‘যে যেভাবে পারে দেশ ছাড়তে চায়’
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০২:২৮ পিএম, ৩০ জুলাই ২০২৫ বুধবার

২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসেই প্রায় ১০ হাজার বাংলাদেশি লিবিয়া হয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে পৌঁছাতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন। দেশত্যাগের এই পরিস্থিতির পেছনে কেবল দারিদ্র্য নয়, রয়েছে সুশাসনের অভাব, নিরাপত্তাহীনতা ও সর্বপরি ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা বলে মনে করেন সাংবাদিক শরীফুল হাসান।
এ বিষয়টি তুলে ধরে আজ বুধবার (৩০ জুলাই) এক ফেসবুক স্ট্যাটাস দিয়েছেন তিনি।
একুশে টেলিভিশনের অনলাইন পাঠকদের জন্য তার পোস্টটি হুবহু তুলে ধরা হলো—
সেই আয়ুব খানের আমল থেকে শুরু হয়েছে উন্নয়নের গালগল্প বলা। যখন যারা সরকারে থাকে তারা বলছে বাংলাদেশ কত উন্নত হয়েছে। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ইতালি প্রবেশের চেষ্টা করছে যে দেশগুলোর মানুষ, বাংলাদেশ গত কয়েক বছর ধরে সেই তালিকায় পৃথিবীর মধ্যে প্রথম। এ বছর সেটি রেকর্ড ছাড়াবে।
এ বছরের প্রথম ছয় মাসে অন্তত নয় হাজার ৭৩৫ জন বাংলাদেশি এভাবে ইতালি প্রবেশ করেছেন।
এভাবে সাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি প্রবেশ করতে গিয়ে অনেকের প্রাণ যায়। আর লিবিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্পে বন্দি করে শারীরিক নির্যাতন তো নিয়মিত ব্যাপার। এরপর তাদেরকে জিম্মি করে পরিবারের কাছ থেকে আদায় করা হয় অর্থ। এত কিছুর পরেও ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে ইউরোপের স্বপ্নে লিবিয়া যাওয়ার এই প্রবণতা থামছে না।
ইউরোপের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সমন্বয়ের দায়িত্বে থাকা ফ্রন্টেক্সের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশিরা লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে সবচেয়ে বেশি ইউরোপে প্রবেশে চেষ্টা করে। এটি সেন্ট্রাল মেডিটেরিয়ান রুট হিসেবে পরিচিত। ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পযর্ন্ত এই পথে অন্তত ৯২ হাজার ৪২৭ জন বাংলাদেশি ইউরোপে প্রবেশ করেছেন।
এভাবে প্রবেশ করতে গিয়ে মাঝে মধ্যেই প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। সর্বশেষ, এ বছরের জানুয়ারিতে লিবিয়ায় অন্তত ২৩ বাংলাদেশির গলিত লাশ উদ্ধার করা হয় যারা লিবিয়া থেকে নৌযানে করে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু পরে ভূমধ্যসাগরে সেটি ডুবে যায়।
এই যে মানুষ যে কোনো মূল্যে দেশ ছাড়তে চাইছে সেটা কী শুধুই অর্থনৈতিক কারণে? নাকি এর সঙ্গে দেশের সুশাসন, মানুষের জীবনের নিরাপত্তা, ভবিষ্যত আরো অনেক কিছু জড়িয়ে আছে? জানি না নীতি নির্ধারকেরা কী উত্তর দেবেন তবে আমি অনেক বছর ধরে বলে আসছি, যে বাংলাদেশে আমার আপনার জন্ম সেই বাংলাদেশ ছাড়াকেই জীবনের স্বার্থকতা মনে করেন এই দেশের মানুষ। ফলে পেশাজীবীরা চলে যেতে চান আমেরিকা, কানাডায়, সদ্য পাস করা তরুণ ছেলে বা মেয়েটি চলে যেতে চায় মাস্টার্স-পিএইচডি করতে আর লেখাপড়া করেননি এমন মানুষেরা যেতে চান সৌদি আরব, দুবাই কিংবা অন্য কোথাও।
আসলে যে যেভাবে পারে দেশ ছাড়তে চায়। একদিকে কর্মসংস্থানের ঘাটতি আরেকদিকে ক্রসফায়ার-গুম, কখনো ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট, কখনো মব এবং সবমিলিয়ে সুশাসনের ঘাটতির কারণে লোকজন মরিয়া হয়ে দেশ ছাড়ে। এই মরিয়া হবার কারণেই অনিয়মিত অভিবাসন বা মানবপাচার বাড়ছে।
ভাবুন তো একবার, এই পৃথিবীর কোনো এক শহরের ছোট্ট এক কক্ষে বন্দি আপনি। যে কোনোভাবে হোক, আপনি পাচারের শিকার। স্বাধীনভাবে চলাফেরার অধিকার তো নেই-ই, উল্টো নিয়মিত নিপীড়ন করা হয়। কখনো সেটা শ্রম শোষণ, কখনো বা যৌন নিপীড়ন বা অন্য কোনোভাবে।
আপনি হয়তো ভালো আছেন কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সর্বশেষ ‘ট্রাফিকিং ইন পারসনস রিপোর্ট’ শীর্ষক প্রতিবেদন বলছে, আজকের পৃথিবীর আড়াই কোটিরও বেশি মানুষকে এই ভয়ানক অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে, যারা মানবপাচারের শিকার।
এই মানবপাচারকে ঘিরে পৃথিবীতে লাখো কোটি টাকার বাণিজ্য চলছে যেটি সংঘবদ্ধ অপরাধ। পাচারকারীরা সংঘবদ্ধ হলেও সেই তুলনায় সরকারগুলো পিছিয়ে, পিছিয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী। বাংলাদেশে কাগজে কলমে দারুণ সব আইন থাকলেও সেগুলোর বাস্তবায়নের ঘাটতি আছে। আর লোকজন যেহেতু মরিয়া এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সমন্বিত তৎপরতা নেই ফলে পাচার বাড়ছেই। যে যেভাবে পারছে বিদেশে যেতে চায়। পাচারকারীরা সেই সুযোগ নিচ্ছে।
এক সময় মানবপাচারের উৎস দেশ হিসেবে পরিচিত থাকলেও এখন ট্রানজিট ও গন্তব্য দুই হিসাবেও ব্যবহৃত হচ্ছে। বাংলাদেশের তিন দিকে ভারত। অন্তত ৩০টি জেলা আছে যার এক পাশে ভারত আরেক পাশে বাংলাদেশ। ফলে খুব সহজেই বাংলাদেশের নারী ও কিশোরীদের সীমান্ত পাড়ি দিয়ে পাচার করে ভারতে নিয়ে যায় পাচারকারীরা। বাংলাদেশের আরেক দিকে মিয়ানমার। সেখান থেকে অন্তত ১৫ লাখ রোহিঙ্গা এখন বাংলাদেশে। এই রোহিঙ্গারাও যে যেভাবে পারছে থাইল্যাণ্ড মালয়েশিয়া বা ভারতে পাচার হচ্ছে। দেশের ভেতরে পাচার তো থেমে নেই। আর অভিবাসনের এমন পরিস্থিতিতেই কাল আজ জুলাই পালিত হবে আন্তর্জাতিক মানব পাচার বিরোধী দিবস। মানবপাচার সমস্যার সমাধানে কোন জাদু নেই। তবে এটা সত্যি, যে দেশে যতো সমস্যা, সুশাসনের যতো ঘাটতি সেখান থেকে মানুষের দেশ ছাড়ার প্রবণতা ততো বেশি।
আমি বিশ্বাস করি বাংলাদেশে যদি সুশাসন থাকতো, মানুষের জীবনের নিরাপত্তা থাকতো, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা থাকতো তাহলে মানুষ এত মরিয়া হয়ে দেশ ছাড়তো না। কাজেই সুশাসন প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি সবার সমন্বিত চেষ্টাই হয়তো মানবপাচার কমাতে পারে। আর সেই চেষ্টায় ঘাটতি থাকলে যত দিন যাবে পরিস্থিতি ততোই খারাপ হবে।”