ঢাকা, সোমবার   ১৮ আগস্ট ২০২৫,   ভাদ্র ৩ ১৪৩২

পোষাক শিল্পে বন্ডেড ওয়্যারহাউস নিরীক্ষা কার্যক্রম সহজীকরণে প্রস্তাবনা

জাহাঙ্গীর হোসেন, এফসিএমএ

প্রকাশিত : ১২:৩৭ পিএম, ১৮ আগস্ট ২০২৫ সোমবার | আপডেট: ১২:৪১ পিএম, ১৮ আগস্ট ২০২৫ সোমবার

বর্তমানে শতভাগ রপ্তানিমুখী পোষাক শিল্পে বন্ড লাইসেন্সে নবায়নের জন্য বন্ডেড ওয়্যারহাউজ ব্যবস্থাপনা ২০২৪ মোতাবেক সরেজমিনে পরিদর্শনভিত্তিক নিরীক্ষা কার্যক্রম অনুসরণ করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় নির্ধাারিত ছকে একটি স্ব-প্রণোদিত পরিদর্শন প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও লিয়েন ব্যাংকের যৌথ স্বাক্ষরে সংশ্লিষ্ট কাস্টমস অফিসে জমা দিতে হয়, যার মাধ্যমে আমদানি, রপ্তানি ও সমাপনী মজুদের তথ্য উপস্থাপন করা হয়।

কাগজ-নির্ভর প্রক্রিয়ায় কাস্টমস কর্তৃপক্ষের জনবলের ঘাটতি থাকায় অফিসিয়াল কার্যক্রম শুরু থেকে সরেজমিনে পরিদর্শন পর্যন্ত ৩-৪ মাস সময় অতিবাহিত হয়ে যায়। এই দীর্ঘসূত্রিতার ফলে তৈরি হয় মজুদের সংকট, যা উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে। যদিও শর্তসাপেক্ষে ডাইস, কেমিক্যাল ও লবণ আমদানির সুযোগ বিদ্যমান, বাস্তবে সত্য যাচাই প্রক্রিয়ার অপব্যবহার ও প্রশাসনিক হয়রানির কারণে ব্যবসায়ীরা নানা ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। 

অন্যদিকে একটি অর্ডারের কাপড় তৈরি শুরু হইতে সমাপ্ত পর্যন্ত কয়েক দিন সময় লেগে যায় এবং অনেক সময় একটি অর্ডার দুই অর্থবছরের মধ্যে পড়ে সেক্ষেত্রে রপ্তানীর আনুপাতিক হারে ইউডি বিবেচনা করা হলেও চলতি কার্যে ব্যবহৃত কাঁচামাল গণনায় আসেনা। যদিও প্রারম্ভিক ও সমাপনী কোন চলতিকার্যে ব্যবহৃত কাঁচামাল কোনটাই গণনায় আসেনা। কিন্তু তা কতটুকু যুক্তিসঙ্গত বোধগম্য নয়। 
অন্যদিকে বিষয়টি জটিল ও কারিগরি জ্ঞানের বিষয়। এছাড়া সরকার দুর্নীতি সিন্ডিকেট রোধকল্পে ভ্যাট এবং কাস্টমসের কর্মকর্তাদের ঘন ঘন বদলির ব্যবস্থা করেন। যার জন্য নতুন ব্যক্তি নতুনভাবে চিন্তা করায় কোম্পানীসমূহের কর্মকর্তাকে কাঠামোগত পদ্ধতি সম্পর্কে ধারণা দিতে অনেক সময় অতিবাহিত হয়। 

এর ফলে কোম্পানীগুলো একাধিকবার ক্ষতির শিকার হচ্ছেনঃ
১. অতিরিক্ত অর্থের অপচয়ঃ হয়রানি এড়াতে অনেক সময় বাধ্য হয়ে অনৈতিক পন্থায় অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হয়।

২. অতিরিক্ত চলতি মূলধনের চাপঃ দীর্ঘসূত্রতার কারণে পূর্ব প্রস্তুতির অংশ হিসেবে অতিরিক্ত মজুদ রাখতে হয়, যার জন্য অতিরিক্ত চলতি মূলধন প্রয়োজন হয়।

৩. ভুল বোঝাবুঝি ও যোগাযোগ বিভ্রাটঃ কাঠামোগত পদ্ধতিতে নতুন লোকের আগমন। মজুদের সঙ্গে চলতি কার্যে ব্যবহৃত কাঁচামাল বিবেচনা না করায় কোম্পানী ও কাস্টমস কর্তৃপক্ষের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝির ঝুঁকি থাকে।

৪. উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি ও ক্ষতির সম্মুখীনঃ কোম্পানীগুলোর দিন দিন উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় তাহার পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি না পাওয়ায় ক্ষতির সম্ভাবনা বেড়ে যাচ্ছে।

উপরোক্ত সমস্যা ছাড়াও কোম্পানীকে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারিগরি তথ্যাদি প্রদান করতে হয়। যাহা দক্ষ ও স্বাধীন কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠান কর্তৃক যাচাইকরা অত্যাবশ্যকীয়। যেমন, উৎপাদন ব্যবস্থাপনায় উৎপাদন ক্ষমতা, ব্যবহৃত কাঁচামালের পরিমাণ এবং অপচয়ের হিসাব। এসব ক্ষেত্রে নির্ভূল তথ্য ও বিশ্লেষণ প্রদান করাই কস্ট একাউন্টিং এর মূল উদ্দেশ্য। 

বাংলাদেশে অন্যতম স্বনামধন্য এবং স্বাধীন রাষ্ট্রায়ত্ত হিসাববিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান, ICMAB দীর্ঘদিন ধরে এ খাতে পেশাগত দক্ষতা ও নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহে উৎপাদন কার্যক্রম বিশ্লেষণ, অপচয় নির্ণয় এবং কার্যকর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ICMAB গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। 

বর্তমানে বন্ডেড ওয়্যার হাউজ ব্যবস্থাপনার ত্রুটির সারসংক্ষেপঃ 
১. স্ব প্রণোদিত আমদানি, রপ্তানী ও মজুত পরিদর্শন প্রতিবেদন উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে বিশ্লেষণ মূলক নয়।

২. উৎপাদন ব্যবস্থাপনায় উৎপাদন ক্ষমতা, উৎপাদনে ব্যবহৃত কাচামালের অপচয় একটি কারিগরি বিষয় যাহা স্বাধীন নিরক্ষক (কোম্পানী আইন ১৯৯৪ এর ধারা ২২০ অনুযায়ী) দ্বারা যাচাই কৃত নয় বিধায় তথ্যের ভুল থাকার ঝুঁকি থাকে।

৩. মজুদ গণনা এবং চলতি কার্যে ব্যবহৃত কাঁচামালের মিলকরণ কারিগরি ও জনবলের বিষয়। কাস্টমস এজন্য অতিরিক্ত জনবল প্রয়োজন এবং সময়ের অপ্রতুল থাকায় বাস্তবে এর প্রয়োগ দেখা যায় না।

প্রস্তাবনাঃ উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে, সমাধানের পথ হিসাবে নিম্নলিখিত প্রস্তবনা পেশ করছিঃ 

১. শতভাগ রপ্তানিমুখী পোষাক শিল্প বন্ডেড ওয়্যারহাউজ প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে, কোম্পানী আইন ১৯৯৪ এর ধারা ২২০ অনুযায়ী প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে স্বাধীন নিরক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। যিনি কাস্টম কর্তৃক নির্ধাারিত ছকে প্রতিবেদন তৈরী করে বিশ্লেষণ স্বাপেক্ষে একটি প্রত্যয়ন পত্র প্রদান করবেন।

২. এই প্রত্যয়ন পত্রে নিরীক্ষক সম্ভাব্য করদায় সহ সুপারিশ করিবেন।

৩. এই প্রত্যয়ন পত্র কাস্টমস কর্তৃপক্ষকে প্রাক-পরিদর্শনের বিকল্প হিসাবে ব্যবহারের অনুমতি প্রদান।

৪. প্রকৃত সময় মজুদ গণনার উদ্দেশ্যে লাইসেন্স মেয়াদ উত্তীর্নের কমপক্ষে এক (১) মাস পূর্বে নিরীক্ষক নিয়োগ দানের বাধ্যবাধকতা।

৫. নিরীক্ষককে MIS ডাটা ব্যবহারের অনুমতির জন্য NBR, BB এবং ICMAB এর মধ্যে MOU করা।

৬. সম্ভাব্য করদায় পরিশোধ ও ফিস প্রদান স্বাপেক্ষে BGMEA কর্তৃক ইস্যুকৃত অটো নবায়নের কার্যকারীতা বৃদ্ধিকরণ।

আন্তজার্তিক স্বীকৃতিঃ ভারতে কাস্টমস অডিট রেগুলেশন আইন ২০১৮ এ পেশাদার একাউন্ট্যান্ট কতৃক কাস্টমস নিরীক্ষা অন্তর্ভূক্তির মাধ্যামে পেশাদার একাউন্ট্যান্টগণ কাস্টমস নিরীক্ষা কাজে সহযোগিতা করে থাকেন।

উপকারীতাঃ প্রকৃত সময় মজুদ গণনা এবং  উৎপাদন প্রক্রিয়া বিশ্লেষণের ফলে নিমোক্ত উপকারীতা প্রাপ্তির সুযোগ রয়েছেঃ
১. ব্যবসায়িক প্রক্রিয়া হবে দ্রুত স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক।
২. উৎপাদন ব্যবস্থাপনায় বিঘ্ন ঘটবে না। 
৩. ব্যবসায়ীদের অনর্থক হয়রানি কমবে।
৪. পরিদর্শন প্রক্রিয়া দ্রুত হবে: সময় ও প্রশাসনিক খরচ কমবে।
৫. কাস্টমস ও কোম্পানীর মধ্যকার অনৈতিক আর্থিক লেনদেন কমবে।
৬. সরকারের রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি পাবে।
৭. জাতীয় পর্যায়ে পেশাদার হিসাববিদদের অন্তর্ভুক্তি রাষ্ট্রীয় দক্ষতা বাড়াবে।

সুতরাং, বন্ডেড ওয়্যার হাউস নিরীক্ষায় স্বাধীন নিরীক্ষা ব্যবস্থা চালু করলে কেবল ব্যবসায়িক পরিবেশ সহজতর হবে না বরং রাষ্ট্রের আর্থিক সুশাসন ও দক্ষতা বাড়বে। এই লক্ষে, ICMAB কর্তৃপক্ষ ও BGMEA কর্তৃপক্ষ এর প্রতি যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য দৃষ্টি আকর্ষণ করছি এবং সরকারের প্রতি আবেদন জানাচ্ছি, শতভাগ রপ্তানিমুখী পোষাক শিল্পে বন্ড লাইসেন্স নবায়ন প্রক্রিয়ায় স্বাধীন নিরক্ষক (কোম্পানী আইন ১৯৯৪ এর ধারা ২২০ অনুযায়ী) এর নিরীক্ষা রিপোর্ট গ্রহণযোগ্যতা প্রদান করে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হোক।

লেখক: সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট, হিসাব ও অর্থ বিভাগ, গ্রুপ রিদিশা।

এএইচ