কক্সবাজার সৈকতে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে মার্কিন সেনাবাহিনী, যা জানা গেল
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০২:২৮ পিএম, ২৪ মে ২০২৫ শনিবার

সম্প্রতি কক্সবাজারে যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রশিক্ষণ দলের সঙ্গে বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সদস্যদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের কিছু ছবি সামাজিক মাধ্যমে নানানভাবে প্রচার করা হয়েছে। একটি পোস্টে কয়েকটি ছবি সংযুক্ত করে বলা হয়েছে: “দেশে কি হচ্ছে একটু ভেবে দেখছেন? আমেরিকান সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনী কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে না, এরা অলরেডি কক্সবাজার দখল নিয়ে নিয়েছে। দেশের সার্বভৌমত্ব কতটা অনিরাপদ, ভেবে দেখুন।”
রাখাইন করিডোর ইস্যু ঘিরে জনমনে চলমান উদ্বেগ ও আলোচনা কেন্দ্র করে এসব ছবি ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরনের বিভ্রান্তিকর প্রচারণা ও প্রোপাগাণ্ডা ছড়ানো হচ্ছে।
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, কক্সবাজারে মার্কিন বাহিনীর উপস্থিতির ছবিগুলো যেভাবে প্রাসঙ্গিক তথ্য ছাড়া ভীতিকরভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, তা বিভ্রান্তিকর। বাস্তবতা হলো—এই ছবিগুলো যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের সহযোগিতায় আয়োজিত একটি প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের, যেখানে বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সদস্যরা অংশগ্রহণ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যদের বাংলাদেশে এসে এ ধরনের প্রশিক্ষণ প্রদান নতুন কোনো বিষয় নয়; বরং গত কয়েক বছর ধরেই যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের উদ্যোগে নিয়মিতভাবে এ ধরনের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে।
কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে আমেরিকান সেনা ও বিমানবাহিনী। ১৮ মে এই প্রশিক্ষণ শুরু হয়ে শেষ হয় গত ২১ মে। এ ব্যাপারে কক্সবাজার ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপ–সহকারী পরিচালক মো. তানহারুল ইসলাম বলেছেন, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড় কবলিত ভিকটিমদের উদ্ধারে ফায়ার সার্ভিসের ৪ দিনব্যাপী প্রশিক্ষণ কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে। এই প্রশিক্ষণে অংশ নেয় কক্সবাজারের ১৫ জন কর্মকর্তা ও অগ্নিনির্বাপনকারী কর্মী। গত বুধবার সকালে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের প্যারাসেলিং পয়েন্টে এই প্রশিক্ষণ কার্যক্রম সম্পন্ন হয়।
তানহারুল ইসলাম বলেন, আমেরিকান দূতাবাসের সহযোগিতায় আমেরিকান সেনাবাহিনী ও বিমান বাহিনী বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা কর্মচারীদের এই প্রশিক্ষণ দেয়। সর্বশেষে গত ২১ মে প্রশিক্ষণ প্রাপ্তদের মাঝে সনদ বিতরণ করে প্রশিক্ষকরা। এতে বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের কবলে আটকে থাকা ব্যক্তিদের উদ্ধার, পানিতে ভেসে যাওয়া থেকে উদ্ধারসহ নানান বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা। সরকারের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে এই প্রশিক্ষণ দেয়া হয় বলে জানান তানহারুল ইসলাম। প্রশিক্ষণ শেষে আমেরিকান সেনা ও বিমানবাহিনীর সদস্যরা গতকাল নিজ দেশে ফিরে গেছেন।
বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস এবং সিভিল ডিফেন্সের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ থেকে গত ২১ মে উক্ত প্রশিক্ষণ নিয়ে লেখা হয়- “কক্সবাজারে Swift Water Rescue Training কোর্স সম্পন্ন করেছেন ফায়ার সার্ভিসের ১৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী। কোর্সটি ১৮ মে শুরু হয়ে ২১ মে ২০২৫ শেষ হয়। এ প্রশিক্ষণে জলোচ্ছ্বাস, ফ্লাস ফ্লাড বা বন্যায় ভেসে যাওয়া মানুষকে উদ্ধারের কৌশল শেখানো হয়। ইউএস অ্যাম্বাসি কর্তৃক কোর্সটির আয়োজন করা হয়। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের হিমছড়ি ও দড়িয়ানগর বিচসহ বিভিন্ন সুইমিং পুলে কোর্সের বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়।
উল্লেখ করা যেতে পারে, ২০২১ সাল থেকে ইউএস আর্মির পক্ষ হতে বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিসের প্রায় ২৮০ জন সদস্যকে ‘মেডিক্যাল ফার্স্ট রেসপন্ডার কোর্স’; ‘হাই অ্যাঙ্গেল রেসকিউ কোর্স’সহ বিভিন্ন কোর্স করানো হয়েছে।”
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মার্কিন দূতাবাসের আয়োজনে মার্কিন বাহিনীর দ্বারা এ ধরনের প্রশিক্ষণ পূর্বেও পরিচালিত হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের ওয়েবসাইটে ২০২১ সালে রাজশাহীতে অনুষ্ঠিত একটি প্রশিক্ষণ কর্মশালার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়— “২০১৪ সালে বাংলাদেশে এমএফআরএস কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত ৬২০ জনেরও বেশি বাংলাদেশি মেডিকেল ফার্স্ট রেসপন্ডার প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। দেশে জরুরি পরিস্থিতিতে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স (এফএসসিডি) প্রতিষ্ঠানটি প্রধান সাড়াদানকারী সংস্থা হিসেবে কাজ করে। মেডিকেল ফার্স্ট রেসপন্ডার প্রশিক্ষণ ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহের মাধ্যমে এই প্রতিষ্ঠান ও এর কর্মীদের দক্ষতা ও প্রস্তুতি বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রশিক্ষণের ফলে দুর্ঘটনা ও দুর্যোগে প্রাণহানি হ্রাস, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা এবং গুরুতর জখম যেমন রক্তক্ষরণ, শ্বাসকষ্ট ও হাইপোথারমিয়ার মতো জটিলতা মোকাবেলায় তাৎক্ষণিক সাড়া দেওয়ার সক্ষমতা তৈরি হয়েছে।”
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স এবং বাংলাদেশ কোস্টগার্ডকে পূর্বেও যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে এ ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ— ২০১৯ সালে চট্টগ্রাম, সিলেটসহ বিভিন্ন শহরে ফায়ার সার্ভিসের জন্য মার্কিন দূতাবাস ফার্স্ট রেসপন্ডার মেডিকেল প্রশিক্ষণ কর্মশালা ও সেমিনারের আয়োজন করে। ২০২০ সালে বরিশালে, ২০২১ সালে রাজশাহীতে, ২০২২ সালে চট্টগ্রামে একই ধরনের প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত হয়। ২০২৩ সালে রাজশাহীতে পুলিশ এবং ফায়ার সার্ভিসকে। ২০২৪ সালের মার্চ মাসে যুক্তরাষ্ট্রের এসওএফ সিভিল-মিলিটারি সাপোর্ট দল বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সাথে, মে মাসে বাংলাদেশ কোস্টগার্ড এবং ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স এর সাথে প্রশিক্ষণ কর্মশালার আয়োজন করে।
ফলে এটি নিশ্চিত হওয়া যায় যে, মার্কিন বাহিনীর বাংলাদেশে এসে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সদস্যদের প্রশিক্ষণ প্রদান নতুন কোনো ঘটনা নয়। যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের সহযোগিতায় গত কয়েক বছর ধরেই দেশের বিভিন্ন শহরে এ ধরনের প্রশিক্ষণ কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। কক্সবাজারে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ প্রশিক্ষণটিও সেই ধারাবাহিক সহযোগিতার অংশ হিসেবেই প্রতীয়মান হয়। এসব প্রশিক্ষণের মূল উদ্দেশ্য হলো দুর্যোগ ও জরুরি পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের সাড়াদানকারী সংস্থাগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি ও প্রাণহানি হ্রাস করা।
সুতরাং, কক্সবাজারে ফায়ার সার্ভিস সদস্যদের মার্কিন বাহিনীর প্রশিক্ষণের ঘটনাকে ঘিরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেভাবে ছবি-ভিডিওগুলোর সাথে নানা তথ্য ছড়ানো হচ্ছে, তা বিভ্রান্তিকর।
এএইচ