ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের ‘ভুয়া খবরে’ সয়লাব পাক-ভারত উত্তেজনা
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৯:৩৪ পিএম, ১৮ মে ২০২৫ রবিবার

সাম্প্রতিক ভারত-পাকিস্তান সামরিক উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে একের পর এক নাটকীয় ‘সাফল্যের’ দাবি উঠে এসেছে। কখনো বলা হয়েছে, পাকিস্তানের পারমাণবিক ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, কখনো বা পাকিস্তানের যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করা হয়েছে কিংবা দেশটির জ্বালানি ও বাণিজ্যের প্রধান প্রবেশদ্বার হিসেবে পরিচিত করাচি বন্দরে হামলা চালিয়ে তা ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। এসব খবর দৃশ্যত নির্দিষ্ট তথ্য, মানচিত্র এবং ভিডিওসহ পরিবেশিত হলেও পরে প্রমাণিত হয়েছে তাদের কোনোটিরই ভিত্তি নেই।
সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া বিভ্রান্তিকর বার্তা, এআই প্রযুক্তিতে তৈরি ছবি ও ভিডিও এবং যাচাইবিহীন খবর একসঙ্গে মিলে ভারত ও পাকিস্তান—উভয় দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি ও উত্তেজনার পরিবেশ তৈরি করে। বিষয়টি আরও উদ্বেগজনক হয়ে ওঠে যখন দেখা যায়, এসব ভুয়া তথ্য শুধু সামাজিক মাধ্যমেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং প্রবেশ করেছে মূলধারার সংবাদমাধ্যমেও। অনেক সময় স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতার জন্য পরিচিত গণমাধ্যমগুলোও যাচাই না করেই খবর সম্প্রচার করেছে। চারদিনের এই সংঘাতে অনেক সংবাদমাধ্যম ‘কার আগে কে প্রচার করবে’ প্রতিযোগিতায় নাম লেখায়। টিভি উপস্থাপক ও বিশ্লেষকরা নিরপেক্ষতা বজায় না রেখে কার্যত যুদ্ধের পক্ষেই অবস্থান নিতে শুরু করেন। একাধিক জনপ্রিয় টিভি চ্যানেল যাচাই না করে ভুয়া ও সাজানো প্রতিবেদন সম্প্রচার করে, যার মধ্যে ছিল পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার মানচিত্র এবং করাচি বন্দরে আক্রমণের ভুয়া ভিডিও।
এ বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন গণমাধ্যম বিশ্লেষক ও গবেষকেরা। আমেরিকান ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক সুমিত্রা বাদ্রীনাথন বলেন, যেসব সংবাদমাধ্যম একসময় বিশ্বাসযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হতো, তারাই এবার মনগড়া খবর প্রচার করেছে, যা অত্যন্ত ভয়ানক একটি ইঙ্গিত।
ক্যার্নেগি মেলন বিশ্ববিদ্যালয়ের ড্যানিয়েল সিলভারম্যান জানান, উদ্দেশ্যমূলক মিথ্যা বা ‘ডিসইনফরমেশন’ সাধারণত মানুষের আবেগকে উসকে দিয়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার মতোভাবে তৈরি করা হয় এবং ভারত-পাকিস্তানের দীর্ঘ শত্রুতার ইতিহাসে এই প্রবণতা আরও তীব্র।
বিশেষ করে ভারতীয় জাতীয় পর্যায়ের প্রভাবশালী চ্যানেলগুলোর ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ফ্যাক্টচেকিং সংস্থা অল্ট নিউজ ‘আজতক’ এবং ‘নিউজ১৮’-এর ভুয়া প্রতিবেদনের প্রমাণ উপস্থাপন করেছে।
অল্ট নিউজের সহ-প্রতিষ্ঠাতা প্রতীক সিনহা জানান, তথ্য পরিবেশ পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। তারা ভুয়া তথ্যের বিরুদ্ধে কাজ করলেও এর খেসারত দিতে হচ্ছে—তাদের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা হয়েছে এবং সাংবাদিকরাও হয়রানির মুখোমুখি হচ্ছেন।
২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির ক্ষমতায় আসার পর ভারতের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সংকুচিত হয়েছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। এখন অনেক সংবাদমাধ্যমই সরকারের পক্ষে প্রচারে সক্রিয়, সরকারবিরোধী খবর প্রকাশ থেকে বিরত থাকে। কিছু স্বাধীন অনলাইন মিডিয়া সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিকতার চেষ্টা করলেও, তাদের প্রভাব সীমিত।
‘ইন্ডিয়া টুডে’-এর উপস্থাপক রাজদীপ সরদেসাই একটি ভুয়া খবর প্রচারের জন্য সম্প্রচারে দুঃখ প্রকাশ করেন এবং পরে নিজের ইউটিউব চ্যানেলে বলেন, এসব ভুয়া খবর ডানপন্থী প্রচারণার অংশ এবং অনেক সময় সংবাদমাধ্যমগুলোও তাতে জড়িয়ে পড়ে।
এদিকে সামাজিক মাধ্যমেও মিথ্যা তথ্যের সয়লাব দেখা গেছে। করাচি বন্দরে হামলার দৃশ্য বলে যেসব ধোঁয়ার ছবি ভাইরাল হয়েছিল, তা পরে গাজার পুরোনো ছবি বলে চিহ্নিত হয়। ভারতীয় নৌবাহিনী পরবর্তীতে জানায়, তারা হামলার প্রস্তুতি নিলেও বাস্তবে কোনো হামলা চালানো হয়নি।
এই প্রেক্ষাপটে পরিষ্কার হয়ে ওঠে যে, যুদ্ধ বা সামরিক উত্তেজনার সময় ভুয়া তথ্য ছড়ানো এখন শুধু একটি প্রচারণা কৌশল নয়, বরং গণমাধ্যমের ভেতরে থেকেই সেটি সংগঠিত হচ্ছে। এর ফলে সংবাদপাঠকদের মধ্যে সত্য-মিথ্যার বিভাজন কঠিন হয়ে পড়ে এবং সংবাদমাধ্যমের ওপর আস্থা চূড়ান্তভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই সংকট শুধু ভারত বা পাকিস্তানের জন্য নয়, বরং গোটা দক্ষিণ এশিয়ার তথ্য নিরাপত্তা ও সাংবাদিকতার জন্য একটি বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এসএস//