ঢাকা, রবিবার   ১৯ মে ২০২৪,   জ্যৈষ্ঠ ৫ ১৪৩১

গুলিবিদ্ধ পুত্রকে নিয়ে কষ্টে আছেন অন্ধ পিতা

জাহাঙ্গীর আলম, টেকনাফ থেকে :

প্রকাশিত : ০৩:২২ পিএম, ১১ অক্টোবর ২০১৭ বুধবার | আপডেট: ০৩:২৭ পিএম, ১১ অক্টোবর ২০১৭ বুধবার

পিতা আব্দুর রহমান অন্ধ। উপার্জনক্ষম ছেলের উপর কয়েকদিন আগে গুলি চালায় মিয়ানমার সেনাবাহিনী। এখন ৮ সদস্যের পরিবার নিয়ে অসহায় ও মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন আবদুর রহমান। এখন ভিক্ষাই তার একমাত্র সম্বল।

বাংলাদেশে পালিয়ে আসার ট্রলার ভাড়া ও মিয়ানমার সেনাদের গুলিতে আহতদের বাংলাদেশে পাঠানো বাবদ বিশাল অংকের দেনার দায়ে জর্জরিত তিনি। গুলিবিদ্ধ ছেলের চিকিৎসার খরচ যোগাতে ভিক্ষার ঝুলি মাথায় নিয়ে মানুষের দ্বারে দ্বারে, রাস্তায় ও মসজিদের দরজায় ঘুরছেন অন্ধ রোহিঙ্গা হাফেজ আবদুর রহমান (৪৮)।

টেকনাফ উপজেলার হ্নীলা ইউনিয়নের লেদা অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্প (স্থানীয় ভাষায় রোহিঙ্গা টাল) সংলগ্ন এলাকায় থাকছেন তিনি। সেখানে স্থানীয় জহির আহমদের মালিকানাধীন জমিতে নতুন অনুপ্রবেশকারী অন্যান্য রোহিঙ্গাদের সাথে মাসিক ৫০০ টাকায় ঝুপড়ি ভাড়া করে থাকেন তিনি। গত সোমবার সকালে সেখানে দেখা হয় অন্ধ হাফেজ আবদুর রহমানের।

তার দ্বিতীয় পুত্র মো. আলম (১৬) মিয়ানমার সেনাবাহিনীর গুলিতে আহত। তার ডান হাত ও ডান পায়ে গুলি লেগেছে।

তাদের বাড়ি মিয়ানমারের মংডু মেরুলার ঝুমপাড়া গ্রামে। তার বাবার নাম মৃত আবদুচ্ছালাম। নিজে অন্ধ হলেও সুন্দর সাজানো-গোছানো সুখের সংসার ছিল তাদের। সংসারে রয়েছেন স্ত্রী দিল বাহার বেগম (৩৭), পুত্র শফিক আলম (১৮), মিয়ানমার বাহিনীর গুলিতে আহত মো. আলম (১৬), কন্যা ফেরদৌস বেগম (১৪), পুত্র মো. রিদুয়ান (১২), মো. জোহার (১০), কন্যা হুরি জন্নাত (৮)।

অশ্রুসজল নয়নে অন্ধ হাফেজ আবদুর রহমান বলেন ‘সেপ্টেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে মিয়ানমার বাহিনী ও রাখাইনের বৌদ্ধরা মিলে যেদিন আমাদের গ্রামে অভিযান শুরু করে, তখন পুরো গ্রামে ভয়াবহ অবস্থা। চারদিকে গুলির শব্দ। আগুনে বসতবাড়ি পোড়ানোর গন্ধ। মার মার, কাট কাট, লুটপাট আর অসহায় রোহিঙ্গাদের আত্মচিৎকার, দিগ্বিদিক ছোটাছুটি। প্রাণ বাচাঁনোর তাগিদে স্ত্রী, পুত্র-কন্যাসহ পালানোর সময় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বেপরোয়া ব্রাশ ফায়ারে আমার দ্বিতীয় পুত্র মো. আলম (১৬), প্রতিবেশী পুতুইয়ার পুত্র শামসুল আলম (২৩), জমির হোছনের পুত্র আক্তার কামাল (২৫), আবুল হোছনের পুত্র জাহেদ হোছন (২০) এবং রাহমতুল্লাহ (২৩) নামে অপর এক যুবকসহ ৫ জন আহত হয়। মিয়ানমার সেনা-পুলিশ ও মগদের চোখ এড়িয়ে কোনো রকমে গ্রামবাসীদের সহযোগিতায় আমরা পাহাড়ে আশ্রয় নিই। একদিকে গুলিবিদ্ধদের ক্ষত স্থান থেকে রক্তক্ষরণ, অন্যদিকে সেনা আতংক, সে এক ভয়ানক অবস্থা। প্রথমে গুলিবিদ্ধদের জরুরি চিকিৎসার জন্য ৫ লাখ কিয়াট ট্রলার ভাড়া কর্জ করে বাংলাদেশে পাঠানো হয়। এরপর ১২ সেপ্টেম্বর আমরা বাংলাদেশে আসি। ট্রলার মালিক ভাড়ার জন্য আমাদের টেকনাফের কাটাবনিয়া গ্রামে ২ দিন ধরে আটকে রাখে। আমাদের ট্রলারে ১৮ জন রোহিঙ্গা ছিল। পুর্ব পরিচিত ও আত্মীয়দের কাছ থেকে কর্জ নিয়ে জনপ্রতি ৩ হাজার বাংলাদেশি টাকা ভাড়া পরিশোধ করে মুক্তি পাই। এরপর ৮ দিন নতুন পল্লান পাড়ার একটি বাড়িতে আশ্রয়ে থেকে নতুন অনুপ্রবেশকারী অন্যান্য রোহিঙ্গাদের সঙ্গে এখানে চলে আসি।

মিয়ানমার সেনাবাহিনীর গুলিতে আহত পুত্র মো. আলমের চিকিৎসার ব্যাপারে আব্দুর রহমান বলেন, প্রথমে টেকনাফের সরকারী হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসার পর লেদা অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের সেবায় নিয়োজিত আর্ন্তজাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছিল। কয়েকদিন সেখানে ভর্তি ছিল। এরপর থেকে বাসায় আছে। তার চিকিৎসার জন্যও প্রচুর টাকা খরচ হয়েছে ধার-কর্জ করে। ঔষধ কিনতে অনেক টাকা খরচ হচ্ছে। এখনও ক্ষত স্থান শুকায়নি। হাতে-পায়ে প্রচণ্ড ব্যথা। ধাক্কা-ধাক্কি করে লাইনে দাঁড়িয়ে ত্রাণও সংগ্রহ করা যাচ্ছে না। ট্রলার ভাড়ার দেনার টাকা, গুলিবিদ্ধ পুত্রের চিকিৎসার জন্য জরুরি ঔষধ কেনার টাকা, ঝুপড়ি বাসার মাসিক ভাড়ার টাকা এবং ৮ সদস্যের পরিবারের খরচের টাকা যোগাড় করতে নিরুপায় হয়ে ভিক্ষায় নামতে হয়েছে।

তিনি আরও বলেন ‘আমি জন্মান্ধ নই। বালক অবস্থায় ১৩ বছর বয়সে অসুস্থতায় আমার উভয় চোখ নষ্ট হয়ে যায়। মিয়ানমারে মুসলমানদের উন্নত চিকিৎসার কোনো সুযোগ নেই। ১৫ বছর বয়সে আমি হাইচ্ছুরাতা গ্রামে হাফেজ আবুল খায়েরের তত্বাবধানে হেফজ শুরু করি। শিক্ষক এবং সহপাঠীদের সহযোগিতায় আমি পূর্ণ পবিত্র কুরআন হেফজ সমাপ্ত করেছি। এখন আমি চরম অসহায়। কর্জ পরিশোধ করা দূরে থাক, গুলিবিদ্ধ ছেলে এবং জরুরি খরচ মেটানো সম্ভব হচ্ছেনা। ঝুপড়ি বাসার মাসিক ৫০০ টাকা ভাড়া পরিশোধ করাও আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই আমি থাইংখালীতে চলে যাব।