ঢাকা, বুধবার   ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ২০ ১৪৩১

জন্ম তারিখ কি ভবিষ্যৎ এবং ভাগ্যকে প্রভাবিত করতে পারে?

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৫:৫৯ পিএম, ৭ অক্টোবর ২০২৪ সোমবার

আপনি কোন মাসের কোন তারিখে জন্মেছেন এবং আপনার গ্রহ-নক্ষত্র কী? প্রায়শই বন্ধুবান্ধবদের সাথে আড্ডায় এই প্রসঙ্গটি উঠে আসে। এটি প্রায় সব ধরনের সংস্কৃতিতে একটি সাধারণ কথা।

মানুষের ব্যক্তিত্ব, কর্মজীবন এবং জীবনের অন্যান্য দিকগুলোয় রাশিচক্র বা নক্ষত্রের প্রভাব সম্পর্কে আপনি নিশ্চয়ই শুনেছেন।

আমাদের নক্ষত্র এবং তাদের গতিবিধি সম্পর্কে গবেষণা করাও আমাদের অনেকের একটি সখের কাজ।

জ্যোতিষশাস্ত্র অর্থাৎ নক্ষত্রের জ্ঞান হাজার হাজার বছরের পুরনো একটি শাস্ত্র। অন্যদিকে বিজ্ঞান দীর্ঘদিন ধরে এই জ্ঞানের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে আসছে।

আপনার জন্মের মাস বা দিন বা ঋতু আপনার ভবিষ্যৎ জীবনকে প্রভাবিত করতে পারে কিনা তা খুঁজে বের করতে বিজ্ঞানীরা বেশ কয়েকটি গবেষণা পরিচালনা করেছেন।

আমাদের ব্যক্তিত্ব এবং জন্ম মাসের মধ্যে এই সংযোগ সম্পর্কে বিজ্ঞান কি বলে?

একজন ব্যক্তি কোন মাসে জন্মেছেন এবং তার ব্যক্তিত্বের উপর ওই মাসের প্রভাব সম্পর্কে ১৯৭০ এর দশকে বৈজ্ঞানিক গবেষণা হয়েছে।

কিছু গবেষক জন্ম মাসের সাথে ব্যক্তিত্বের সংযোগ নিয়ে বিতর্ক করেছেন, এর আদৌ কোন অস্তিত্ব আছে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেছেন।

সেইসাথে যুক্তি দিয়েছেন যে একজন ব্যক্তি তার জীবনে যেসব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যান, তার চরিত্র এবং ব্যক্তিত্ব সে অনুযায়ী গড়ে ওঠে।

তবে কিছু গবেষক বলেছেন যে জন্মের মাস একজন ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের উপর প্রভাব ফেলতে পারে।

২০১৩ সালে, জার্নাল অফ সোশ্যাল সায়েন্সেস একটি নিবন্ধ প্রকাশ করে। সেখানে মানুষ কোন মাসে জন্ম নিয়েছেন এবং সেই জন্ম মাসের সাথে তার ব্যক্তিত্বের সম্পর্ক নিয়ে নানা তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।

তিনি সুপরিচিত হয়ে উঠবেন নাকি সবার প্রিয় হয়ে ওঠার মতো ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠবে তার সম্ভাবনা নিয়ে বিশ্লেষণ করে।

গবেষণায় রাজনীতিবিদ এবং ক্রীড়াবিদ থেকে শুরু করে অভিনেতা এবং সঙ্গীতজ্ঞ মিলে প্রায় ৩০০ জন সেলিব্রিটির ওপর পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয়।

গবেষকরা খুঁজে পেয়েছেন যে সর্বাধিক সংখ্যক সেলিব্রিটি কুম্ভ রাশির জাতক জাতিকা।

একটি বিষয় লক্ষ্য করা উচিত যে জ্যোতিষশাস্ত্রে, জানুয়ারির শেষ থেকে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত জন্মগ্রহণকারী ব্যক্তিরা কুম্ভ রাশির অন্তর্ভুক্ত বলে ধরা হয়।

এই গবেষণাটি সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে একটি নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। তাদের মধ্যে যোগাযোগ বিষয়ের অধ্যাপক ড. মার্ক হ্যামিল্টনও আছেন। বিবিসিকে এ বিষয়ে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন তিনি।

গবেষকদের একটি দলের সাথে, তিনি তিন হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে আজকের দিন পর্যন্ত জন্মগ্রহণ করা ৮৫ হাজার বিখ্যাত এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিদের জীবন ও ব্যক্তিত্ব অধ্যয়ন করেছেন।

"আমরা এই ব্যক্তিদের তথ্য নিয়ে একই ধরনের বিশ্লেষণ করেছি এবং আমাদের গবেষণার সাথে মূল গবেষণায় আমরা যে প্যাটার্নগুলো দেখেছি তার সাথে মিলে যায়," বলেছেন ড. মার্ক হ্যামিল্টন৷

তাহলে এর মানে কি হতে পারে?

ড. হ্যামিল্টন বিশ্বাস করেন যে উত্তরটি 'ক্রোনোবায়োলজি' নামক বিজ্ঞানের একটি শাখা থেকে পাওয়া যেতে পারে, যা জীবিত সত্ত্বার ছন্দ বা চক্র নিয়ে অধ্যয়ন করে। ( the study of rhythms or cycles in living things.)

এর মানে হল, আপনার জন্মের সময় জলবায়ু এবং সূর্যের সংস্পর্শে আসার মতো কারণগুলো আপনার সারা জীবনকে প্রভাবিত করতে পারে।

ড. হ্যামিল্টন বলেছেন ক্রোনোবায়োলজি একটি নতুন ক্ষেত্র।

তিনি বলেছেন, মানুষের জন্মের সময় কী ঘটে আমরা তা দেখার চেষ্টা করেছি। বরং, এই কারণগুলো (জলবায়ু এবং সূর্যের প্রভাব) আপনার জীবনকে, এমনকি গর্ভে থাকাকালীন সময়কেও প্রভাবিত করতে পারে।

ড. হ্যামিল্টন আরো বলেন, 'জ্যোতিষশাস্ত্র শতভাগ নিশ্চিত ফলাফল নাও দিতে পারে, তবে এর কিছু দিক জীবনের সময়রেখা এবং প্রাকৃতিক প্যাটার্নের সাথে মিলে যেতে পারে।'

অন্য এক গবেষণায়, ড. হ্যামিল্টন আবিষ্কার করেছেন যে একই মাসে তবে ভিন্ন ভিন্ন বছরে জন্মগ্রহণকারী ছাত্রদের খ্যাতিমান হওয়ার সম্ভাবনা সমান নয় অথবা তাদের একই বৈশিষ্ট্য থাকবে এমনটাও দেখা যায়নি।

তিনি জোর দিয়ে বলেছেন যে, একটি ক্লাসে অন্যদের সাথে আপনার পারফরম্যান্স তুলনা করার সময়, এটা মনে রাখা জরুরি যে আপনার কিছু সহপাঠী প্রতিযোগিতায় আপনার থেকে এগিয়ে থাকতে পারে এবং এর পেছনে অবশ্যই কিছু কারণ রয়েছে।

এই পারফরম্যান্স শারীরিক কার্যকলাপ বা মেধাভিত্তিক পরীক্ষা যেকোনো কিছু হতে পারে।

এর মানে হল যে স্কুল বর্ষের শুরুতে জন্মগ্রহণকারী কেউ কেউ স্কুল বছরের শেষে জন্মগ্রহণকারীদের তুলনায় কিছুটা ভালো হতে পারে।

কারণ একই ক্লাসের কিছু শিশু অন্যদের চেয়ে কয়েক মাসের বড় হতে পারে।

শুরুতে যে বিষয়গুলো কারো উপকারে আসে তা পরবর্তীতে আপনার ব্যক্তিত্বকেও প্রভাবিত করতে পারে।

যাইহোক, স্কুলে প্রাথমিক সাফল্য আপনাকে পরিণত বয়সে আরও আত্মবিশ্বাস যোগাতে পারে।

"হকি খেলা থেকে ফুটবল খেলা পর্যন্ত এমন অনেক প্রমাণ রয়েছে যে, আপনি যদি আপনার ক্লাসে সিনিয়র হন, তাহলে আপনার পেশাদার অ্যাথলিট হওয়ার আরও ভালো সুযোগ আছে," বলেছেন ড. হ্যামিল্টন।

এটা সত্যিই আশ্চর্যজনক!

কিন্তু এই ফলাফলের মানে এই নয় যে তার ভাগ্য সেখানেই স্থির করা আছে।

ড. হ্যামিল্টন উল্লেখ করেছেন যে সময়ের সাথে সাথে এই আপেক্ষিক সুবিধাগুলো কমতে থাকে।

জন্মের সময়কাল কি মেজাজ এবং অর্জনকে প্রভাবিত করে?
ইউরোপীয় কলেজ অফ নিউরোসাইকোফার্মাকোলজি ২০১৪ সালে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

সেখানে দেখা যায় যে, আপনি যে বছর জন্মগ্রহণ করবেন তা আপনার মেজাজের উপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে।

গবেষণায় দেখা গেছে যে, যারা বসন্ত এবং গ্রীষ্মে জন্মগ্রহণ করেন তাদের হাইপারথাইমিক মেজাজ থাকে, যার অর্থ তারা অতিরিক্ত ইতিবাচক।

গবেষকরা আরও দেখেছেন যে, শীতকালে জন্মগ্রহণকারীরা অন্যান্য ঋতুতে জন্মগ্রহণকারীদের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম খিটখিটে মেজাজের হয়।

অন্যান্য গবেষণাগুলোতেও দেখা গিয়েছে যে, আপনার জন্ম মাস আপনার সখ বা ক্যারিয়ার বেছে নেয়াকে প্রভাবিত করতে পারে।

২০১৬ সালে, ন্যাশনাল ফুটবল মিউজিয়াম একটি সমীক্ষা প্রকাশ করে, সেখানে ‘হল অফ ফেমার্স’ অর্থাৎ খেলায় শীর্ষস্থানীয় পারফর্মারদের জন্মদিনের মাস ও বছরগুলো নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয়।

সেখানে দেখা যায় যে এই সফল খেলোয়াড়দের বেশিরভাগই সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং এই ধরনের খেলোয়াড়ের সংখ্যা জানুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে জন্মগ্রহণকারীদের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ ছিল।

কিন্তু আপনি যদি ফুটবলে ক্যারিয়ার গড়ার স্বপ্ন দেখে থাকেন এবং সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে জন্ম না নেন, তাহলে আতঙ্কিত হবেন না!

ফুটবলের মুকুটহীন রাজা ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর মতো ফুটবল কিংবদন্তিদের জন্ম ফেব্রুয়ারিতে এবং লিওনেল মেসির জুনে। এমন অগণিত উদাহরণের মধ্যে তারা কেবল দুটি নাম।

যদি ফুটবল আপনার জন্য না হয়, হয়তো আপনি দাবাতে আগ্রহী হবেন।

ব্রুনেল ইউনিভার্সিটিতে ২০০৮ সালের একটি গবেষণায়, বিজ্ঞানীরা জন্মের মাস এবং ঋতুর সাথে অভিজ্ঞ দাবা খেলোয়াড়দের সংখ্যার মধ্যে একটি সম্পর্ক থাকার কথা উল্লেখ করেন।

সেখানে দেয়া তথ্য থেকে জানা যায় যে, এই খেলোয়াড়দের একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শীতের শেষের দিকে এবং বসন্তের শুরুতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। চেকমেট !

আর হ্যাঁ! ওই গবেষণা প্রতিবেদন শেষ পর্যন্ত এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে সাধারণ মানুষদের তুলনায় দাবা খেলোয়াড়দের মধ্যে বামহাতি বেশি দেখা যায়।

সূত্র: বিবিসি বাংলা

এসবি/