ঢাকা, শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ৬ ১৪৩১

ছেলেবেলায় কবিতা লেখা শিখতে চাননি হুমায়ূন আহমেদ!

প্রকাশিত : ১১:২০ পিএম, ১৩ নভেম্বর ২০১৭ সোমবার

সাধারণ মানুষের জানার আগ্রহ থাকে তাদের প্রিয় কবি সাহিত্যিকরা ছেলেবেলায় কি হতে চাইতেন। বিশেষ করে বিখ্যাত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে এ বিষয়টা আরও প্রবলভাবে লক্ষ্য করা যায়। তেমনি বাংলা কথাসাহিত্যের অন্যতম দিকপাল প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদ ছেলেবেলায় কি হতে চেয়েছিলেন এ নিয়ে অনেকের আগ্রহের কমতি নেই। ওই সময়ের একজন কবি তাকে কবিতা লিখা শিখিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। আর এর জবাবে তিনি বলেছিলেন, আমি কবিতা লেখা শিখতে চাই না। অর্থাৎ তার কবিতা লিখার ইচ্ছে ছিল না ওই সময়ে এমনটিই জানা যায় তার ‘আমার ছেলেবেলা’ নামক বইয়ের সাহিত্য বাসর অধ্যায়ে।

সাহিত্য বাসর অধ্যায়ে তিনি লিখেছেন -

বাবার অসংখ্য বাতিকের একটি হল-সাহিত্য-বাতিক। মাসে অন্তত দু’বার বাসায় ‘সাহিত্য বাসর’ নামে কী যেন হত। কী যেন হত বলছি এই কারণে যে, আমরা ছোটরা জানতাম না কী হত। আমাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। সাহিত্য চলাকালীন আমরা হৈ চৈ করতে পারতাম না, উঁচু গলায় কথা বলতে পারতাম না, শব্দ করে হাসতেও পারতাম না। এর থেকে ধারণা হত, বসার ঘরে তাঁরা যা করছেন তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে একদিন খানিকটা শুনলাম। আমার কাছে পুরো ব্যাপারটা হাস্যকর মনে হল। একজন খুব গম্ভীর মুখে একটা কবিতা পড়ল। অন্যরা তার চেয়েও গম্ভীর মুখে শুনল। তারপর কেউ বলল, ভালো হয়েছে, কেউ বলল মন্দ এই নিয়ে তর্ক বেধে গেল। নিতান্তই ছেলেমানুষী ব্যাপার। একদিন একজনকে দেখলাম রাগ করে তার লেখা কুচিকুচি করে ছিঁড়ে ফেলে দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে গেল। অম্নি দু’জন ছুটে গেল তাকে ধরে আনতে। ধরে আনা হল। বয়স্ক একজন মানুষ অথচ হাউমাউ করে কাঁদছে। কী অদ্ভুদ কাণ্ড! কাণ্ড এখানে শেষ হয় না। ছিঁড়ে কুচিকুচি করা কাগজ এরপর আঠা দিয়ে জোড়া লাগানো হতে লাগল। সেই লেখা পড়া হল, সবাই বলল, অসাধারণ এই হচ্ছে বাবার প্রাণপ্রিয় সাহিত্য বাসর।

সারাটা জীবন তিনি সাহিত্য সাহিত্য করে গেলেন। কতবার যে তিনি ঘোষণা করেছেন, এবার চাকরি ছেড়ে দিয়ে পুরোপুরি সাহিত্যে মনোনিবেশ করবেন! চাকরি এবং সাহিত্য দুটো একসঙ্গে হয় না।

ট্রাংকে বোঝাই ছিল তাঁর অসমাপ্ত পাণ্ডুলিপি। গল্প কবিতা, নাটক, প্রবন্ধ। থরেথরে সাজানো। বাবার সাহিত্যপ্রেমের স্বীকৃতি হিসেবে আমাদের বসার ঘরে বড় একটা বাঁধানো সার্টিফিকেট ঝোলানো, যাতে লেখা- ‘ফয়জুর রহমান আহমেদকে সাহিত্য সুধাকর উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে।’

এই উপাধি তাঁকে কারা দিয়েছে, কেন দিয়েছে কিছুই এখন মনে করতে পারছি না। শুধু মনে আছে বাঁধানো সার্টিফিকেটটির প্রতি বাবার মমতার অন্ত ছিল না। বাবার মৃত্যুর পর তাঁর সমাধিফলকে আমি এই উপাধি এবং শোকগাথায় রবীন্দ্রনাথের দু’লাইন কবিতা ব্যবহার করি।

দূরদূরান্ত থেকে কবি-সাহিত্যকদের হঠাৎ আমাদের বাসায় উপস্থিত হওয়া ছিল আরেক ধরনের ঘটনা। বাবা এঁদের কাউকে নিমন্ত্রণ করে আনতেন না। তাঁর সামর্থ্য ছিল না, তিনি যা করতেন তা হচ্ছে মনিঅর্ডার করে তাঁদের নামে পাঁচ টাকা বা দশ টাকা পাঠিয়ে কুপনে লিখতেন-

জনাব,

আপনার…কবিতাটি…পত্রিকার…সংখ্যায় পড়িয়া মনে বড় তৃপ্তি পাইয়াছি। উপহার হিসেবে আপনাকে সামান্য কিছু অর্থ পাঠাইলাম। উক্ত অর্থ গ্রহণ করিলে চির কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ থাকিব।

ইতি প্রতিভামুগ্ধ-

ফয়জুর রহমান আহমেদ

(সাহিত্য সুধাকর)

ঐ কবি নিশ্চয়ই তাঁর কাব্যের জন্য নানান প্রশংসাবাক্য শুনেছেন, কিন্তু মনি অর্ডারে টাকা পাওয়ার ব্যাপারটা না ঘটারই কথা। প্রায় সময়ই দেখা যেত, আবেগে অভিভূত হয়ে যশোর বা ফরিদপুরের কোনো কবি বাসায় উপস্থিত হয়েছেন।

এমনিভাবে উপস্থিত হলেন কবি রওশন ইজদানী। পরবর্তীকালে তিনি খাতেমুন নবীউন গ্রন্থ লিখে আদমজী পুরস্কার পান। যখনকার কথা বলছি তখন তাঁর কবিখ্যাতি তেমন ছিল না।

আমার পরিষ্কার মনে আছে, লুঙ্গি-পরা ছাতা-হাতে এক লোক রিকশা থেকে নেমে ভাড়া নিয়ে রিকশাওয়ালার সঙ্গে তুমুল তর্ক জুড়ে দিয়েছেন। জানলাম, ইনি বিখ্যাত কবি রওশন ইজদানী। আমাদের বল দেওয়া হল যেন হৈ চৈ না করি, চিৎকার না করি। ঘরে একজন কবি বাস করছেন। কবিতা লেখার মুডে থাকলে ক্ষতি হবে।

দেখা গেল, কবি সারা গায়ে সরিষার তেল মেখে রোদে গা মেলে পড়ে রইলেন। আমাকে ডেকে বললেন- এই মাথা থেকে পাকা চুল তুলে দে।

কবি-সাহিত্যিকরা আলাদা জগতে বাস করেন, মানুষ হিসেবে তাঁরা অন্যরকম বলে যে প্রচলিত ধারণা আছে কবি রওশন ইজদানীকে দেখে আমার মনে হল ঐ ধারণা ঠিক না। তাঁরা আর দশটা মানুষের মতোই, আলাদা কিছু না। আমার আদর-যত্নে, খুব সম্ভব পাকা চুল তোলার দক্ষতায় সন্তুষ্ট হয়ে তিনি আমাকে একদিন ডেকে বললেন, খাতা-কলম নিয়ে আয়, তোকে কবিতা লেখা শিখিয়ে দিই।

আমি কঠিন গলায় বললাম, আমি কবিতা লেখা শিখতে চাই না। তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন, তাহলে কি শিখতে চাস?

কিছুই শিখতে চাই না।

আসলেই তা-ই। শৈশবে কারওর কাছ থেকে আমি কিছুই শিখতে চাইনি। এখনও চাই না। অথচ আশ্চর্য, আমার চারপাশে যাঁরা আছেন তাঁরা ক্রমাগত আমাকে শেখাতে চান।‘জানবার কথা’ নামের একটি বই শৈশবেই ছিঁড়ে কুচিকুচি করে ফেলেছিলাম এই কারণেই।

এসএইচ/ডব্লিউএন