ঢাকা, শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ৭ ১৪৩১

ময়মনসিংহ গীতিকার ভাষা ও নারীর প্রেমশক্তি

প্রকাশিত : ০৩:৪৪ পিএম, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭ শনিবার


                                                                                                                                             এক শ্রেণির আখ্যানমূলক লোকগীতি বাংলাসাহিত্যে গীতিকা নামে খ্যাত। গীতিকাগুলো মূলত গান হিসেবে গাওয়ার জন্যেই রচিত। গ্রামবাংলার প্রচলিত সুরে এগুলো গাওয়া হয়। এতে সুরের চেয়ে কাহিনীরই প্রাধান্য থাকে। কাহিনীর মধ্যদিয়ে গীতিকার রস শ্রোতার কাছে উপস্থাপিত হয়। ছোট গল্পের মতই একটি মাত্র কাহিনীর ধারা অনুসরণ করে গীতিকা অগ্রসর হয়ে থাকে। সাহিত্য বিচারে ময়মনসিংহ গীতিকা লোকগীতিরই অংশ বিশেষ। গ্রামের সাধারণ মানুষ অবসর সময়ে পালাগানের অনুষ্ঠান উপভোগ করত। পল্লীজীবনের মাধুর্য মিশ্রিত এসব গান সবশ্রেণির মানুষের হৃদয়কে আকর্ষণ করে।
ড. দীনেশচন্দ্র সেনের উদ্যোগে এবং স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের আনুকূল্যে চন্দ্রকুমার দে ময়মনসিংহ গীতিকা সংগ্রহ করেন। চন্দ্রকুমার দে ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে নেত্রেকোণার অন্তর্গত আইথর নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার পূর্বাংশে নেত্রেকোণা, কিশোরগঞ্জের বিল, হাওর ও বিভিন্ন নদনদী প্লাবিত বিস্তৃত ভাটি অঞ্চল থেকে বাংলার এ শ্রেষ্ঠ গীতিকাগুলো তিনি সংগ্রহ করেছিলেন। এগুলোর মধ্যে মহুয়া, মলুয়া, কমলা, চন্দ্রাবতী ও জয়চন্দ্র, ঈশাখা দেওয়ান, দস্যু কেনারাম, রূপবতী, ফরোজ খাঁ দেওয়ান, মহরম খাঁ দেওয়ান, দেওয়ান ভাবনা, ছুরত জামাল ও আধুয়া সুন্দরী, কাজল রেখা, অসমা, ভেলুয়া সুন্দরী, কঙ্ক ও লীলা, মদনকুমার ও মধুমালা, গোপিনী কীর্ত্তন, দেওয়ানা মদিনা, বিদ্যাসুন্দর প্রভৃতি পালাগানগুলো বর্তমান যুগেও অত্যন্ত জনপ্রিয়।
এ পালাগানগুলোর ভাষা সহজ সরল সাধারণ মানুষের ভাষা কিন্তু মর্মস্পর্শী। তৎসম শব্দের ব্যবহার খুবই কম। প্রসঙ্গত বলা যায়, বাংলা সাহিত্যে আধুনিক যুগের গোরার দিকের সংস্কৃতপ্রেমী পণ্ডিতরা তৎসম শব্দবহুল যে কৃত্রিম সাধু ভাষার প্রচলন করেছিলেন, ময়মনসিংহ গীতিকার ভাষা সে রূপ নয়। এ ভাষা প্রাকৃত ভাষার সহোদর। বাংলা সংস্কৃত ভাষা থেকে উদ্ভূত বলে কেউ কেউ মনে করেন সংস্কৃত যুগের পূর্ব সাহিত্য বিশেষত ময়মনসিংহ গীতিকাগুলো পাঠ করলে সে ভুল ঘুচে যাবে। খাঁটি বাংলা যে প্রাকৃতের কত কাছের এবং সংস্কৃত হতে কত দূরে তা পরিষ্কারভাবে বুঝা যায়। এ দেশের সাধারণ মানুষ ‘আত্তি’ বলত ‘হস্তি’ বলত না। ‘শাওন’ বলত ‘শ্রাবণ’ বলত না, ‘মিডা’ বলত ‘মিষ্টি’ বলত না। আত্তি, শাওন, মিডা প্রভৃতি শব্দগুলো প্রাকৃতভাবেই ব্যবহৃত। গ্রামের চাষারা এখনো এ ভাষাতেই কথা বলেন।
প্রসঙ্গত ময়মনসিংহ গীতিকার মলুয়া পালা থেকে কিছু অংশ উদ্ধৃত করা হলো-
“আগরাঙ্গ্যা সাইলের খেত পাক্যা ভূমে পড়ে
পন্থে আছে বইনের বাড়ী যাইব মনে করে।।
মায়ের পেটের বইন গো তুমি শুন আমার বাণী।
শীগারে যাইতে শীঘ্র বিদায় কর তুমি।
ঘরে ছিল সাচি পান চুন খয়ার দিয়া।
ভাইয়ের লাগ্যা বইনে দিল পান বানাইয়া।।
উত্তম সাইলের চিড়াগিষ্টেতে বান্ধিল
ঘরে ছিল শবরি কলা তা ও সঙ্গে দিল।।
কিছু কিছু তামুক আর টিক্কা দিল সাথে
মেলা কইরা বিনোদ বাহির হইল পথে।।
যত দূর দেখা যায় বইনে রইল চাইয়া
শীগারে চলিল বিনোদ পালা কুড়া লইয়া”
উল্লিখিত উদাহরণ থেকে আমরা স্পষ্টতই বুঝতে পারি ময়মনসিংহ গীতিকার ভাষা একান্তই গণমানুষের। এ ভাষায় রঙরস আছে, কারুকাজ আছে কিন্তু কৃত্রিমতা নেই। এগুলোর মধ্যে অতি সাধারণ মানুষের চিন্তা-চেতনা, জীবনবোধ, আবেগ অনুভূতির পরিচয় মেলে। ময়মনসিংহ গীতিকার কাহিনীগুলোর কথা গ্রাম্য কবিরা পয়ারে গেঁথে রেখেছেন  যাতে খুঁজে পাওয়া যায় অফুরন্ত কারুণ্য ও কবিত্যের সন্ধান। গীতিকাগুলোর কবিরা আজ নেই; তাদের অশ্রু ফুরিয়েছে কিন্তু এসব কাহিনীর শ্রোতাদের অশ্রু কখনো ফুরাবে না। উত্তরে গারো পাহাড়, জয়ন্তা ও খাসিয়ার অসম শৈলশ্রেণি... তাদের পদস্পর্শে এক দিকে সোমেশ্বরী ও অপর দিকে কংস চলে গেছে। তাছাড়া দক্ষিণ-পূর্বে নানা ধারায় ধনু, ফুলেশ্বরী, বাজেশ্বরী, ঘোড়া-উৎরা, সুন্ধা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র কখনো ভৈরব রবে কখনো বা বীণার ন্যায় মধুর নিক্বনে প্রবাহিত হয়েছে। তা ছাড়া এখানে রয়েছে অসংখ্য বিল-ঝিল। বিলগুলোকে এ অঞ্চলে ‘হাওর’ বলা হয়ে থাকে। এ হাওর অঞ্চলই ময়মনসিংহ গীতিকার নায়ক-নায়িকাদের বিচরণ ক্ষেত্র।
ময়মনসিংহ গীতিকার কাহিনীগুলো মূলত নারীর প্রেম-শক্তির জয় গান এবং নারীর ব্যক্তিত্ব, আত্মবোধ, স্বাতন্ত্র্য ও সতিত্ব প্রভৃতি বৈশিষ্ট্য এতে প্রকাশমান। এ গানের নায়িকারা অপূর্ব প্রেমশক্তির অধিকারিণী হয়ে তাদের নারীধর্ম ও সতিত্ব রক্ষা করেছে। প্রেমের জন্য দুঃখ, তিতিক্ষা, আত্মত্যাগ ইত্যাদি সর্বসমর্পণ করে নারী যে কী অসীম মহিমা লাভ করতে পারে, গীতিকাগুলো তারই পরিচায়ক। পল্লী-কবির সহজ সরল দৃষ্টি শাশ্বত নারীর অকৃত্রিম রূপ এখানে ফুটে উঠেছে। চরিত্রগুলো হাওর অঞ্চলের প্রাকৃতিক সত্তার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তাদের স্বভাবের মাধুর্য ও সৌন্দর্যের সাথে সর্বসংস্কার মুক্ত প্রেমের বিকাশ ঘটেছে। পল্লীসমাজের সহজ প্রেম গীতিকাগুলোর উপজীব্য হয়ে তৎকালীন সমাজকে প্রতিফলিত করেছে। তাই সামাজিক কবিতা হিসাবে এগুলো অবশ্যই মূল্যবান।
গীতিকাগুলোর মধ্যে মহুয়ার পালাটি বেদের এক অপূর্ব সুন্দরী মেয়ে মহুয়ার সঙ্গে বামনকান্দার জমিদার ব্রাহ্মণ যুবক নদের চাঁদের দুর্জয় প্রণয় কাহিনী অবলম্বনে রচিত। পল্লীকবি দ্বিজকানাই আশ্চর্য দক্ষতার সাথে এই বিষাদাত্মক প্রণয়কাহিনী বর্ণনা করেছেন এবং এতে কবির সুগভীর অন্তর্দৃষ্টির পরিচয় পাওয়া যায়।
নায়ক-নায়িকার প্রেমানুভূতি কবি নাটকীয়গুণে সমৃদ্ধ করে উপস্থাপন করেছেন।
“জল ভর সুন্দরী কন্যা জলে দিছ ঢেউ।
হাসিমুখে ‘কওনা কথা সঙ্গে নাই মোর কেউ।’
নাহি আমার মাতা পিতা গর্ভ-সুদর ভাই
সুতের হেওলা অইয়া ভাইস্যা বেড়াই”
মনসুর বয়াতি রচিত দেওনা মদিনার পালায় বানিয়াচঙ্গের দেওয়ান সোনাফরের পুত্র আলাল ও দুলালের বিচিত্র প্রেমের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। এ কাহিনীতে মদিনার ত্যাগ ও নীরব সহিষ্ণুতার মাধ্যমে নারী জীবনের মাধুর্য কবি নিপুণভাবে তুলে ধরেছেন। গীতিকাগুলোর সর্বত্রই নারীহৃদয়ের প্রেমের বিচিত্র বৈশিষ্ট্য সার্থকতা সহকারে রূপায়িত হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে বিয়োগাত্মক প্রেমকাহিনী গীতিকাগুলোর উপজীব্য। প্রেমের গতি যে কত বিচিত্র ও জটিল, অন্তঃপ্রবৃত্তির সঙ্গে বহিঃসংস্কারের সংঘাত যে কত প্রবল ময়মনসিংহ গীতিকার বিভিন্ন নারী চরিত্রে তার নিদর্শন বিদ্যমান।
উল্লিখিত কবিগণ রচিত এ কাহিনী-কাব্যগুলো পড়লেই বুঝা যায় প্রেমের কী দুর্জয় শক্তি। লীলার লীলাবসান, সোনাই-এর নির্বাক ও নির্ভীক মৃত্যু, কাজল-রেখার চরিত্রের সহিষ্ণুতা এবং প্রগাঢ় প্রেমনিষ্ঠার জীবন্ত সমাধি, চন্দ্রার তপোনিরত শান্তি বাস্তবিকই গৌরব করা মত। ময়মনসিংহ গীতিকার উদার মুক্ত-ক্ষেত্রে প্রেমের অনাবিল যে ধারা ছুটেছে তা প্রস্রবণের মত অবাধ ও নির্ঝরের মত নির্মল। এ গীতিকা থেকে আমরা মালঞ্চমালা, কঙ্খনমালা, কাঞ্চনমালা এবং পুষ্পমালার কথা পাই প্রেমের রাজ্যে এরা সহোদরা। তারা প্রেমের শক্তিতে বলীয়ান। স্বামীর প্রতি মলুয়ার ভালোবাসা অকৃত্রিম। এতে ধর্ম বা মত প্রচার নেই বা কোন যুগোচিত সমস্যার সমাধান নেই। এর আদর্শ সনাতন প্রেমের আদর্শ এবং এর প্রেমে-সুধা অফুরন্ত। যত দিন মানুষ থাকবে মানুষের হৃদয় থাকবে এ প্রেম-সুধারও প্রয়োজন থাকবে।
কোন বিশেষ দার্শনিক বিশ্বাস কিংবা তাত্ত্বিক সিদ্ধান্ত গীতিকা-রচয়িতাদের জীবন-দৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করেনি। জীবন বিরোধী সবকিছুই অস্বীকৃত হয়েছে এ কাব্যমালায়। এখানে বাস্তব বা কল্পনা সবই জীবন-নির্ভর। কবিরা সরলভাবে জীবন ও যৌবনের গান গেয়েছেন। চরিত্র-চিত্রণের নৈপুণ্যে প্রেম বিশুদ্ধ অনুভূতির স্তর অতিক্রম করে স্পষ্ট বাস্তবতায় প্রত্যেকটি কাহিনী অসাধারণ হয়েছে।
পরিশেষে বলা যায়, ময়মনসিংহ গীতিকা মূলতই মুক্ত প্রেমের জয়গান। স্বাধীনভাবে জীবন সাথী বেছে নেবার স্বীকৃতি এখানে আছে। এ গীতিকার নারীরা কখনো ধর্মীয় কুসংস্কারের বেড়াজাল ছিন্ন করেছে কখনো বা অভিভাবকের অভিমতের বিরুদ্ধে পতি মনোনয়নের জন্যে গৃহ ত্যাগ করেছে। এটা অলৌকিক, অসম্ভব বা অবাস্তব নয়। এটাই নারীর শক্তি, উদার ও ধর্মনিরপেক্ষ মানবিক মূল্যবোধের জয়গান।

লেখক: শিক্ষাবিদ ও কথাশিল্পী; সদস্য বাংলা একাডেমি
//এআর