ঢাকা, শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ১২ ১৪৩১

অনিশ্চয়তার পথে আটকে পড়া পাকিস্তানিদের আগামী প্রজন্ম

আলী আদনান

প্রকাশিত : ০৯:৩৫ পিএম, ৯ নভেম্বর ২০১৭ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ১০:২৮ এএম, ১০ নভেম্বর ২০১৭ শুক্রবার

১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান ভাগ হওয়ার সময় তারা মুসলিম প্রধান দেশে থাকতে চেয়েছিলেন। পরে শিকার হন পাকিস্তানের নোংরা রাজনীতির। ঠাঁই মেলে পূর্ব বাংলায়। কিন্তু ৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় ও পরে ৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তারা বাংলাদেশের মানুষের দাবির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। দেশ স্বাধীন হলো, তারা হয়ে গেল একঘরে। সেই থেকে কোনঠাসা। এই হলো দেশে বসবাসকারী আটকে পড়া পাকিস্তানিদের বর্তমান অবস্থা। নাগরিক অধিকার বঞ্চিত মানুষগুলো প্রজন্মের পর প্রজন্ম শুধু বঞ্চিত হচ্ছে। আর তাতে বাড়ছে অপরাধ প্রবণতা।

বাংলাদেশে আটকে পড়া উর্দুভাষী পাকিস্তানিদের সংখ্যা বর্তমানে পাঁচ লাখের বেশি। এদের মধ্যে তিন লাখ এখনও শরণার্থী ক্যাম্পে বসবাস করে। তাদের বড় একটি অংশ বাস করে মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্পে। লিয়াকত হাউজিং সোসাইটির সাথে চুক্তির মাধ্যমে এ স্থানটিতে অস্থায়ী ভিত্তিতে ক্যাম্প তৈরি করা হয়। এখানে এখন বসবাস করে প্রায় ৪০ হাজার লোক।

এই বিশাল জনগোষ্ঠীটি খুবই মানবেতর জীবন যাপন করে। মানুষ বেড়েছে। বাড়েনি থাকার আয়তন। মোহাম্মদপুরের একটি ক্যাম্পে এক একটি খুপড়ি ঘরে বাস করে দশ থেকে পনের জন। তেমনি একজন বাসিন্দা মোহাম্মদ শামীম। তিনি বলেন, ‘স্বামী, ছেলে, ছেলেবৌ, মেয়ে, নাতি নিয়ে একই ঘরে থাকি। লজ্জা নিয়েও এভাবে থাকতে বাধ্য হচ্ছি। কী করব?’

শুধু তিনি নন, সবগুলো ঘরের চিত্র এক রকম। একটি কক্ষের ভিতরে রান্না, খাওয়া, ঘুম। সেখানেই ঠাসাঠাসি করে রাখা থাকে সকল পারিবারিক জিনিসপত্র। একটি রান্না ঘর ব্যবহার করে অনেকগুলো পরিবার। শৌচাগারের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। আজকের এই সময়েও ফ্যামিলি প্ল্যানিং নামে কোনো শব্দ প্রবেশ করেনি সেখানে।

তাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা নাগরিক সুবিধার অভাব। তারা এদেশে বসবাস করলেও অধিকাংশ লোকের নাগরিকত্ব নেই। অধিকাংশ লোকের ২০০৯ সালের আগে কোনো ভোটাধিকার ছিল না। ফলে পড়াশুনা, চাকরিসহ নানা নাগরিক সুবিধার ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়তে হয় তাদের। ফলে অভাবের সাথে লড়াই করা মানুষগুলো হয়ে উঠে অপরাধপ্রবন।

পড়ন্ত বিকেলে ক্যাম্পের ভিতর দিয়ে এ প্রতিবেদক যখন হাঁটছিলেন, তখন এক যুবক তাকে এসে হাতের মুঠো খুলে কতগুলো লাল গুঁটি (ইয়াবা) দেখায়। প্রতিবেদক কৌশলে দাম জানতে চাইলে বলে পাঁচশ টাকা পিস। দর দামের একপর্যায়ে তিনশ টাকায় নেমে আসে। প্রতিবেদক তার নাম জানতে চাইলে সে সরলভাবে নাম স্বীকার করে। সেখানে কথা বলতে বলতে কয়েক মিনিটের মধ্যে জড়ো হয় বেশ কয়েকজন যুবক। তারা সবাই আড্ডাচ্ছলে ইয়াবা বিক্রি করে। হাত বাড়ালে পাওয়া যায় ইয়াবাসহ নানা মাদক। তবে এই মাদক কোত্থেকে আসে, কীভাবে আসে সে ব্যপারে মুখ খোলেনি কেউ।

মোহাম্মদপুরসহ অন্য বিহারী ক্যাম্পে উড়ে চাঁদ তারা মার্কা সবুজ পতাকা। তারা সবাই ক্যাম্পে উর্দু ভাষায় কথা বলেন। তবে পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্যের প্রশ্নে তারা দু’ভাগে বিভক্ত। একটি অংশ পাকিস্তানে ফিরে যাওয়ার পক্ষে হলেও অন্য অংশটি এদেশে স্থায়ী নাগরিকত্ব চায়।

জেনেভা ক্যাম্পের আরেক ব্লকে ঘুরতে গিয়ে পরিচয় হল ক্যাম্পের বাসিন্দা ছবিরা খাতুনের সাথে। বয়স ৮৭। তার কাছে জানতে চাইলাম অতীত সম্পর্কে। তিনি স্মৃতি হাতড়ে বলতে থাকেন, ১৯৪৭ সালে ভারত পাকিস্তান আলাদা হয়ে যায়। এরপর হিন্দু মুসলমান বিরাট রায়ট হয়। মৃত্যু পিছনে পিছনে ঘুরত। জান বাঁচাতে পালিয়ে আসি ঢাকায়। তখন আমার বয়স কুড়ি বাইশ হবে। পুরোটা জীবন এদেশে অবস্থান করছি। চার সন্তান ১৯৭৩ সালে কয়েক দফায় পাকিস্তান চলে যায়। বড় ছেলেটি মারা গেছে সেখানেই। মৃত ছেলেটির মুখ দেখার সুযোগ পাইনি। জীবনের শেষ সময়ে এসে সন্তানদের মুখ দেখতে ইচ্ছে করে। কিন্তু সে সুযোগ আর নেই।

একই অবস্থা বিবি আয়েশার। তিনি বলেন, যদিও আমরা এখানে বাঙালিদের সাথে মিলেমিশে বসবাস করি, কিন্তু মনের দিক থেকে চিরকাল ছোট হয়ে আছি। আমরা দেশটাকে কখনো আমাদের বলে দাবি করতে পারিনি। আবার পাকিস্তানে এতদিন পর ফিরে গেলেও সেখানেও খাপ খাইয়ে ওঠতে পারব না। সেখানেও আমরা ভিনদেশী হয়ে থাকব। আমরা যেখানেই যাইনা কেন সব জায়গায় পরবাসী।

মোহাম্মদপুর ক্যাম্পে স্থানীয় বিহারী শিশুদের নিয়ে পরিচালিত হয় একটি জুনিয়র স্কুল। বিদেশি দাতা সংস্থা OBAT দ্বারা পরিচালিত স্কুলটির নাম ‘নন- লোকাল জুনিয়র OBAT স্কুল। এই স্কুলের বেশকিছু ছাত্র ছাত্রী এ প্রতিবেদককে ঘিরে ধরে। তারা বলে উঠে, আমরা এই ক্যাম্পে থাকতে চাই না। আমরা স্বাভাবিক জীবন চাই। অন্য সাধারণ মানুষদের মত নিঃশ্বাস নিতে চাই।

এদেশে শরণার্থী হিসেবে বসবাস করা বিহারীদের সেদেশের সরকার ফেরত নিবে কি নিবে না তা নিয়ে পরিস্থিতি আগের চাইতেও ঘোলাটে। ইতোমধ্যে উর্দুভাষী এসব বিহারীদের ৬৫ ভাগ ভোটার হওয়ায় বেড়েছে জটিলতা। তারা আজকের এই অবস্থায় এসে ফিরে যেতে নারাজ।

নাগরিকত্বের দাবিতে আটকে পড়া পাকিস্তানিরা ২০০৭ সালে উচ্চ আদালতে একটি রিট করেছিলেন। পরের বছর হাইকোর্টের দেওয়া রায়ে উল্লেখ করা হয়, ‘‘এই ভূখণ্ডে জন্মগ্রহণকারী উর্দুভাষী সকলেই বাংলাদেশের নাগরিক।’’

কিন্তু ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রণীত বাংলাদেশের নাগরিকত্ব আইনের খসড়া নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন আটকে পড়া পাকিস্তানিরা। ওই খসড়ায় বলা হয়, ‘‘জন্মসূত্রে যিনি নাগরিক হবেন, তাঁর পিতা মাতাকেও এই ভূখণ্ডে জন্মগ্রহণ করতে হবে। পিতা মাতা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলে অথবা বাংলাদেশের শত্রু, এমন দেশের প্রতি আনুগত্য দেখালে, তাদের সন্তানরা নাগরিকত্ব পাবে না।’’

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, সার্বিক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে সরকার আটকে পড়া পাকিস্তানিদের জন্য পুনর্বাসনের পরিকল্পনা করছে। ঢাকার বিহারীদের কেরাণীগঞ্জে এবং অন্যান্য জেলার বিহারীদের ওইসব জেলার কোনো সুবিধাজনক জায়গায় পুনর্বাসনের কথা ভাবছে। পুনর্বাসনের জন্য অধিগ্রহণ ও ক্রয়কৃত জমির পরিমাণ, কী পরিমান জমি দখলমুক্ত রয়েছে, আটকে পড়া পাকিস্তানিরা কী পরিমান জমির উপর বসবাস করছে, তাদের পুনর্বাসনের জন্য কী পরিমাণ জমি লাগবে তা নিয়ে চলছে যথেষ্ট হিসাব-নিকাশ।

আটকে পড়া পাকিস্তানিদের মধ্যে যারা পাকিস্তানে ফিরে যেতে চান তাদের বেশিরভাগের বসবাস চট্টগ্রামে। চট্গ্রামের ফিরোজশাহ কলোনী, শেরশাহ কলোনী, অক্সিজেন- বায়েজীদ এলাকা, আঁতুড়ার ডিপোসহ আরো বেশ কয়েকটি এলাকায় তাদের বাস। এ অঞ্চলের বিহারীরা মুক্তিযুদ্ধের সময় শুধু বিরোধিতাই নয়, বরং মুক্তিযোদ্ধাদের অনেক ক্ষতি করার প্রমাণ পাওয়া যায়। ফলে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে সেখানে বেশ সহিংসতা ঘটে। এ অঞ্চলের অধিকাংশ অশিক্ষিত বা অল্পশিক্ষিত বিহারীদের ছেলেমেয়েরাও তেমন বেশি পড়াশুনার সুযোগ পায়নি। এদের অনেকেই পেশাগত জীবনে বেছে নেয় গার্মেন্টসসহ নানা ধরনের শারীরিক পরিশ্রমের কাজ। তবে তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ‘বিহারী’ পরিচয় পেলে চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো চাকরি দিতে আগ্রহ দেখায় না।

ফিরোজশাহ কলোনীর যুবক মোহাম্মদ সালাম। দীর্ঘদিন ধরে মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু NID কার্ড না থাকায় পাসপোর্ট করাতে পারছেন না। মোহাম্মদ রুস্তম আলী নামের (ছদ্মনাম) একজন জানালেন, তার তিন ছেলেমেয়ে পরিচয় গোপন করে চাকরি করে। ফিরোজশাহ কলোনির প্রত্যেকটি বিহারী পরিবার উর্দুভাষী। প্রায় প্রতিটি পরিবার ও বেশ কিছু দোকানের সামনে উড়তে দেখা গেল পাকিস্তানি পতাকা। তাদের অফিসে বড় করে ঝুলানো পাকিস্তানের জনক হিসেবে স্বীকৃত মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ’র ছবি। এই অফিসেই কথা হল সাবের হোসেন নামের একজনের সাথে। ভাঙ্গা বাংলায় তিনি বলেন, এদেশে হামারা কিছুই পাইনা। আমরা আমাদের নিজ দেশ পাকিস্তানে ফিরে যতে চাই।’

একটি স্বাধীন রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে দীর্ঘদিন ধরে কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়া ঝুলে থাকা এ বিশাল জনগোষ্ঠী আসলেই উভয় দিক থেকেই অস্বস্তিকর। দীর্ঘদিনেও এমন সমস্যার সমাধান না হওয়ায় হতাশ অনেকে। তার উপর যখন তাদের একটি অংশ ফিরে যেতে চায়, অন্য অংশটি চায় নাগরিকত্ব- তখন সরকারের হস্তক্ষেপের বিষয়টি সামনে আসে।

তবে এই জটিলতার সমাধান কবে হবে বা আদৌ হবে কিনা তা নিয়ে বলতে পারছেন না কেউ।

এ নিয়ে কথা হল, আটকে পড়া পাকিস্তানিদের সংগঠন SPJRC এর সাধারণ সম্পাদক শওকত আলীর সাথে। তিনি বলেন, আমরা সারা জীবন অনিশ্চয়তার মধ্যে ছিলাম। আমরা চাইনা আমাদের সন্তানরা অনিশ্চয়তায় দিন কাটাক। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অনেক জটিল সমস্যার সমাধান করেছেন। আমাদের বিশ্বাস, তিনি আমাদের এই সমস্যার সমাধান করবেন।

এএ/ডব্লিউএন