ঢাকা, শনিবার   ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫,   আশ্বিন ১২ ১৪৩২

ট্রাম্পের ভিসা নীতিতে ভারতীয় তরুণদের স্বপ্ন চুরমার!

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০১:০৫ পিএম, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫ শনিবার | আপডেট: ০১:৫১ পিএম, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫ শনিবার

মোটা বেতনের চাকরিতে যোগ দিতে মার্কিন মুলুকে পাড়ি দেওয়ার স্বপ্ন দেখছিল ভারতীয় অনেক তরুণ। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের একটি প্রোক্ল্যামেশন আপাতত  সেই পরিকল্পনাকে মোটামুটি তছনছ করে দিয়েছে বলা যেতে পারে।

‘এইচ ওয়ান-বি’ ক্যাটেগরির ভিসায় টেক বা মেডিক্যাল গ্র্যাজুয়েটদের মার্কিন কোম্পানিগুলো এতদিন চাকরি দিয়ে নিয়ে যেত, সেটার ফি গত ২০ সেপ্টেম্বরের পর থেকে এক লাফে বাড়িয়ে করা হয়েছে ১ লাখ ডলার! অথচ এতদিন এই ক্যাটেগরির প্রতিটি ভিসার ফি ছিল মাত্র ২ হাজার থেকে ৫ হাজার ডলার।

এই ১ লাখ ডলারের অঙ্কটা এইচ ওয়ান-বি ভিসায় আমেরিকায় গিয়ে যারা চাকরি করছেন, তাদের বার্ষিক গড় বেতনের চেয়েও বেশি।

অন্যভাবে বললে, ব্যতিক্রমী রকমের মেধাবী বা দক্ষতাসম্পন্ন না হলে বিদেশি কোনও প্রফেশনালকে এত চড়া ফি দিয়ে কোনও কোম্পানি আমেরিকায় কখনোই আনতে চাইবে না। কারণ তাতে তাদের খরচ পড়বে এখনকার তুলনায় প্রায় দ্বিগুণেরও বেশি।

কেন ভারতীয়দের ওপরেই কোপ?
গত আর্থিক বছরেও আমেরিকার এইচ ওয়ান-বি ভিসা পাওয়া ১০০ জনের মধ্যে ৭১ জনই ছিলেন ভারতীয়। তুলনায় চীনা নাগরিকরা ছিলেন সংখ্যায় ১১.৭ জন। বস্তুত যে দশটি দেশের নাগরিকরা সবচেয়ে বেশি এইচ ওয়ান-বি ভিসা পেয়ে থাকেন, ভারতের পর বাকি নটি দেশ মিলিয়েও তারা ভারতীয়দের চেয়ে অনেক কম সংখ্যক ভিসা পান, আর এটা ঐতিহাসিকভাবেই সত্যি।

টাটা কনসালটেন্সি সার্ভিস (টিসিএস) বা ইনফোসিসের মতো ভারতীয় কোম্পানিগুলোও এই ভিসার খুব বড় গ্রাহক।

আমেরিকার সিটিজেনশিপ ও ইমিগ্রেশন সার্ভিসেসের ওয়েবসাইট বলছে, চলতি আর্থিক বছরের জুন মাস পর্যন্ত আমেরিকা যে ১ লাখ ৭ হাজারের মতো এইচ ওয়ান-বি ভিসা মঞ্জুর করেছে, তার ১৩ শতাংশই পেয়েছে বিভিন্ন ভারতীয় কোম্পানি। নতুন ব্যবস্থায় এই রেওয়াজটা প্রবল অনিশ্চিত হয়ে পড়বে অবধারিতভাবে।

মার্কিন বাণিজ্যমন্ত্রী হাওয়ার্ড লুটনিক তো প্রথমে বলেছিলেন, কোনো তিন বছর মেয়াদী এইচ ওয়ান-বি ভিসার প্রত্যেক বছরেই সংশ্লিষ্ট কোম্পানিকে এই ১ লাখ ডলার ফি গুনতে হবে। পরে অবশ্য মার্কিন প্রশাসন পরিষ্কার করেছে যে এটা হবে একটা ‘এককালীন পেমেন্ট’।

এটাও পরে ঘোষণা করা হয়েছে যে মেডিক্যাল খাতে যারা এইচ ওয়ান-বি ভিসায় আসবেন, এই চড়া ফি থেকে ছাড় পাবেন তারাও। কিন্তু তাতে ভারতের হাজার হাজার হবু ইঞ্জিনিয়ারিং বা টেক গ্র্যাডদের কোনও সুরাহা হচ্ছে না।

সোশ্যাল মিডিয়া-সহ নানা প্ল্যাটফর্মে ভারতীয়রা অনেকেই মন্তব্য করছেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কার্যত এইচ ওয়ান-বি ভিসার কফিনে শেষ পেরেকটা পুঁতে দিয়েছেন– ফলে এই রুটে নতুন করে ভারতীয়দের আমেরিকা যাওয়ার রাস্তা একরকম বন্ধই হতে চলেছে।

ঠিক কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে?
তবে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (আইআইটি) বা ভারতের অন্যান্য প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানে অধ্যাপনায় যুক্ত আছেন, এমন অনেকেই আবার মনে করিয়ে দিচ্ছেন কয়েক বছর আগেও তরুণ গ্র্যাজুয়েটদের আমেরিকায় পাড়ি দেওয়ার যে 'ক্রেজ' ছিল তা এখন অনেকটাই স্তিমিত হয়ে এসেছে।

ফলে এইচ ওয়ান-বি বন্ধ হয়ে গেলেও তাতে খুব বড় কোনো 'হাহাকার' পড়ে যাবে না বলেই তাদের অভিমত।

বর্তমানে হায়দ্রাবাদ আইআইটি-র অধ্যাপক ড: সৌম্য জানা নিজে খড়্গপুর আইআইটি থেকে স্নাতক স্তরে পড়াশুনো করে বহু বছর যুক্তরাষ্ট্রে কাটিয়ে এসেছেন। তার অভিজ্ঞতা বলে, "নব্বইয়ের দশকে আমরা যখন আইআইটি থেকে পাস করে বেরিয়েছি তার তুলনায় এখন সদ্য গ্র্যাজুয়েটদের আমেরিকায় যাওয়ার ঝোঁক অনেক কম।"

"বরং ভারতীয়রা এখন বেশির ভাগই চায় তাদের কেরিয়ারের পরবর্তী কোনো পর্যায়ে মার্কিন ইকোসিস্টেম বা আমেরিকার বাজারের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে। এদের ক্ষেত্রে এইচ ওয়ান-বি'র নিয়ম পরিবর্তন খুব একটা প্রভাব ফেলবে বলে মনে হয় না", জানাচ্ছেন ড: জানা।

কারও আবার ধারণা, আমেরিকার ইতিহাস বলে সে দেশের ইমিগ্রেশন নীতি এরকম নানা ওঠাপড়ার মধ্যে দিয়ে যায়– ফলে এই পর্বটাও একটা সময় কেটে যেতে বাধ্য এবং আমেরিকাও তাদের নিজের স্বার্থেই বিদেশি পেশাদারদের জন্য দরজা খুলে দেবে।

কানপুর আইআইটি-র প্রাক্তনী অজয় কুমার কয়াল যেমন বলছিলেন, "এই মুহূর্তে ভারতীয়দের জন্য ভবিষ্যৎ বেশ অন্ধকার বলে মনে হচ্ছে, সেটা ঠিকই। তবে আমার মতে এখনই ওভাররিঅ্যাক্ট করারও কোনও দরকার নেই।"

"এই দেশটা ঐতিহাসিকভাবে এরকম নানা 'সাইকেলে'র মধ্যে দিয়ে গেছে – কাজেই এই পরিস্থিতিটাও চিরকাল থাকবে না বলেই আমাদের বিশ্বাস", জানাচ্ছেন ড: কয়াল।

আইআইটি-র যে প্রাক্তনীরা এখন আমেরিকায় বহু বছর ধরে রয়েছেন বা সে দেশের নাগরিকত্ব নিয়েছেন, তাদের কেউ কেউ আবার বিশ্বাস করেন ট্রাম্প প্রশাসনের এই নীতি ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের জন্য একটা বড় বিপর্যয় ডেকে আনবে।

ভারতীয়-আমেরিকান শিল্পোদ্যোগী ও খড়্গপুর আইআইটির প্রাক্তন ছাত্র বিপ্লব পাল যেমন সামাজিক মাধ্যমে লিখেছেন, "আজকে যে পুনে, ব্যাঙ্গালোর, হায়দ্রাবাদ তৈরি হয়েছে - যেখানে কম করে হলেও ১০ লাখের বেশী শুধু বাঙালি চাকরি করছে (কারণ পশ্চিমবঙ্গে চাকরি নেই)- এটা কি ভারত সরকার করে দিয়েছে?"

"না, এগুলো সম্ভব হয়ছে আইটি বিজনেস কোম্পানিগুলোর জন্য এবং এই আইটি বিজনেসে এইচ ওয়ান-বিতে লোক পাঠানো খুব দরকার। কারণ আমেরিকা থেকে কাজ তুলতে গেলে, তাদের ফ্যাক্টরি বা অফিসে বসে কাজ শিখে সেটা এরা ভারতীয়দের শেখায়। আজ ওই ভিসাটা না থাকলে, বাকি শহরগুলোর চাকরির অবস্থাও কলকাতার মতন হত।"

"তাছাড়া যারা গেছে, অনেকেই ভারতে কোম্পানি খুলেছে। ভারতে তারা বছরে ৫০ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠায়। যা ভারতের ফরেন রিজার্ভের সব থেকে বড় উৎস।"

"এটা খুব ভুল ধারণা যারা ভারতের বাইরে আমেরিকায় কাজ করছে- তারা ভারতকে কিছু ফিরিয়ে দেয়নি। আজকে ভারতের এই ৫০ লাখ আইটি চাকরি তৈরিই হতো না এই ভিসাতে লোকে আমেরিকাতে না গেলে", যুক্তি দিয়েছেন বিপ্লব পাল।

ভারতীয়রা যে ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন
তবে এই নতুন ভিসা নীতি ঘোষণার পর থেকেই ভারতের সোশ্যাল মিডিয়াতে যে ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে তা রীতিমতো উদ্বেগ আর আতঙ্কের।

এক্স বা ফেসবুকে এসে অনেকেই লিখছেন, মার্কিন মুলুকের ভারতীয় ডায়াসপোরা-র মধ্যে যে ধরনের 'প্যানিক' বা আতঙ্ক দেখা যাচ্ছে, সেটার অবশ্যই সঙ্গত কারণ আছে। কেউ কেউ মন্তব্য করছেন, ভারতীয়দের 'আমেরিকান ড্রিম' ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে।

'মুম্বাই নাওকাস্ট' নামে একটি হ্যান্ডল থেকে মন্তব্য করা হয়েছে, "ট্রাম্প এইমাত্র এইচ ওয়ান-বি ভিসা সিস্টেমটাকেই খুন করে ফেললেন।"

আরও একজন এক্স ব্যবহারকারী ব্যাখ্যা করেছেন কেন এটা ভারতের টেকনোলজি খাতে বড় বিপদ বয়ে আনতে চলেছে।

'ডি' নামে ওই ইউজার লিখছেন, "একটি টেক বহুজাতিকের টপ ম্যানেজমেন্টে কর্মরত এক বন্ধু বললেন : আমেরিকা হয়তো এই ধাক্কাটা সামলে নেবে, কিন্তু ভারত পারবে না।"

"কারণ যদি ৫০ হাজার ভারতীয় টেকি দেশে ফিরে আসেন, তার মধ্যে ৪৯ হাজারই চাকরি খুঁজতে ঝাঁপাবেন – অথচ দেশের বাজারে ভয়ঙ্কর মন্দা চলছে। অনেক কোম্পানি হয়তো তাদের পুরনো কর্মীদের ছাঁটাই করে আমেরিকার অভিজ্ঞতা-ওলা এই নতুনদের নিতে চাইবে।"

"আমরা সবাই বলতে ভালবাসি ভারতের কত প্রবৃদ্ধি হচ্ছে ... এখানে কিন্তু সত্যিকারের একটা বিপদ ঘনিয়ে আসছে, যার জন্য আমরা প্রস্তুত নই!"

নীতিন ভাটিয়া নামে আরো একজন লিখেছেন, "আমেরিকান স্বপ্ন এখন শেষ ... ভারতের আইটি শিল্পের জন্য এটা সূর্যাস্ত বয়ে আনছে।"

জনৈক অরুণ অরোরা মন্তব্য করেছেন, "এইচ -ওয়ানবি ভিসাতে আমেরিকাতে আছেন, এমন বেশ কয়েকজন বন্ধুর সাথে কথা হলো। প্যানিক ইজ রিয়াল!"

নিজেকে তেলুগুভাষী বলে পরিচয় দেওয়া 'উদয়' নামে একজন ইউজার আবার এক ধাপ এগিয়ে লিখছেন – আমেরিকা আসলে পরোক্ষে এইচ -ওয়ানবি ভিসাটাকেই নিষিদ্ধ করে দিলো।

তার পর্যবেক্ষণ, "তেলুগুরা অনেকেই ৪০ বা ৫০ লক্ষ রুপি ধারকর্জ করে আমেরিকায় পড়তে যায়। তারপর এই ভিসায় চাকরি জুটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে।"

"এখন তাদের সামনে একমাত্র রাস্তা হলো মাথায় ৫০ লাখ রুপি ঋণের বোঝা নিয়ে ভারতে ফিরে আসা। যার মানে দাঁড়ায়, 'গর্বিত এনআরআই' থেকে এই মানুষগুলো রাতারাতি ঋণগ্রস্ত 'গরিব ভারতীয়ে' পরিণত হলো!"

সূত্র: বিবিসি বাংলা

এএইচ