ঢাকা, রবিবার   ২৮ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ১৫ ১৪৩১

বেড়িবাঁধের অভাবে দুর্বিষহ সীতাকুণ্ডবাসীর জীবনযাত্রা

মোহাম্মদ ইউসুফ

প্রকাশিত : ০৬:৩৫ পিএম, ১৯ আগস্ট ২০১৭ শনিবার | আপডেট: ০৮:৩৬ পিএম, ২৪ আগস্ট ২০১৭ বৃহস্পতিবার

নানামুখী সঙ্কটাবর্তে দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড। সীতাকুন্ড উপজেলার ভাগ্যাহত মানুষগুলো প্রতিনিয়ত হাবুডুবু খেলেও এসব দেখার যেন কেউ নেই। বেকারত্ব, সেচসঙ্কট, জলাবদ্ধতাসহ বিভিন্ন সমস্যার পাশাপাশি বেড়িবাঁধ না থাকাটাই এখানের প্রধানতম সমস্যা। জীবন-মরণ সমস্যা বললেও অত্যুক্তি হয় না। কেননা, বেড়িবাঁধ মানে প্রাণরক্ষা বাঁধ।

আবহমানকাল থেকে সীতাকুণ্ডের উপকূলীয় জনসাধারণ বেড়িবাঁধ-সমস্যার বেড়াজালে আটকে থাকলেও এর কোনো সমাধানের আলামত নেই। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে, এ সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব যাদের তারা নাকে তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছেন।

বেড়িবাঁধ না থাকায় সন্দ্বীপ-চ্যানেলের অব্যাহত ভাঙ্গনে শিল্পাঞ্চল সীতাকুণ্ডের সলিমপুর, ভাটিয়ারি, সোনাইছড়ি, কুমিরা ও বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ধ্বংস হয়ে গেছে কোটি কোটি টাকার সম্পদ। বাস্তুহারা হয়েছে কয়েক হাজার পরিবার। বেড়িবাঁধ না থাকায় আতঙ্কে দিন কাটে সমুদ্র উপকূলীয় বাসিন্দাদের। দক্ষিণ সীতাকুণ্ডের সমুদ্রোপকূলে চর জাগায় নদীভাঙ্গন বন্ধ হলেও বাঁশবাড়িয়া এলাকায় নদীভাঙ্গন ও জোয়ারের পানির উপদ্রপে জনজীবনে দুগর্তি ও ভোগান্তির শেষ নেই।। বেড়িবাঁধ না থাকায় উপকূলীয় অঞ্চলের ১০ থেকে ১২ কিলোমিটার জনপদ ভেসে যায় জোয়ারের পানিতে। ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের পূর্বাভাস পেলে এ এলাকার মানুষের মানসিক অবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। একানব্বইয়ের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের পরে কুমিরা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আ ফ ম মফিজুর রহমানকে আহ্বায়ক করে বেড়িবাঁধ বাস্তবায়ন পরিষদ গঠিত হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে এ পরিষদ অজ্ঞাতকারণে ঝিমিয়ে পড়ে। রাজা আসে রাজা যায় কিন্তু জনগণের জানমাল রক্ষার জন্যে অতিপ্রয়োজনীয় বেড়িবাঁধনির্মাণের কোনো উদ্যোগ নেয়া হয় না।

ফৌজদারহাট থেকে কুমিরা পর্যন্ত প্রায় ১৬ কিলোমিটার সমুদ্রোপকূলীয় এলাকার মধ্যে প্রায় আট কিলোমিটার জনপদ বিভিন্ন সময়ে জলোচ্ছ্বাস ও প্রবল জোয়ারে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাঁচশ’ বর্গকিলোমিটার আয়তনের সীতাকুণ্ড বর্তমানে তিনশ’ বর্গ কিলোমিটারে এসে ঠেকেছে। ৬০, ৬৩, ৭০ সালের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস পুরো সীতাকুণ্ডকে লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছিল। হাজার হাজার মানুষ সেদিন প্রাণ হারিয়েছিল।

ষাটের দশকের গোড়ার দিকে উত্তর সীতাকুণ্ডের বগাচতর থেকে বাঁশবাড়িয়া পর্যন্ত উপকূলীয় বেড়িবাঁধ নির্মাণের ব্যবস্থা করা হয়। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস সীতাকুণ্ডের বেড়িবাঁধহীন চারটি ইউনিয়নে প্রচণ্ড আঘাত হেনেছিল। তছনছ করে দিয়েছিল মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপন। কেড়ে নিয়েছিল সহস্রাধিক মানুষের তাজাপ্রাণ। বিষমভাবে ক্ষতি হয়েছিল ঘরবাড়ি, গবাদিপশু, গাছপালাসহ নানা সহায়-সম্পদের।

অতীতে সব সরকারের আমলে বেড়িবাঁধ নির্মাণের আশ্বাস মিলেছিল। ১৯৯৬ সালের ২৩ আগস্ট তৎকালীন সংসদ সদস্য এ বি এম আবুল কাসেমের উদ্যোগে পানিসম্পদ মন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান আবদুস সালাম দক্ষিণ সীতাকুণ্ডের বেড়িবাঁধবিহীন উপকূলীয় ভাঙ্গন-এলাকা পরিদর্শন করেছিলেন। মন্ত্রী সেদিন বেড়িবাঁধ নির্মাণের আশ্বাস দিলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। অতীতে বিভিন্ন সময়ে জনপ্রতিনিধিরা এ ব্যাপারে দেনদেরবার করেও কোনো কুলকিনারা করতে পারেননি।

এদিকে দক্ষিণ সীতাকুণ্ডের সলিমপুর, ভাটিয়ারি, সোনাইছড়ি, দক্ষিণ কুমিরা এলাকায় নদীর তলদেশ ভরাট ও চর জেগে ওঠায় ভাঙ্গন বন্ধ হলেও জোয়ারের পানির জ্বালায় মানুষের জীবনযাত্রা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। অন্যদিকে বাঁশবাড়িয়া সমুদ্রোপকূলীয় এলাকায় ভাঙ্গন প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকায় উপকূলবাসী মহাবিপদে আছে। সিকদারখাল থেকে আকিলপুর পর্যন্ত বেড়িবাঁধ না থাকায় জোয়ারের পানি বাড়িঘরে ঢুকে শতশত পরিবারের স্বাভাবিক জীবন দুর্বিষহ করে তোলে। জোয়ারের জলে পুরো এলাকা জলমগ্ন হয়ে পড়ে; চাষাবাদে বিঘ্ন ঘটছে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠির অভাব নিত্যসঙ্গী হয়ে পড়েছে। বছরখানেক আগে বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার আজিজুল হকের উদ্যোগে বেড়িবাঁধ নির্মাণের দাবিতে ভাঙ্গন এলাকায় মানববন্ধন পালন করা হয়েছিল।

অভিযোগ রয়েছে, বেড়িবাঁধ নির্মাণের ক্ষেত্রে শিপব্রেকিং ব্যবসায়ীরা বড় বাধা। শিপব্রেকিং ইয়ার্ড না থাকলে এতদিনে সীতাকুণ্ডের বেড়িবাঁধ নির্মাণ হয়ে যেতো। অতীতে শিপব্রেকিং ব্যবসায়ীরা পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়কে বিভ্রান্ত করেছে। সীতাকুণ্ড বেড়িবাঁধ বাস্তবায়ন পরিষদের আহ্বায়ক আ ফ ম মফিজুর রহমান বলেন, “আমরা বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্যে দেনদরবার করলেও শিপব্রেকিং ব্যবসায়ীরা এর বিরোধিতা করেন। তাদের কথায় বিভ্রান্ত হয়ে ১৯৯৬ সালে পানিসম্পদমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক বলেছিলেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক থাকলে বেড়িবাঁধের দরকার নেই।”

যুগের যুগের যুগ বেড়িবাঁধের অভাবে শিল্পাঞ্চল সীতাকুণ্ডের সমুদ্রোপকূলীয় এলাকার লাখলাখ মানুষ এভাবে জোয়ারের পানিতে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ঘটবে প্রাণহানি আর আমাদের জনপ্রতিনিধিদের এ নিয়ে কোনো মাথাব্যথা থাকবে না, তারা বার বার বেড়িবাঁধ নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোট নিয়ে নিজেদের আখের গোছাবে- তা তো হতে পারে না।

অতীতের সরকারগুলো না হয় আর্থিকভাবে তুলনামূলকভাবে দুর্বল ছিল বলে বেড়িবাঁধ নির্মাণের মতো ব্যয়বহুল প্রকল্প হাতে নিতে পারেনি। কিন্তু বর্তমান সরকার তো আর্থিকভাবে অনেক সচ্ছল। তারপরও সরকারের মেয়াদ শেষ হতে চললেও সীতাকুণ্ডের বেড়িবাঁধ নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণে পানিসম্পদমন্ত্রীকে রাজি করানোর ব্যর্থতা কার- তা উপলব্ধি করতে আমাদের আর কতো সময় লাগবে?

 

লেখক- প্রধানসম্পাদক, চাটগাঁর বাণী।