ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ৩১ জুলাই ২০২৫,   শ্রাবণ ১৫ ১৪৩২

হজের বিষয়ে নতুন নির্দেশ দিল সৌদি সরকার

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১০:০৯ পিএম, ২৯ জুলাই ২০২৫ মঙ্গলবার

আগামী ২০২৬ সালের হজের কার্যক্রম সৌদি সরকারের রোডম্যাপ অনুযায়ী আগেই সম্পন্ন করতে হবে। বাংলাদেশসহ অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর জন্য কঠোর সময়সূচি নির্ধারণ করেছে সৌদি কর্তৃপক্ষ। এতে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নিবন্ধন, অর্থ স্থানান্তর ও সেবা চুক্তি সম্পন্ন না হলে হজে অংশ নেওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।

ইতোমধ্যে সৌদি সরকারের ‘নুসুক মাসার’ প্ল্যাটফর্মে বাংলাদেশকে ১ লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জনের কোটা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, যদিও গত দুই বছর এই কোটা পূরণ হয়নি। হজ অনুষ্ঠিত হবে ২০২৬ সালের মে মাসের শেষ সপ্তাহে, চাঁদ দেখা সাপেক্ষে। তবে এবার ১২ অক্টোবরের মধ্যে হজ নিবন্ধন সম্পন্ন করে পূর্ণ অর্থ জমা দিতে হবে। এরপর ২১ ডিসেম্বরের মধ্যে সৌদি প্রান্তে সেবা প্যাকেজের অর্থ পাঠাতে হবে।

২০২৬ সালের ৪ জানুয়ারি সার্ভিস কোম্পানির সঙ্গে চূড়ান্ত চুক্তি ও ২০ জানুয়ারি হজযাত্রীদের আবাসন ও পরিবহনের অর্থ স্থানান্তর শুরু করতে হবে। বাংলাদেশ-সৌদি দ্বিপাক্ষিক হজচুক্তি সই হবে ৯ নভেম্বর। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এত আগেভাগে জটিল প্রস্তুতি সম্পন্ন করা দেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হবে।

চলতি বছরের হজযাত্রীদের প্রাথমিক নিবন্ধন শুরু হয় গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর। আগামী বছরের হজের প্রাথমিক নিবন্ধন গত রবিবার থেকে শুরু হয়েছে। চলতি বছর হজ হয়েছিল ৫ জুন। গত বছরের ৩০ অক্টোবর হজ প্যাকেজ ঘোষণা করেছিল সরকার।

আগামী হজকে সামনে রেখে এখন প্যাকেজ ঘোষণা করা হচ্ছে সরকারের বড় কাজ। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তারা এখন সৌদি প্রান্তের খরচ ও দেশে হজযাত্রীদের বিমান ভাড়া নির্ধারণের অপেক্ষা করছেন। আগস্টের মধ্যে হজ প্যাকেজ ঘোষণার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে এগোচ্ছেন তারা।

এবার সরকারি ব্যবস্থাপনায় প্যাকেজ-১ মাধ্যমে খরচ হয়েছে ৪ লাখ ৭৮ হাজার ২৪২ টাকা। আর প্যাকেজ-২-এ হজ পালনে খরচ হয় ৫ লাখ ৭৫ হাজার ৬৮০ টাকা। আর বেসরকারিভাবে হজ পালনে সর্বনিম্ন খরচ নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছিল ৪ লাখ ৮৩ হাজার ১৫৬ টাকা। এর ভিত্তিতে প্যাকেজ নির্ধারণ করেছে হজ এজেন্সিগুলো।

ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকে আরও জানা গেছে, সরকারি ব্যবস্থাপনায় আগামী হজেও দুটি হজ প্যাকেজ ঘোষণা নিয়ে কাজ হচ্ছে। সাধারণ প্যাকেজ হিসেবে প্যাকেজ-১-এর খরচ কমানোর চেষ্টা করা হয়েছে। চলতি বছর হজযাত্রীদের বিমান ভাড়া ছিল এক লাখ ৬৭ হাজার ৮২০ টাকা। আগামী বছর তা দেড় লাখের নিচে নামিয়ে আনতে চায় মন্ত্রণালয়।

এ প্যাকেজের ভিত্তিতেই এজেন্সিগুলো তাদের প্যাকেজ নির্ধারণ করবে। অন্যদিকে সরকারি প্যাকেজ-২ হবে বিশেষ প্যাকেজ। এ প্যাকেজে হজযাত্রীদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হবে। খরচও হবে বেশি। এ প্যাকেজের খরচ হবে ৭ থেকে সাড়ে ৭ লাখ টাকা। এ প্যাকেজের বাড়ি বা হোটেল থাকবে হারাম শরীফের ৫০০ থেকে ৭০০ মিটারের মধ্যে।

চার লাখ টাকা দিয়ে রবিবার থেকে প্রাথমিক নিবন্ধন করা যাচ্ছে। তবে হজ এজেন্সি মালিকরা এর বিরোধিতা করছেন। তারা বলছেন, প্রাথমিক নিবন্ধনে ৪ লাখ টাকা বেশি হয়ে যাচ্ছে। এতে সাড়া কম পাওয়া যাবে। কারণ, হজের এত আগে একসঙ্গে এত টাকা দেওয়ার অনেকের জন্য কষ্টকর হয়ে যাবে। এ ছাড়া প্যাকেজ ঘোষণা না হওয়ায় হজে গমনেচ্ছুরা জানতে পারাছেন না যে এবার হজ পালন তার সাধ্যের মধ্যে থাকছে নাকি থাকছে না।

এ বিষয়ে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব এ কে এম আফতাব হোসেন প্রামানিক বলেন, ‘সৌদি সরকার হজ নিয়ে রোডম্যাপ দিয়েছে। কারণ হজ হচ্ছে একটি দ্বি-রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার বিষয়। এবার হজ নিয়ে একটু আগেই কাজ শুরু করতে হবে। এটা নিয়ে আমরা হাবের সঙ্গে বসেছি। হজ প্যাকেজ ঘোষণাসহ যে সব কাজ রয়েছে, সেগুলো পর্যায়ক্রমে করতে হবে।’

সচিব বলেন, ‘সৌদি প্রান্তের খরচের হিসাব না পাওয়া ও বিমান ভাড়া নির্ধারিত না হওয়ায় আমরা প্যাকেজটা করতে পারছি না। সৌদি প্রান্তে সেবাদানকারী সংস্থাগুলোর কাছে চুক্তি, মিনা-আরাফায় তাবু ভাড়া, বাড়ি ভাড়া আগে আগেই করতে হবে।’

হজ প‍্যাকেজ কবে নাগাদ হতে পারে জানতে চাইলে সচিব বলেন, ‘হজ প্যাকেজ আগস্টের মধ্যেই করতে হবে। আমরা সেই লক্ষ্যে কাজ করছি। তবে সৌদি প্রান্তের খরচের হিসাব পাওয়ার পর প্যাকেজ ঘোষণা করা হবে।’

তিনি বলেন, ‘সৌদি প্রান্তের খরচের হিসাব পাওয়ার বিষয়ে সৌদি আরবে আমাদের হজ মিশন তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। আমাদের এদিকেও কিছু কাজ রয়েছে। বিমান ভাড়া নির্ধারণের বিষয়টি রয়েছে। বিমান ভাড়া নিয়ে আমরা আলোচনা করছি। খরচগুলো পেলে আমরা যত দ্রুত পারি নির্বাহী কমিটি সভায় বসে প্যাকেজ ঘোষণা করে দেব।’

আরেক প্রশ্নে সচিব বলেন, ‘আমরা চাই হজের খরচ কমুক। যাতে বেশি সংখ্যক মানুষ হজে যাওয়ার সুযোগ পায়। ওই প্রান্তের ও আমাদের প্রান্তের খরচ যদি কমাতে পারি, তাহলে খরচ কমবে। অনেকে একটা বিশেষ প্যাকেজ নেওয়ার কথা বলেছে। তারা বলেছেন, আরও কাছাকাছি থাকতে চান। ৫০০ থেকে ৭০০ মিটারের মধ্যে করা যায় কি না, আমরা চিন্তা-ভাবনা করছি। আমরা এটা নিয়ে উপদেষ্টার সঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নেব। কিছু কিছু মানুষ আছে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ হারাম শরীফে পড়তে চান, এজন্য তারা বেশি খরচ করতেও রাজি।’

ইতোমধ্যে সৌদি সরকার আমাদের কোটা নির্ধারণ করে দিয়েছে জানিয়ে সচিব বলেন, ‘আগামী বছরের হজে বাংলাদেশের কোটা এক লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জন। নুসুক মাসার প্লাটফর্মে সৌদি সরকার কোটা জানিয়ে দিয়েছে। গত কয়েক বছর ধরে আমাদের কোটা এটাই ছিল।’

ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের হজ অনুবিভাগের যুগ্ম সচিব মো. মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, ‘আগামী হজ নিয়ে আমরা কাজ শুরু করেছি। তবে এবার সৌদি সরকারের যে টাইমলাইন, সেটা আমাদের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ। কারন গত বছর থেকে এবার সময় এগিয়ে এসেছে।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের হজযাত্রীদের তো মাথায় থাকে যে হজের দু-তিন মাস আগে সব করবেন। কিন্তু সৌদি সরকার এবার ছয় মাস আগেই সব কাজ শেষ করতে চাইছে। এটা আমাদের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ।’

তিনি আরও বলেন, ‘এবার হাজিরা বলছেন, আরও কাছে থাকতে চাইছেন। বেশি সুযোগ-সুবিধা চান তারা। তাই প্যাকেজ-২ বিশেষ প্যাকেজ হিসেবে রাখার চিন্তা-ভাবনা হচ্ছে। প্যাকেজ-১ এ তিন কিলোমিটারের মধ্যে হোটেলের ব্যবস্থা করার কথা ছিল। কিন্তু আমরা হাজিদের দেড় থেকে দুই মিলোমিটারের মধ্যে রাখতে পেরেছি। আমাদের উদ্দেশ্য হাজিকে দূরে রাখা যাবে না। এবারও এটা আমাদের মূল উদ্দেশ্য থাকবে। আমরা হাজিদের সেবাটা নিশ্চিত করতে চাই।’

হজ এজেন্সিস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশে (হাব) এর মহাসচিব ফরিদ আহমেদ মজুমদার বলেন, ‘সৌদি সরকারের রোডম্যাপ অনুযায়ী এবার হজ প‍্যাকেজ আগে বাদে ঘোষণা করতে হবে। সৌদি রোডম্যাপের পরিপ্রেক্ষিতে এবার কিছুটা তো চ্যালেঞ্জ রয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘নিবন্ধনের সময় যে চার লাখ টাকা দেওয়ার নিয়ম করা হয়েছে, এটা একটু বেশি। মানুষের তো প্রাথমিকভাবে এত টাকার প্রস্তুতি থাকে না। আমাদের দাবি ছিল, এই টাকাটা দুইভাগে নেওয়ার জন্য। প্রাথমিক টাকা যাতে ২ থেকে আড়াই লাখ টাকার মধ্যে থাকে। এটা হজযাত্রীদের দাবি, আমাদেরও দাবি।’

মহাসচিব বলেন, এবার কোরবানি ও খাবার সৌদি কর্তৃপক্ষ তাদের ব্যবস্থাপনায় নিয়ে নিচ্ছে। এটা সম্ভব নয়। কারণ আমাদের দেশের হাজিরা কেউ ৫০০ রিয়াল দিয়ে কোরবানি দেয়, কেউ পনের শ’ রিয়াল দিয়েও দেয়। কোরবানিটা তো যার যার সামর্থ্যের বিষয়। একই ফরমেটে রাখলে তো সমস্যা দেখা দেবে। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা দরকার।’

তিনি বলেন, ‘সৌদি সরকার খাবার দিলে হাজীদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হবে, কারণ তাদের খাবারটা মানে ভালো নয়। তারা যদি এক মাস ধরে খাবারের দায়িত্ব নেয়, তাহলে হাজিদের অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। প্রতি হজে মিনা ও আরাফায় সৌদি কর্তৃপক্ষ ৩/৪ দিনের খাবার দিত, এটা নিয়েই হজযাত্রীদের অভিযোগের শেষ নেই।’

তিনি বলেন, ‘এই বিষয়টা মন্ত্রণালয়ও জানে। আশা করি আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সরকার এ বিষয়গুলো সুরাহা করবে।’

জমা দিতে হবে ৪ লাখ টাকা

২০২৬ সালের হজে অংশ নিতে আগ্রহীদের জন্য প্রাথমিক নিবন্ধন শুরু হয়েছে। রোববার (২৭ জুলাই) থেকে শুরু হওয়া এ প্রক্রিয়ায় চার লাখ টাকা জমা দিয়ে হজে যেতে ইচ্ছুকরা প্রাথমিক নিবন্ধন সম্পন্ন করতে পারবেন।

ধর্ম মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সৌদি সরকারের নির্ধারিত রোডম্যাপ অনুযায়ী, এ বছরের ১২ অক্টোবরের মধ্যে হজের চূড়ান্ত নিবন্ধন সম্পন্ন করতে হবে। তাই নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই প্রাথমিক নিবন্ধনের পাশাপাশি হজ প্যাকেজের বাকি অর্থ জমা দিয়ে সম্পন্ন করতে হবে চূড়ান্ত নিবন্ধন।

সরকারি ব্যবস্থাপনায় হজে যেতে আগ্রহীরা ই-হজ সিস্টেমের ওয়েবসাইট (www.hajj.gov.bd), ‘লাব্বাইক’ মোবাইল অ্যাপ, ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বিভাগীয় ও জেলা কার্যালয়, বায়তুল মোকাররম অফিস এবং আশকোনা হজ অফিস থেকে প্রাথমিক ও চূড়ান্ত নিবন্ধন করতে পারবেন।

অন্যদিকে, বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় হজ পালনে আগ্রহীদের জন্য অনুমোদিত হজ এজেন্সির মাধ্যমেই নিবন্ধন সম্পন্ন করতে হবে।

ধর্ম মন্ত্রণালয় বলছে, নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে নিবন্ধন কার্যক্রম সম্পন্ন না হলে হজযাত্রা অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে। তাই সময়মতো প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে হজে আগ্রহীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে মন্ত্রণালয়।

এসএস//