ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৪ ১৪৩০

৩২ নম্বরের বাড়িটি ছাড়তে বললেন কাও, কে তিনি?  

শেখ সাদী

প্রকাশিত : ১১:৫৬ এএম, ৬ আগস্ট ২০২২ শনিবার | আপডেট: ১২:১১ পিএম, ৬ আগস্ট ২০২২ শনিবার

৬ আগস্ট। বুধবার। সকাল ১২টায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করলেন শ্রমমন্ত্রী জহুর আহম্মেদ চৌধুরী এবং ১২টা ১০ মিনিটে দেখা করলেন সংস্কৃতি, তথ্য ও বেতারমন্ত্রী কোরবান আলী, প্রতিমন্ত্রী তাহেরউদ্দিন ঠাকুর। সঙ্গে ছিলেন সচিব মতিউল ইসলাম।

দুপুরে ‘র’প্রধান রমেশ্বর নাথ কাও এলেন ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে। ছয় ফুটের বেশি লম্বা। পড়ার ঘরে বসতে দেওয়া হলো। 

কাওয়ের সঙ্গে বেগম ফজিলাতুন্নেছার আগে দুবার দেখা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু এখন বাসায় নেই। কাওয়ের হাসিখুশি চেহারায় বিষন্নতার ছাপ। বেশ উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে। এই ঘরে এখন আর কেউ নেই। পিয়ন-ভৃত্যদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। 

কুশল বিনিময়ের পর কাও বললেন, ‘এই বাড়িটা আপনাদের জন্য নিরাপদ নয়।’ 

‘তা হলে বলেন আমরা এখন কোথায় থাকব?’ বললেন, ফজিলাতুন্নেছা। 

‘বঙ্গভবনে থাকুন।‘ 

‘আমার আপত্তি নেই। তবে আমি যাব না। তিনি যখন জেলে থেকেছেন, তখন বাচ্চাদের নিয়ে আমাকে এবাড়ি-ওবাড়ি করতে হয়েছে। থাকার নির্দিষ্ট জায়গা ছিল না। অনেক কষ্টে এই বাড়িটা করেছি। এখান থেকে সরব না। তিনি বঙ্গভবনে সুরক্ষিত থাকুন। মাঝে মধ্যে এখানে এলেই চলবে।’
 
এদিকে গুপ্তহত্যার ঘটনা ঘটলো চট্টগ্রামে। মেডিক্যাল কলেজ অধ্যক্ষের বাসভবনের সামনে গ্রেনেড বিস্ফোরণে নিহত দুইজন।

কে এই কাও?

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু রামেশ্বর নাথ কাও ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং ‘র’ এর প্রতিষ্ঠাতা। সংক্ষেপে আরএন কাও।

জওহরলাল নেহরু ও ইন্দিরা গান্ধী সরকারের সময়ে ভারতের নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্র বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন কাও। জন্ম উত্তর প্রদেশের বারানসি। তবে পরিবারের পরম্পরা কাশ্মীরের শ্রীনগরে। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেছেন লক্ষ্ণৌ ও এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৪০ সালে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা পার হয়ে যোগ দেন ইন্ডিয়ান ইমপেরিয়াল পুলিশে।

১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময় ভারতীয় পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগকে ঢেলে সাজানো হয়। কাও চলে যান আইবিতে। দায়িত্ব পেলেন ভিআইপিদের নিরাপত্তা দেয়ার। এই সময়ে জওহরলাল নেহরুর নজরে আসেন। নিজের ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষীদের প্রধান হিসেবে তাকে নিয়োগ দেন নেহরু । আইবি-র ‘স্পাইমাস্টার’ হিসেবে আরএন কাওয়ের দক্ষতায় মুগ্ধ নেহরু। পরে প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর সময়েও একই দায়িত্ব পালন করেন।

স্পাইমাস্টার রামেশ্বর নাথ কাও

১৯৫৫। প্রশান্ত মহাসাগরে ভারতীয় উড়োজাহাজ ‘কাশ্মীরি প্রিন্সেস’ বিস্ফোরিত হওয়ার ঘটনা কৃতিত্ব দেখান আরএন কাও। সে সময় চীনা প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাইও তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন।

১৯৬২। চীন-ভারত ও ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময়ে সামরিক প্রয়োজনে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহে বিশেষায়িত সংস্থার অভাব দেখা দেয়।
১৯৬৮ সালে ইন্দিরা গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর বিদেশে ভারতীয় গোয়েন্দা তৎপরতা চালাতে বিশেষায়িত সংস্থা হিসেবে গড়ে তোলা হয় ‘র’। সংস্থাটি গড়ে তোলার দায়িত্ব পেলেন আইবির বৈদেশিক শাখার প্রধান ও পিতা নেহরুর বিশ্বাসভাজন আরএন কাও। 

‘র’ গঠনের পর আরএন কাও প্রথমেই নজর দেন চীন, পাকিস্তান ও পূর্ববঙ্গের ওপর। সংস্থাটির কাউন্টার টেররিজম শাখার সাবেক প্রধান বি রমণ তার ‘কাওবয়েজ অব র’ বইয়ে লিখেছেন, ‘র’ গঠনের কয়েক মাসের মধ্যে আরএন কাও দুটি অগ্রাধিকার নির্ধারণ করেন। প্রথমত, পাকিস্তান ও চীনে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের ক্ষমতা সুসংহত করা। দ্বিতীয়ত, পূর্ব পাকিস্তানে গোপন তত্পরতা বৃদ্ধি ও সুসংহত করা।’

মাত্র এক বছরের মধ্যেই কাও বুঝতে পারেন এই অঞ্চলের শান্তির জন্য পূর্ববঙ্গের স্বাধীনতা দরকার। জোরাওয়ার দৌলত সিং তার ‘ইন্ডিয়াস ফরেন পলিসিজ ডিউরিং দ্য কোল্ড ওয়ার’ বইতে জানাচ্ছেন, ১৯৬৯ সালেই কাওয়ের অভিমত ছিল, ‘পূর্ব পাকিস্তান আরো ঘোলাটে পরিস্থিতি ও সম্ভাব্য স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে ভারতের প্রস্তুত থাকা উচিত।’

১৯৭১। জানুয়ারির শুরু থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সম্ভাব্যতা সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হতে থাকেন কাউ। তার ভাবনায় প্রভাবিত হয়ে পড়েন ইন্দিরা গান্ধী। 

এ সময় বাঙালিদের দমনে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য পরিবহন বন্ধ করতে ভারতের ওপর দিয়ে পাকিস্তানি উড়োজাহাজ চলাচল বন্ধের সিদ্ধান্ত নেন। তবে সেই কাজটি সহজ ছিল না। কারণ, প্রতিবেশী দেশের ফ্লাইট চলাচল বন্ধ করে দিলে ভারতের কূটনৈতিক চাপে পড়ার শঙ্কা ছিল। আরএন কাওকে সমাধান-সূত্র বের করার দায়িত্ব দিলেন ইন্দিরা গান্ধী।

অভিনব সমাধান-সূত্র বের করেন কাও। 

কাশ্মীরি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মধ্যে থাকা ‘র’ এর ডাবল এজেন্টদের দিয়ে ভারতীয় প্লেন ছিনতাই করালেন। সঙ্গে সঙ্গে ভারতের আকাশসীমার ওপর দিয়ে পাকিস্তানি ফ্লাইট চলাচল বন্ধের ‘কারণ’ তৈরি হয়ে যায়।

এতে পাকিস্তানের জন্য সৈন্য ও সামরিক সরঞ্জাম পরিবহনকে মারাত্মক রকমের দুঃসাধ্য করে তোলে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বিষয়টি পরিণত হয় পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর দুঃস্বপ্নে।

১৯৭১। ২ মার্চ। পিএন হাকসার, আরএন কাও, টিএন কাউল ও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র সচিবকে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী। কমিটির কাজ ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সহায়তা করলে ভারতের ওপর কী ধরনের প্রভাব পড়বে? সেটির সন্ধান আর সমাধানসূত্র বের করা।

২৫ মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইট শুরু হলে বাঙালিদের আশ্রয়-প্রশিক্ষণ-অস্ত্র এবং পাকিস্তানের কারাগারে বঙ্গবন্ধুর জীবনের সুরক্ষার সকল জায়গায় হাত বাড়িয়েছেন আরএন কাও।  

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী ও বঙ্গবন্ধু গবেষক  
এএইচএস/ এসএ/