প্রবাসে একখণ্ড বাংলাদেশ: প্রযুক্তির সংযোগ ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০২:০০ পিএম, ২১ মে ২০২৫ বুধবার

বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা প্রায় এক কোটিরও বেশি প্রবাসী বাংলাদেশি শুধু দেশের বাইরে বসবাস করেন না, তাঁরা প্রতিনিয়ত হৃদয়ে গড়ে তোলেন একখণ্ড বাংলাদেশ। হাজার হাজার মাইল দূরে থেকেও তাঁরা শেকড়ের টান ভুলে যান না। তাদের জীবনযাপন, সংস্কৃতি, আচার-আচরণে প্রতিফলিত হয় বাংলাদেশের পরিচয়।
চার দশক আগের প্রবাসজীবন ছিল নিঃসঙ্গ, ধৈর্যের, অপেক্ষার। ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন, ভিডিও কল—কোনো কিছুই তখন ছিল না। বাংলাদেশে ফোন করতে হলে টেলিফোন এক্সচেঞ্জে কল বুক করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হতো। কথা বলার সুযোগ মিলত কয়েক মিনিটের জন্য, তাও অনেক সময় মায়ের গলার বদলে শোনা যেত যান্ত্রিক শব্দ। সেই একাকীত্বের দিনে আশার আলো ছিল ডাকপিয়নের হাতে আসা হলুদ খামে মোড়া চিঠি। মা, পরিবার, প্রিয়জন—সবকিছুর স্পর্শ পাওয়া যেত সেই হাতে লেখা অক্ষরে।
কিন্তু সময় বদলেছে। আজ প্রযুক্তির কল্যাণে পৃথিবী অনেক ছোট হয়ে এসেছে। ভিডিও কলে মায়ের হাসিমাখা মুখ দেখা যায়, মুহূর্তেই পাওয়া যায় দেশের খবর, বাংলা সংবাদপত্র, নাটক, সিনেমা, এমনকি পটলাক পার্টির আয়োজনও চলে প্রবাসে। বাংলা নববর্ষ থেকে শুরু করে বইমেলা—সব কিছুই এখন বিশ্বের নানা প্রান্তে বাংলাদেশিদের নিজস্ব আয়োজনে উদযাপন হয়।
তবে শুধু আবেগ নয়, অর্থনীতির দিক থেকেও প্রবাসীদের ভূমিকা অপরিসীম। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, প্রবাসীরা প্রতিবছর দেশে প্রায় ২২ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স পাঠান, যা দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের একটি বড় উৎস। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের প্রবাসীরা শ্রম দিয়ে দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখতে বিশাল অবদান রাখছেন।
তবে এই অবদানের তুলনায় প্রবাসীরা অনেক সময় রাষ্ট্রীয়ভাবে অবহেলিত। দেশে পরিবারের হয়রানি, বিদেশে চাকরি হারালে বিকল্প কর্মসংস্থানের অভাব, দূতাবাস থেকে সহযোগিতার ঘাটতি—এসব অভিযোগ দীর্ঘদিনের। অনেকে মনে করেন, রাষ্ট্রের দায়িত্ব আরও বেশি কার্যকরভাবে প্রবাসীদের পাশে দাঁড়ানো।
বাংলাদেশি প্রবাসীরা শুধু আর্থিক অবদান রাখেন না, তাঁরা দেশের সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক চেতনা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে দেন। রবীন্দ্র-নজরুল সংগীত, বাংলা থিয়েটার, সাহিত্যসভা, রাজনৈতিক আলোচনা—সব কিছুই প্রবাসী সমাজের নিয়মিত চর্চার অংশ। এমনকি কখনো কখনো বাংলাদেশের রাজনীতির প্রতিফলন দেখা যায় প্রবাসীদের সভা-সমাবেশ, মিছিল কিংবা রাজনৈতিক নেতাদের অভ্যর্থনায়।
তবে এসব অর্জনের পাশাপাশি প্রবাসীদের মনে রয়েছে অভিমানও। তাঁরা চান তাঁদের সম্মান দেওয়া হোক, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হোক, দূতাবাসগুলো হোক আরও কার্যকর ও সহানুভূতিশীল। তাঁদের মতে, একজন খুশি প্রবাসী দেশের জন্য অনেক বেশি সম্পদ হয়ে উঠতে পারেন।
প্রবাসীরা আর এককথায় "বিদেশি" নন, তাঁরা বাংলাদেশের বৈশ্বিক দূত। তাদের অভিজ্ঞতা, শ্রম, সংস্কৃতি ও ভালোবাসা—সব মিলিয়ে তাঁরাই সেই সেতুবন্ধন, যা দেশের সঙ্গে বিশ্বকে যুক্ত করে রাখে।
এখন সময় এসেছে প্রবাসীদের শুধু রেমিটেন্স প্রেরণকারী হিসেবে না দেখে, তাঁদের রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের সমান অংশীদার হিসেবে মর্যাদা দেওয়ার। তাহলেই গড়ে উঠবে এক সত্যিকারের বৈশ্বিক বাংলাদেশ—সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও মানবসম্পদের অপার সম্ভাবনায় ভরপুর।
এএইচ