মুখ খুলছে চা গাছ, বাগানে বইছে আনন্দের হিল্লোল
বিকুল চক্রবর্তী, মৌলভীবাজার থেকে
প্রকাশিত : ০৩:৫৪ পিএম, ২০ মার্চ ২০২৫ বৃহস্পতিবার

তিনমাস বন্ধ থাকার পর মৌলভীবাজারের বিভিন্ন চা বাগানে গাছে গাছে আসছে নতুন কুঁড়ি। শুরু হয়েছে চা পাতা চয়ন (উত্তোলন)। বাগানে বাগানে বইছে আনন্দের হিল্লোল। ২০২৫ সালে চায়ের লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১০৩ মিলিয়ন কেজি। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি উৎপাদন হবে বলে জানান চা বিজ্ঞানীরা।
প্রকৃতি নির্ভর একটি কৃষিজ পণ্য চা। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে চায়ের উৎপাদনও ভালো হয়। এর জন্য প্রয়োজন পরিমিত বৃষ্টি ও সূর্য কিরণ। মার্চের শুরুতে কিছু বৃষ্টি হওয়াতে ছাটাই করা চা গাছে আসতে শুরু করেছে নতুন কুঁড়ি। বেশ কিছু বাগানে শ্রমিকরা শুরু করেছেন পাতা তোলা।
চা বিজ্ঞানীরা জানান, চায়ের উৎপাদন বাড়াতে চা গাছে প্রুনিং (ছাটাই) এর বিকল্প কিছু নেই। এর ফলে চা গাছে প্রচুর পাতা গজায়। চা সংশ্লিষ্টদের কাছে চা গাছের পাতাই হচ্ছে সোনা। এটাকে অনেকে সবুজ সোনাও বলে থাকেন। তাই যত পাতা গজাবে তত সবুজ সোনায় ভরে যাবে দেশ।
২০২৩ সালে ১০৩ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদন হয়। আর ২০২৪ সালে হয় ৯৩ মিলিয়ন কেজি। যা লক্ষমাত্রার চেয়ে ১০% কম ছিল।
দেশে নিবন্ধনকৃত ১৬৮টি চা বাগান রয়েছে। পাশাপাশি পঞ্চগড়ে রয়েছে ক্ষুদ্রায়িত অনেকগুলো চা বাগান। পঞ্চগড় ও দেশের ১৬৮টি চা বাগান মিলিয়ে ২০২৫ এর লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১০৩ মিলিয়ন কেজি।
কমলগঞ্জ শ্রী গোবিন্দপুর চা বাগানের শ্রমিক আশালতা ও রুবিনা জানান, তাদের বাগানে ডিসেম্বরে চা গাছ গ্রুনিং করা হয়। এই সময় থেকে বৃষ্টি ছিলনা। বিকল্প ব্যবস্থায় ইরিগ্রেশন করা হয়েছে। আর মার্চের শুরুতে অল্প কিছু বৃষ্টিপাত পাওয়া গেছে। এর ফলে মার্চ মাসেই চা গাছে পাতা আসতে শুরু করে। এরপর মালিক এসে সবাইকে নিয়ে মিলাদ মাহফিল করার পর তারা এখন পাতা তুলছেন।
ন্যাশনাল টি কোম্পানীর পদ্মছড়া চা বাগানের শ্রমিক লক্ষি চাষা ও পূর্নীমা জানান, দুই মাসের উপরে পাতা তোলা বন্ধ ছিল। এখন গাছের মুখ খুলছে। সপ্তাহ-দশ দিনের মধ্যেই গাছের উপরের অংশে সবুজ ঝাড় বাঁধা শেষ হবে (টিপিং) এরপর তারা পাতা তুলবেন। এখন চলছে টেপিং (ঝুপ বাঁধা) এর কাজ।
একই বাগানের বিজয়া গোয়ালা ও মাধবী চাষা জানান, বাগানের ম্যানেজম্যান্ট ও শ্রমিক সবাই মিলে পূজার্চনার মধ্যদিয়ে তারা পাতা তোলা শুরু করেছেন।
মাধবপুর চা বাগানের সহকারী ব্যবস্থাপক তাপস কুন্ড জানান, চায়ের জন্য বিজ্ঞান সম্মত পদ্ধতির পাশাপাশি প্রকৃতির উপরও নির্ভর করতে হয়। চায়ের জন্য মূলত প্রয়োজন পরিমিত বৃষ্টিপাত ও সূর্যের আলো। অনেক জায়গায় ইরিগেশন পৌঁছানো সম্ভব হয়না। তা ছাড়া বর্ষায় যদি অতি বৃষ্টি হয় তাও চায়ের জন্য ক্ষতিকর। আবার প্রচণ্ড তাপ দাহ হলে তাও ক্ষতিকর। যে কারণে এর জন্য কিছুটা প্রকৃতির উপর তো নির্ভর করতেই হয়।
তিনি বলেন, মৌসুমের একেবারে শুরু থেকেই তারা নতুন কুঁড়ি পেয়েছেন। এই জন্য দোয়া মিলাদ মাহফিল ও পূজার্চনার মধ্যদিয়ে তারা এ মৌসুমের কার্যক্রম শুরু করেছেন।
শ্রীমঙ্গল জেরিন চা বাগানের জিএম সেলিম রেজা জানান, পাতা তোলার শুভ সূচনায় করা হয়েছে দোয়া মিলাদ মাহফিল ও পূজার্চনা। বাগানে পাতা চয়নের কাজ শুরু হওয়ায় ফিরছে প্রাণচাঞ্চলতা।
বাংলাদেশীয় চা সংসদ সিলেট অঞ্চলের ব্রাঞ্চ চেয়ারম্যান গোলাম মো. শিবলী জানান, খরা চায়ের বড় একটি প্রতিবন্ধকতা। খরার সময় বৃষ্টি পাওয়া যায়না। এতে গাছ মরে যায়, দেখা দেয় বিভিন্ন রোগবালাই। এই সময়ে চা সংশ্লিষ্টদের খুব সর্তক থাকতে হয়। একটি চা গাছ বাঁচিয়ে রাখার জন্য সবাইকে প্রানান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যেতে হয়। কারণ এক একটি চা গাছ এক একজন চা শ্রমিক, ম্যানেজার ও স্টাফদের জীবন।
শ্রীগোবিন্দপুর চা বাগানের মালিক ও ন্যাশনাল টি কোম্পানীর পরিচালক মো. মহসীন মিয়া মধু জানান, তিনি তাঁর বাগানের চা গাছগুলোকে সন্তানের মতো পালন করেন। এর জন্য তার বাগানে হেক্টর প্রতি উৎপাদন আশাব্যাঞ্জক। মার্চের শুরুতেই তার বাগানে উৎপাদন শুরু হয়েছে বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. ইসমাইল হোসেন জানান, চা বোর্ড চেয়ারম্যানের নির্দেশে চা গবেষণা কেন্দ্রের সকল কর্মকর্তা এখন মাঠে কাজ করছেন। এখন চা গাছ মুখ খুলতে শুরু করেছে। কাঙ্খিত লক্ষমাত্রা অর্জনে বছর জুড়েই তারা মাঠে থাকবেন।
বাংলাদেশ চা বোর্ডের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল শেখ মো. সরওয়ার হোসেন জানান, পানির পর বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় পানীয় হচ্ছে চা। এটি এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসলে রুপ নিয়েছে। সংগত কারণেই এই ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি ও গুণগতমান রক্ষা করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। ৎ
তিনি বলেন, উৎপাদন মৌসুম শুরু হয়েছে। এর জন্য চা বোর্ড থেকে বছর জুড়ে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। বাগানগুলোতে টেকনিক্যাল সাপোর্ট, সঠিক সময়ে যেন বাগানে সার পৌঁছায় তা লক্ষ্য রাখা, বাগানে বাগানে হাতে কলমে আধুনিক বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া, চা বিজ্ঞানী ও উন্নয়ন ইউনিটের কর্মকর্তাদেরকে বাগানগুলোর দিকে নিবির পর্যবেক্ষণে রাখাসহ বছর জুড়ে অনেকগুলো পরিকল্পনা রয়েছে।
এএইচ