারণ তিনি বিশ্বের বৃহত্তর এই বইমেলায় এসে নিশ্চয় নিজের অস্তিত্বকে আবিষ্কার করতে পেরেছিলেন। আমার মনে হয় মিনার মনসুরের মতো একজন কবি ও দক্ষ সংগঠককে ঠিকঠাক মতো কাজে লাগাতে পারলে এবারের ফ্রাঙ্কফুর্ট মেলাও সফল হতো বাংলাদেশের জন্য। 

এই যখন আমাদের দশা তখন উত্তরণের পথ খোঁজা জরুরী বলেই মনে করি। দেশের উন্নয়ন হচ্ছে তা অস্মীকার করার কোন সুযোগ নেই। কিন্তু আমাদের মৌলিক উন্নতির খবর কি আমরা জানি? জানি না। সবাই উপরের চাকচিক্য নিয়েই ব্যস্ত। আমরা কতটুকু মানবিক মানুষ হতে পেরেছি, আমাদের মানসিক উৎকর্ষ কতটুকু হলো? তার মূল্যায়ন কেউ কি করে? কোন প্রতিষ্ঠান, সংগঠন কি রয়েছে এ বিষয়ে কাজ করার? যদি না থাকে তাহলে বিরাজমান উন্নয়ন পরিকল্পনা বা উন্নয়ন দেশে ইতিবাচক কোন প্রভাব তৈরী করবে কিনা সন্দেহ থেকেই যায়। আমরা যদি নিজের সংস্কৃতি ভুলে যাই। নিজের সাহিত্যকে ঠাট্টাচ্ছলে উড়িয়ে দেই তাহলে আমাদের ধ্বংস অনিবায্য। এ ধ্বংস কেউ ঠেকাতে পারবে না। 

তারেক মাহমুদ এবং তারেক মাহমুদরা দেশকে এই ধ্বংসযজ্ঞ থেকে বাঁচাতেই নিজ দায়িত্বে কাধে জোয়াল তুলে নিয়েছেন। পৃষ্টপোষকতা না থাকলে তারেকের মতো আরো অনেকেই ঝড়ে যাবেন একে একে। দেশ হারাবে অমূল্য এবং মানবিক সম্পদ। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যেসব অমর সাহিত্য সম্ভার তৈরী হয়েছে, তেমন আর কোন কাজ হবে না। আমরা ক্রমান্বয়ে মানুষত্বহীনেএকচি জাতীতে পরিণত হবো, তাতে কোন সন্দেহ নেই। আমাদের উচিত নিশ্চিত করা যে, তারেক মাহমুদ‘ এর মতো ধুকে ধুকে কেউ যেনো নিঃশেষ হয়ে না যায়। 

লেখক-কবি ও লেখক, যুক্তরাজ্য প্রবাসী।