ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৪ ১৪৩০

‘গ্লাস্কো’র মতো আন্তর্জাতিক মানের ওষুধশিল্প গড়তে চাই’

মোহাম্মদ ইউসুফ

প্রকাশিত : ০৯:২৩ পিএম, ৭ অক্টোবর ২০১৭ শনিবার | আপডেট: ০৫:৩৭ পিএম, ১০ অক্টোবর ২০১৭ মঙ্গলবার

মো. রাইসূল উদ্দিন সৈকত। বন্দরশহর চট্টগ্রামের শিল্পাঞ্চল সীতাকুণ্ডের কৃতীসন্তান। ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দের ২১ জানুয়ারি স্বনামধন্য পরিবারে জন্ম। নতুন প্রজেন্মের প্রতিনিধি তিনি। বয়সে নবীন হলেও অভিজ্ঞতায় প্রবীণ। দেশের যেসব মেধাবী ও তরুণ শিল্প উদ্যোক্তা উদ্যম, সাহস ও সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রেখে আসছেন, সৈকত তাদেরই একজন। স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশ ও তথ্য-প্রযুক্তির ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার যে প্রত্যয় ও স্বপ্নপূরণের লড়াই চলছে তিনি তার সক্রিয় অংশীদার।

সম্ভাবনাময় এ তরুণ শিল্পোদ্যাক্তা একটি উন্নত দেশ, সমৃদ্ধ ডিজিটাল সমাজ, রূপান্তরিত উৎপাদন ব্যবস্থা, নতুন জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি- সব মিলিয়ে একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে অবদান রাখতে চান। বাবার অর্পিত ব্যবসায়িক দায়িত্ব তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনার মাধ্যমে পারিবারিক  সুনাম ও ঐতিহ্য অক্ষুন্ন রেখে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছেন। দিনে দিনে তাঁর ব্যবসায়িক সুনাম ও সমৃদ্ধি বেড়েই চলেছে। চট্টগ্রামের প্রায় সকল রাজনীতিবিদ, জনপ্রতিনিধি, ব্যবসায়ী-শিল্পপতি, গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব থেকে শুরু করে প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সাথে উদীয়মান তরুণ এ শিল্পপতির রয়েছে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। ২০০৬ সালে অস্ট্রেলিয়া থেকে কম্পিউটার বিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষা শেষে স্বদেশের মাটিতে ফিরে এসে বাবার ব্যবসায়ের হাল ধরেন তিনি। ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক ও জনহিতকর কাজেও তিনি নিয়োজিত।

সীতাকুণ্ড শিল্পাঞ্চলে দুটি ওষুধ ফ্যাক্টরি রয়েছে। একটি বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানি ‘গ্লাক্সো স্মীথক্লাইন’ আর অন্যটি হলো এলবিয়ন গ্রুপের ‘এলবিয়ন ল্যাবরেটরিজ লিমিটেড’। সৈকতের স্বপ্ন আকাশছোঁয়া। তিনি তার নতুন নির্মাণাধীন এলবিয়ন স্পেশালাইজড ফার্মা লিমিটেডকে গ্লাস্কোর মতো আন্তর্জাতিক মানের বৃহদায়তনের ওষুধশিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করছেন।

তিনি মনে করেন, যেকোনো ক্ষেত্রে সফলতা অর্জন করতে হলে প্রয়োজন পরিশ্রম, সাধনা, অধ্যবসায়। এছাড়াও প্রয়োজন সততা, নিষ্ঠা ও আন্তরিক প্রচেষ্টা। শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতেও বহু বাধা বিপত্তি ও অপরিসীম ত্যাগ-তিতিক্ষা স্বীকার করতে হয়। একাগ্রতা, ধৈর্য ও সাহসের সাথে সকল প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে পূরণ করতে হয় কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য। সহজপথে পৃথিবীতে কোনোকিছুই অর্জন করা যায় না। এলবিয়ন গ্রুপকেও বর্তমান পর্যায়ে আনতে আমাদের বিশেষ করে তারা বাবাকে অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হয়েছে বলে জানান তিনি।

চট্টগ্রাম জুনিয়র চেম্বার ইন্টারন্যাশনাল এর ভূতপূর্ব সভাপতি, এলবিয়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান রাইসুল উদ্দিন সৈকত এর সাথে সম্প্রতি তাঁর ব্যবসায়িক কার্যালয়ে অনেকক্ষণ আলাপ হয়। এলবিয়ন গ্রুপের গোড়াপত্তনের ইতিহাস, ওষুধশিল্পের সমুজ্জ্বল সম্বাবনা ‍ও সীতাকুণ্ডের বাড়বকুণ্ড শিল্পপল্লীতে নির্মাণাধীন ওষুধশিল্প এলবিয়ন স্পেশালাইজড ফার্মা লিমিটেড নিয়ে আলোচনা হয়। আলাপ-আলোচনায় যা ওঠে এসেছে তা হল-

 ১৯৯১ সালে মাত্র ১০০ কর্মী ও ৩০ আইটেমের ওষুধ নিয়ে চট্টগ্রাম শহরের চান্দগাঁও আবাসিক এলাকায় ভাড়া করা ভবনে ক্ষুদ্রপরিসরে এলবিয়ন ল্যাবরেটরিজ লিমিটেডের যাত্রা শুরু। বাবা আলহাজ্ব নেজাম উদ্দীনের কঠোর সাধনা ও পরিশ্রমের ফসল এ ওষুধ কারখানা। ৮ শতাধিক লোক এখানে কর্মরত। শিল্পাঞ্চল সীতাকুণ্ডের বাড়বকুণ্ড ইউনিয়নের দক্ষিণ-রহমতনগর এলাকায় বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে কারখানাটির অবস্থান। ফুলে-ফলে পল্লবিত হয়ে কালক্রমে এলবিয়ন ল্যাবরেটরিজ এখন এলবিয়ন গ্রুপ। বর্তমানে ৮টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে এ গ্রুপের। বেশিরভাগ জীবনরক্ষাকারী ওষুধ তৈরির প্রতিষ্ঠান। পশুখাদ্য উৎপাদন ও ভোগ্যপণ্যের কারখানাও আছে। দেশের সীমানা ছাড়িয়ে এলবিয়ন রপ্তানি বাজারে ঢোকার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ইতোমধ্যে বর্তমান কারখানা থেকে অনতিদূরে নিজস্ব জায়গার উপর সম্পূর্ণ কমপ্লায়েন্স কারখানার নির্মাণকাজ জোরেশোরে চলছে। এলবিয়ন গ্রুপের ১২০কোটি টাকা বিনিয়োগের এ নতুন ইউনিট এলবিয়ন স্পেশালাইজড ফার্মা লিমিটেড ২০১৯ সালের মধ্যে বিদেশে ওষুধ রপ্তানির লক্ষমাত্রা নিয়ে এগুচ্ছে। ১২ ’একর জায়গার উপর অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে গড়ে তোলা শতভাগ রপ্তানিমুখি নির্মিতব্য এ কারখানায় ৩ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হবে। একই সীমানার মধ্যে এখানে ৫টি কমপ্লেক্স হবে। প্রায় ৪৫০টি মানব স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্ট ওষুধের আইটেম থাকবে। নতুন পণ্য হিসেবে ওয়ানটাইম ইনজেকশন সিরিঞ্জ, ড্রপ, ইনজেকটেবল আইটেম উৎপাদন করা হবে। নেপাল, ভুটান, শ্রীলংকা, মিয়ানমার ও আফ্রিকায় ওষুধ রপ্তানি করার পরিকল্পনা রয়েছে।

বর্তমানে এখানে মানব স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্ট ৩শটির অধিক আইটেম ওষুধ ও পশুস্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট আরও ২শ আইটেম ওষুধ ও অন্যান্য পণ্য প্রস্তুত করা হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে এলবিয়নের ৩২৫টি আইটেম ওষুধ তালিকাভুক্ত আছে। এরমধ্যে রয়েছে অ্যান্টাসিড, তেমনি রয়েছে বিভিন্ন ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ। ওষুধের গুণগতমানের জন্যে আইএসও ২০০১ ও ২০০৮ সনদও অর্জন করেছে এলবিয়ন গ্রুপ। গত কয়েকবছর ধরে ১২-১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে কোম্পানিটি।

দেশে ওষুধশিল্পের অমিত সম্ভাবনার পাশাপাশি নানা সমস্যা ও সীমাবদ্ধতার চিত্র তুলে ধরে এলবিয়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান রাইসুল উদ্দিন সৈকত বলেন, “ পাঁচ লাখেরও বেশি লোক ওষুধশিল্পের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত। এ শিল্পের কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয় বলে ওষুধের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যায়। কাঁচামালের বিদেশ নির্ভরতা কমাতে পারলে উৎপাদন ব্যয় অনেক কমে যায়। সরকার যদি ব্যাংক ঋণ প্রাপ্তিতে দীর্ঘসূত্রতা ও জটিলতা দূর করে এ খাতে সহজশর্তে ও কমসুদে ব্যাংকঋণের ব্যবস্থা করে তাহলে ওষুধশিল্প দ্রুত বিকশিত হবে এবং কর্মসংস্থানের পাশাপাশি সরকারি কোষাগার সমৃদ্ধ হতো। এছাড়া দেশ যদি শিল্পোন্নত না হয়, তাহলে বর্তমান সরকারের ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণের যে স্বপ্ন রয়েছে তা বাস্তবায়ন হবে না। তাই তরুণ শিল্পোদ্যাক্তাদের জন্যে সরকারকে শিল্পবান্ধব প্রণোদনামূলক যুগোপযোগী নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে।”

সৈকতের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাংলাদেশের ওষুধের অভ্যন্তরীণ বাজার ১৪-১৫ হাজার কোটি টাকার। বেশ কয়েকবছর আগে থেকে ওষুধশিল্পে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পন্ন। স্কয়ার, এসিআই, রেনাটা, ইনসেপটা, এসকেএফসহ অনেক দেশি কোম্পানিই এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা মহাদেশে ওষুধ রপ্তানি করছে। গত অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিশ্বের ১২০টি দেশে ৮২.১ মিলিয়ন ডলার বা ৬৫০কোটি টাকার ওষুধ রপ্তানি হয়েছে। আগামীতে গার্মেন্টস এর পরে ওষুধ-ই হবে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানিপণ্য।

সৈকত এলাকার বিভিন্ন সামাজিক ও সেবামূলক সংগঠনের সাথে জড়িত। তিনি কালের কণ্ঠ শুভসংঘের উপদেষ্টা, ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম অব বাংলাদেশ(আইবিএফবি), চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব ও চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক সমিতির জীবন-সদস্য এবং সীতাকুণ্ড সমিতি- চট্টগ্রাম এর পৃষ্টপোষক সদস্য ছাড়াও বিভিন্ন সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত।

ব্যক্তিগতজীবনে সৈকত দুই সন্তানের জনক। তাঁর স্ত্রী তাসনিন মাহমুদ। ছেলে আহমেদ জায়ান অ্যারিশ ক্লাস ওয়ানে পড়ে আর মেয়ে ইয়ারিকা ইলমিয়াত এখনো খুবই ছোট্ট। তিনি শিল্পপতি ব্যবসায়িক ও ব্যক্তিগত কাজে ভারত, নেপাল, শ্রীলংকা, ভুটান, মালদ্বীপ, মায়ানমার,অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা, জার্মানি, চেক রিপাবলিক, নিউজিল্যান্ড, তুর্কিস্তান, হংকং, ডুবাই, চীন, জাপান, আবুধাবিসহ বিশ্বের বহু দেশ ভ্রমণ করেন।

 

লেখক- প্রধান সম্পাদক, সাপ্তাহিক চাটগাঁর বাণী