ঢাকা, মঙ্গলবার   ৩০ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ১৭ ১৪৩১

যেভাবে চিনবেন মিথ্যাবাদী

প্রকাশিত : ০৮:১৯ পিএম, ২৮ অক্টোবর ২০১৭ শনিবার | আপডেট: ০৮:৩৩ পিএম, ২৮ অক্টোবর ২০১৭ শনিবার

দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োজনের তাগিতে আমরা অনেকেই মিথ্যার আশ্রয় নেই। অপ্রয়োজনীয় বা অতিরঞ্জিত মিথ্যা বলাটা আমাদের সমাজে এক রকম প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় মিথ্যা সংস্কৃতি পরিধি ব্যাপক। আর এ ধরনের মিথ্যা শনাক্ত করতে পারা অনেক কঠিন। এ ধরনের মিথ্যা অধিকাংশ সময়ই গুরুত্বহীন, এতে কারো তেমন কোনো লাভ বা ক্ষতি হয় না।

কিন্তু পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে সন্দেহভাজন অপরাধীর বক্তব্য, প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য, রাজনৈতিক নেতাদের বক্তব্য, ব্যবসায়িক অংশীদারের বা জটিল সম্পর্কের ক্ষেত্রে সঙ্গীর বক্তব্য- এসব ক্ষেত্রে তারা মিথ্যা বুঝতে পারাটা খুবই জরুরি। কথা বলার সময় মানুষের চোখ, হাত-পা সহ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের নড়াচড়া দেখে অনেক সময়ই বোঝা সম্ভব, কথাগুলো কি কোনো মানসিক চাপের মুখে বলা হচ্ছে, নাকি স্বাভাবিকভাবেই বলা হচ্ছে।

বডি ল্যাঙ্গুয়েজ বিশেষজ্ঞ ড্যারেন স্ট্যান্টনের মতে, মানুষের শরীরের ডিটেকশন অ্যাপ্রিহেনশন প্রক্রিয়ার অর্থ একজন মানুষ একটি মিথ্যাকে যত বেশি গোপন করতে চাইবে, তার শরীর সে বিষয়ে তত বেশি ইঙ্গিত দেবে।

দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআইয়ের এজেন্ট এবং ‘How to Spot Lies Like the FBI’ বইয়ের লেখক মার্ক বুটন বলেন, স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে মানুষ কীরকম আচরণ করে, সেটা জানা থাকলেই কেবল অস্বাভাবিক আচরণ থেকে কোনো ব্যক্তির বক্তব্য মিথ্যা কিনা, সেটি বোঝা যেতে পারে।

চোখের মণির নড়াচড়া

বলা হয়ে থাকে চোখে চোখ রেখে যারা কথা বলতে পারেন তাদের সৎ সাহস রয়েছে। অপরদিকে যারা মিথ্যা বলেন, তাদের চোখের মণি নড়াচড়া করে। এফবিআই কর্মকর্তা মার্ক বুটনের মতে, মানুষ যখন কোনো বিষয় বলতে গিয়ে অস্বস্তি অনুভব করে, তখন তার চোখের মণি এদিক-সেদিক নড়াচড়া করে। এতে একটা বিষয় পরিষ্কার হয় যে, তাকে যে প্রশ্ন করা হয়েছে তার দ্বারা জব্দ হয়ে গেছেন অথবা উত্তর দিতে চাচ্ছেন না।

চোখের পাতা ঘন ঘন ফেলা

মিথ্যা বলার সময় পরপর পাঁচ-ছয় বার খুব দ্রুত চোখের পাতা ফেলা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। মানুষ সাধারণত প্রতি মিনিটে পাঁচ থেকে ছয় বার, অর্থাৎ প্রতি ১০ থেকে ১২ সেকেন্ডে একবার চোখের পাতা ফেলে। মার্ক বুটনের মতে,  কিন্তু যখন কেউ মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে মানসিক চাপের সম্মুখীন হয় তখন তিনি কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই খুব ঘন ঘন পাঁচ-ছয়বার চোখের পাতা ফেলতে পারেন।

দৃষ্টি সরিয়ে নেওয়া বা একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকা

মুখোমুখি কারো সঙ্গে কথা বলার সময় মানুষ সাধারণত একটানা তিন থেকে পাঁচ সেকেন্ডের বেশি তাকিয়ে থাকে না। কিন্তু মিথ্যা কথা বলার সময় চোখে চোখ ধরে রাখার মতো মানসিক শক্তি অর্জন করতে পারে না। ধরা পড়ার ভয়ে চোখ ফিরিয়ে নেয়, অন্য কিছুর দিকে তাকিয়ে কথা বলে। মার্ক বুটেনের মতে, সব সময় এটি সত্য না-ও হতে পারে। অনেকেই মিথ্যা কথা বলার সময় বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনের জন্য এবং নিজেকে সত্যবাদী প্রমাণের জন্য জোর করে দীর্ঘ সময় ধরে তাকিয়ে থাকতে পারেন।

এক সেকেন্ডের বেশি সময় ধরে চোখ বন্ধ রাখা

স্বাভাবিকভাবে মানুষের চোখের পাতা ফেলতে ১০০ থেকে ৪০০ মিলি সেকেন্ড অর্থাৎ সেকেন্ডের ১০ ভাগের ১ ভাগ থেকে ৪ ভাগ সময়ের মধ্যে চোখের পাতা পড়ে। কিন্তু মিথ্যা বলার সময় মানুষ আত্মরক্ষার কৌশলে চলে যায়। ফলে সে সময় অনেকে অধিক সময় ধরে চোখ বন্ধ রাখতে পারেন। প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে সে ১ থেকে ২ সেকেন্ড চোখ বন্ধ করে রাখতে পারেন।

ডানে উপরের দিকে তাকানো

মার্ক বুটন বলেন, ডানহাতি মানুষগুলো স্মৃতি থেকে কোনো কিছু মনে করার চেষ্টা করার সময় তাদের দৃষ্টি থাকে বাম দিকে উপরের কোনে। আর তারা যদি কল্পনাশক্তি ব্যবহার করার চেষ্টা করে, তাহলে তাদের দৃষ্টি থাকে ডান দিকের উপরের কোনে। আর যারা বাঁহাতি, তাদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা সম্পূর্ণ উল্টো।

অর্থাৎ যখন কোনো মানুষকে এমন কিছু সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়, যা সে পূর্বে দেখেছে বা শুনেছে এবং তাকে একটু চিন্তা করে বিষয়টা স্মৃতি থেকে স্মরণ করে উত্তর দিতে হবে, তখন তার চোখের নড়াচড়া দেখে বোঝা সম্ভব, তিনি মিথ্যার আশ্রয় নিচ্ছেন কিনা।

তবে বুটন বলেন, কিছু কিছু মানুষ সোজা সামনের দিকে তাকিয়েই স্মৃতিশক্তি বা কল্পনাশক্তি ব্যবহার করতে পারে।

নকল হাসি দেওয়া

শ্রোতাকে আশ্বস্ত করতে অনেকে কৃত্রিম হাসি দিয়ে মিথ্যা ঢাকতে চায়, তার বিশ্বাস অর্জন করতে চায়। কৃত্রিম হাসি শনাক্ত করার উপায় সম্পর্কে মার্ক বুটন বলেন, কেউ যদি সত্যি সত্যিই হাসে, তাহলে তার চোখ কুঁচকে যায় এবং চোখের নিচে ভাঁজ পড়ে। কিন্তু কৃত্রিম হাসি দেওয়ার সময় শুধু মুখের আকৃতিই পরিবর্তিত হয়, চোখের উপর কোনো প্রভাব পড়ে না।

ঠোঁট ভাঁজ করা

মিথ্যা কথা বলার সময় মানসিক চাপের কারণে এবং শরীরের অভ্যন্তরে রাসায়নিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার কারণে মানুষের মুখ শুকিয়ে যেতে থাকে। ফলে ঘন ঘন দুই ঠোঁট ভাঁজ করে জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিতে দেখা যায়। এছাড়া মিথ্যা কথা বলার সময় অনেককে ঘামাতে এবং বারবার ঢোক গিলতে দেখা যায়।

মুখমণ্ডল স্পর্শ করা

মিথ্যা কথা বলার সময় মানুষের শরীরে এক ধরনের রাসায়নিক বিক্রিয়া হয়, যার ফলে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ, বিশেষ করে মুখমণ্ডল চুলকাতে থাকে। ফলে মিথ্যা বলার সময় মানুষকে ঘন ঘন নাকের ডগা, গাল বা ঘাড় চুলকাতে দেখা যায়।

মার্ক বুটনের মতে, মিথ্যা কথা বলার সময় অনেকে মুখের সামনে বারবার হাত নিয়ে আসে। তারা হাত দিয়ে মুখটাকে ঢেকে রাখার চেষ্টা করে, যেটা মিথ্যাটিকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা হিসেবে তার অবচেতন মন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। অনেককে আবার মিথ্যাটিকে ঝেড়ে ফেলে দেওয়ার প্রতীকি আচরণ হিসেবে জামা-কাপড়ের অদৃশ্য ধুলা পরিস্কার করতেও দেখা যায়!

দ্রুত নিশ্বাস নেওয়া

মিথ্যা কথা বলার সময় মানসিক চাপের কারণে মানুষের হৃদকম্পন বেড়ে যায়। ফলে হার্টে বেশি রক্ত সঞ্চালনের প্রয়োজন হয়। একারণেই মিথ্যা বলার সময় মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত হয়ে যায়। এছাড়াও মিথ্যা বলার সময় কেউ যদি চুইংগাম চিবুতে থাকে, তাহলে তার চিবুনোর হার দ্রুত হয়ে যায়। ধূমপান করার সময় মিথ্যা বলতে শুরু করলে সিগারেট দ্রুত শেষ হয়ে যেতে পারে।

কাশি দেওয়া

অস্বস্তিকর, মিথ্যা এবং আলোচনা করতে আগ্রহী না, এরকম বিষয়ে কথা বলার সময় মানুষ নিজের অজান্তেই কাশি দেয়। অতিরিক্ত উদ্বেগ থেকে গলা শুকিয়ে যাওয়ার কারণেই মিথ্যা বলার সময় কাশি আসে।

বডি ল্যাংগুয়েজ বিশেষজ্ঞ ড্যারেন স্ট্যান্টনের মতে, জিজ্ঞাসাবাদের সময় যদি দেখা যায়, কোনো প্রসঙ্গ এসে পড়ায় সে কাশি দিচ্ছে, তাহলে নিশ্চিত হওয়ার জন্য প্রথমে ভিন্ন প্রসঙ্গে চলে যাওয়া উচিত। কিছুক্ষণ পর আবারও সেই প্রসঙ্গে ফিরে এলে যদি দেখা যায় সে আবারও কাশি দিচ্ছে, তাহলে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব যে, সে এই প্রসঙ্গে কথা বলতে অস্বস্তি বোধ করছে অথবা মিথ্যা কথা বলছে।

হাত-পায় নড়াচড়া

মিথ্যা কথা বলার সময় অনেককে হাতের আংটি, ব্রেসলেট, ঘড়ি, কলম ইত্যাদি ধরে নাড়াচাড়া করতে বা ঘুরাতে দেখা যায়। মেয়েদের সাধারণত এ সময় হাত দিয়ে চুল প্যাঁচাতে দেখা যায়। অনেকে হাতের তালু দিয়ে পায়ের উপর ঘষতে থাকেন।

স্বাভাবিক অবস্থায় মানুষ হাত-পা ছড়িয়ে স্বাভাবিকভাবে বসে। কিন্তু মিথ্যা কথা বলার সময় মানুষকে হাত-পা গুটিয়ে নিতে দেখা যায়। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রাখা, দুই হাত ভাঁজ করে বুকের উপর রাখা, পায়ের উপর পা তুলে সেই পা পেছনে লুকিয়ে রাখা, পা ভাঁজ করে চেয়ারের ভেতর দিকে নিয়ে যাওয়া– এগুলো এ ধরনেরই কয়েকটি আচরণ।

গলার স্বর পরিবর্তন

মিথ্যা কথা বলার সময় মানুষের গলার স্বর পরিবর্তিত হয়।  এ সময় নিজের অজান্তেই মানুষের গলার স্বরের তীক্ষ্ণতা বৃদ্ধি পেতে পারে, অথবা গলার স্বর ভাঙা ভাঙা মনে হতে পারে। অনেকে এমন সময় তোতলাতে পারেন। আবার অস্বস্তি কাটাতে অনেককে দ্রুত লয়ে কথা বলতে দেখা যায়।

অতিরিক্ত কথা বলা

অতিরিক্ত কথা বলা মিথ্যা বলার আরেকটি লক্ষণ। গুরুত্বপূর্ণ মিথ্যা ঢাকতে গিয়ে মানুষ প্রাসঙ্গিক, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ নয়, এরকম ছোটখাট বিষয় গুরুত্ব দিয়ে বর্ণনা করতে থাকে।

প্রশ্ন করার সাথে সাথেই উত্তর দেওয়াটাও মিথ্যা বলার লক্ষণ হতে পারে। বিশেষ করে পুলিশি জেরার সময় অপরাধী যদি প্রশ্ন করার সাথে সাথেই উত্তর দেওয়া শুরু করে, তার অর্থ হতে পারে যে, তার উত্তরটি সাজানো এবং আগে থেকে অনুশীলন করা। এরকম ক্ষেত্রে মানুষকে কোনো ঘটনার দিন, তারিখ, সময় সহ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনা বিস্তারিত বিষয়গুলো উল্লেখ করতে দেখা যায়।

উত্তর দিতে বিলম্ব বা অস্বস্তি বোধ করা

আগে থেকে উত্তর তৈরি করা থাকলে প্রশ্ন করার সাথে সাথেই উত্তর দেওয়া শুরু করেন মিথ্যার আশ্রয় নেওয়ার মানুষেরা। কিন্তু যদি নতুন কোনো প্রশ্নের উত্তরে মিথ্যে বলতে হয়, তাহলে উত্তর গুছিয়ে নেওয়ার জন্য স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি সময় নেয়। এছাড়াও মিথ্যা বলার সময় মানুষ নিজে থেকে অপ্রয়োজনীয় বিষয় বিস্তারিত বর্ণনা করে, কিন্তু কোনো নির্দিষ্টি বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চাইলে ধরা পড়ার ভয়ে সে ব্যাপারে আর বিস্তারিত বলতে আগ্রহী হয় না। বরং পূর্বে বলা বিষয়ই পুনরাবৃত্তি করতে থাকে। সূত্র : বিজনেস ইনসাইডার। 

ডব্লিউএন