ঢাকা, মঙ্গলবার   ১৪ মে ২০২৪,   বৈশাখ ৩০ ১৪৩১

‘না-পাওয়ার তুলনায় জীবনের প্রাপ্তিগুলো অনেক বেশি’

ডা. সুরেশ কুমার

প্রকাশিত : ০৩:৪৮ পিএম, ১২ নভেম্বর ২০২৩ রবিবার | আপডেট: ০৩:৫২ পিএম, ১২ নভেম্বর ২০২৩ রবিবার

ডা. সুরেশ কুমার, দক্ষিণ ভারতের কেরালায় কমিউনিটি বেইজড প্যালিয়েটিভ কেয়ারের প্রবর্তক এবং ইনস্টিটিউট অব প্যালিয়েটিভ মেডিসিনের (আইপিএম) প্রতিষ্ঠাতা ও প্রাক্তন পরিচালক।

জীবন ও মৃত্যু একে অপরের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত। এটা একটা সুর বা সিম্ফনির মতো। শুরু থেকে বেসুরো বাজিয়ে হঠাৎ করে শেষের অংশটুকু সুরেলা হয়ে যাবে—এমনটা ভাবা সঙ্গত নয়। একইভাবে যাপিত জীবনটাকে সুন্দর করার চেষ্টা না করে একটা প্রশান্তিময় মৃত্যুর প্রত্যাশাও আমরা করতে পারি না। এ কারণেই আমি বিশ্বাস করি—ভালো মৃত্যুর পূর্বশর্ত হচ্ছে ভালোভাবে বাঁচা।

পরিসংখ্যান বলে, পৃথিবীতে মাত্র ১০ শতাংশ মানুষ আকস্মিক মৃত্যুর শিকার হয়। বাকি ৯০ শতাংশের ক্ষেত্রে কী ঘটে তাহলে? তারা নানান রোগে ভুগে ধুঁকে ধুঁকে মারা যায়। যখন কেউ জানতে পারে—আর ছয় মাস পর সে মারা যাবে, তখন হঠাৎ করেই তার মনে হয় যেসব বিষয় এতদিন গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তার অধিকাংশই এখন অপ্রয়োজনীয় বা অবান্তর। এ বাস্তবতায় মৃত্যুটা যেন সহনীয় হয়, সেই সাহায্যটা এসময় প্রয়োজন। কিন্তু সাহায্য আসবে কার কাছ থেকে? সমাজের কাছ থেকে।

আমাদের ব্যাকগ্রাউন্ড যা-ই হোক, মৃত্যুর মুখোমুখি সবাইকেই হতে হবে। এজন্যে জানতে হবে, জীবনের শেষ দিনগুলোতে কীভাবে একজন মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। ভারতে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশা-বয়সের মানুষকে আমরা এ লক্ষ্যেই প্যালিয়েটিভ কেয়ার প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। শুধু জীবনের অন্তিম সময়ে সেবা-শুশ্রুষা দেয়াই নয়, প্যালিয়েটিভ কেয়ার মানুষকে সামনের দিকে তাকাতে উদ্বুদ্ধ করে। এটা একটা লাইফ স্কিল। সমাজের সবার জন্যেই তাই আমরা স্বেচ্ছাসেবার দরজাটা খোলা রাখতে চেয়েছি।

মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের মনে প্রশ্ন জাগে, এতগুলো বছর যে পৃথিবীতে কাটালাম, আমি আসলে কী অর্জন করলাম? আনন্দ, আফসোস, প্রাপ্তি, হতাশা সবই তখন সামনে চলে আসে। জীবনটাকে তখন সে তীর্যক নানা প্রশ্নের মধ্য দিয়ে বিশ্লেষণ করতে শুরু করে। এটাকেই আমরা বলছি ‘মৃত্যুভাবনা থেকে উৎসারিত প্রজ্ঞা’।

আবার মৃত্যুপথযাত্রী মানুষটি কিছুদিন আগেও হয়তো ছিল বাড়ির কর্তা। হঠাৎ করেই সে আবিষ্কার করে, এখন সিদ্ধান্তগুলো অন্যেরা নিচ্ছে। তার সাথে সহজে কেউ কথাও বলতে আসছে না। কাছের মানুষেরা হয়তো ভয়ে ভয়েই দূর থাকছে—যদি মৃত্যু নিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো প্রশ্ন সে করে বসে? এভাবে ধীরে ধীরে সে নিজের পরিবারেও বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো হয়ে পড়ে। আমরা কি কখনো ভেবে দেখি, সেই মানুষটির সে-সময় কেমন লাগে? ঠিক এখানেই কিছুটা স্বস্তি ও মমতার স্পর্শ নিয়ে আসে প্যালিয়েটিভ কেয়ার।

মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের মধ্যে কোন ধরনের অনুশোচনা সবচেয়ে বেশি দেখা যায়?—একজন শ্রোতার এমন প্রশ্নের উত্তরে ডা. সুরেশ বলেন, অভিজ্ঞতায় দেখেছি, মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রায় প্রতিটি মানুষই ভাবতে থাকে—এতদিনের অতিবাহিত জীবন শেষ হতে যাচ্ছে, এ জীবনের অর্থ কী? অধিকাংশ মানুষের আফসোস হলো, আগে জীবনের কোনো অর্থ খুঁজি নি, শুধু দৈনন্দিন সমস্যাগুলো নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। জীবনে যা-কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভেবেছি, বড় করে দেখেছি, সেগুলোকে দাবিয়ে রেখে অন্য অনেক কিছু নিয়ে ব্যস্ত থেকেছি। কাজগুলো হয়তো সহজেই করতে পারতাম, কিন্তু বার বার পিছিয়ে দিয়েছি। ভেবেছি, গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো না-হয় পরে কখনো করব। কিন্তু কিছুই তো করা হলো না।

তারুণ্যে যে-রকম ছিল, আপনার আজকের ভাবনাগুলো তা থেকে কতটা আলাদা?—এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তারুণ্যের ভাবনাগুলো সময়ের সাথে সাথে আরো স্বচ্ছ হয়েছে। তারুণ্যে যে কাজগুলোকে আমি মহৎ ও গুরুত্বপূর্ণ ভেবেছি, পরিণত বয়সে সেগুলো আমার কাছে আরো সুস্পষ্ট হয়ে ধরা দিয়েছে। সেইসাথে ভাবনার আবর্জনাগুলো সরিয়ে বর্তমানে মনোযোগী হতে শিখেছি।

আমি সুখী একজন মানুষ। অবশ্য বরাবরই এমনটা সুখী ছিলাম না। আমার মধ্যেও অন্যদের মতো দুঃখ ছিল, হতাশা ছিল এমনকি প্যালিয়েটিভ কেয়ার নিয়ে কাজ করতে এসেও এসব অনুভূতি ছিল। কিন্তু মৃত্যুপথযাত্রী মানুষদের খুব কাছাকাছি গিয়ে একপর্যায়ে অনুভব করলাম—না-পাওয়ার তুলনায় জীবনের প্রাপ্তিগুলো অনেক বেশি! উপলব্ধি করলাম, চারপাশে অগণিত মানুষের চেয়ে কত ভালো আছি! সেইসাথে সুখী হওয়ার পথে দুটি বিষয় আমাকে খুব সাহায্য করেছে—প্রথমত, অপ্রয়োজনীয় কাজ ও বিষয়গুলোকে আমি ‘না’ বলতে পারি; দ্বিতীয়ত, গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো আমি তৎক্ষণাৎ সম্পন্ন করি, কখনো ফেলে রাখি না।

(ডা. সুরেশ কুমারের আলোচনা থেকে উল্লেখযোগ্য অংশ এখানে তুলে ধরা হল। প্যালিয়েটিভ মেডিসিন ও ডা. সুরেশ কুমার—এ দুটি মিলে যেন এক অবিচ্ছেদ্য সত্ত্বা। ১৯৯৩ সাল থেকে প্যালিয়েটিভ মেডিসিন নিয়ে কাজ করছেন ডা. সুরেশ কুমার। তিনি দক্ষিণ ভারতের কেরালায় কমিউনিটি বেইজড প্যালিয়েটিভ কেয়ারের প্রবর্তক এবং ইনস্টিটিউট অব প্যালিয়েটিভ মেডিসিন-এর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রাক্তন পরিচালক। বর্তমানে তিনি প্রতিষ্ঠানটির টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার। এ-ছাড়াও তিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কোলাবোরেটিং সেন্টার ফর কমিউনিটি পার্টিসিপেশন ইন প্যালিয়েটিভ কেয়ার অ্যান্ড লং টার্ম কেয়ার-এর ডিরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

সমমর্মী ও মানবিক সমাজ বুননের লক্ষ্যেই ডা. সুরেশ কুমার প্রথম একটি সমাজভিত্তিক ও স্বেচ্ছাসেবক-চালিত প্যালিয়েটিভ কেয়ারের ধারণা প্রবর্তন ও বাস্তবায়ন করেন। খুব নীরবে এবং প্রচারের আলো এড়িয়ে মানুষের জন্যে কাজ করে যাচ্ছে তার হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট অব প্যালিয়েটিভ মেডিসিন।

শিক্ষক দম্পতির প্রথম সন্তান ডা. সুরেশ কুমারের জন্ম ১৯৬১ সালের ১৫ জানুয়ারি কেরালার এরনাকুলাম জেলার কিচেরি গ্রামে। চার ভাইয়ের সাথে দুরন্ত এক শৈশব কাটান তিনি। তার মা-বাবা ছিলেন অহিংস নীতিতে বিশ্বাসী, যা সুরেশ কুমারের জীবনেও গভীর ছাপ ফেলে। উপরন্তু খুব অল্প বয়সেই বইয়ের জগতে তার পদচারণা ঘটে। ইতিহাস, বিজ্ঞান, সাহিত্যসহ সব ধরনের বইয়ের তিনি বরাবরই একজন উৎসুক পাঠক।

রসায়নে স্নাতক করার পর তিনি ১৯৮১ সালে ভর্তি হন কেরালার কালিকূট মেডিকেল কলেজে। পরবর্তীতে সফল একজন অ্যানেস্থেশিওলজিস্ট হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। জটিল রোগে আক্রান্ত এবং নিরাময়-অযোগ্য রোগীদের ব্যথা নিরাময়ে তার দক্ষতা ছিল প্রশংসনীয়। কিন্তু একপর্যায়ে তার মনে হলো—রোগীদের অগণিত যন্ত্রণা ও সমস্যার মধ্যে দৈহিক ব্যথাটা যেন বিশাল সমুদ্রে ছোট্ট একটা দ্বীপের মতো। অতঃপর রোগীদের বহুমাত্রিক কষ্টগুলো কমানোর পথ খুঁজতে শুরু করলেন তিনি।

ঠিক এই সময়টাতেই কালিকূট মেডিকেল কলেজে আয়োজিত একটি লেকচারে তিনি প্রথম জানতে পারেন প্যালিয়েটিভ মেডিসিন সম্পর্কে। অর্থ-নাম-যশের পথ ছেড়ে নতুন এক পথে তার যাত্রা শুরু হলো।

প্রথম বছরে ২০০ জন রোগী সেবা নিতে এলো ডা. সুরেশের কাছে। পরের বছরই সংখ্যাটা গিয়ে দাঁড়াল ২ হাজারে। এভাবেই সেবার পরিধি বাড়তে লাগল। ব্যক্তিগত একটি সিদ্ধান্ত ও উদ্যোগ আজ এক মহীরুহের রূপ নিয়েছে। কেরালায় ইনস্টিটিউট অব প্যালিয়েটিভ মেডিসিনের তত্ত্বাবধানে এ পর্যন্ত লক্ষাধিক মানুষ সেবা পেয়েছে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশ একই আঙ্গিকে গড়ে তোলার চেষ্টা করছে প্যালিয়েটিভ কেয়ারের এই অবকাঠামো, যা ‘কেরালা মডেল’ হিসেবে স্বীকৃত। বর্তমানে কেরালায় প্রায় ১৫ হাজার স্বেচ্ছাসেবক হাজারো মৃত্যুপথযাত্রীকে শুশ্রূষা দিয়ে যাচ্ছেন নিঃস্বার্থ ভালবাসায়। মৃত্যুর শীতল ও একাকী যাত্রাকে তারা ভরিয়ে দিচ্ছেন উষ্ণতার স্পর্শে। আত্মপরতা ও স্বার্থকেন্দ্রিকতার বিপরীতে তারা যেন বলছেন—বেঁচে থাকার মতোই সুন্দর এবং সম্মানের হওয়া চাই মৃত্যুটাও।)

এসবি/