ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৫ ১৪৩০

‘মুনীর চৌধুরী সম্মাননা’ ও ‘মোহাম্মদ জাকারিয়া স্মৃতিপদক’ প্রদান

প্রকাশিত : ০৮:৪৬ পিএম, ২৭ নভেম্বর ২০১৭ সোমবার | আপডেট: ১২:০২ এএম, ২৮ নভেম্বর ২০১৭ মঙ্গলবার

নাট্যসংগঠন থিয়েটার প্রবর্তিত ‘মুনীর চৌধুরী সম্মাননা ও মোহাম্মদ জাকারিয়া স্মৃতি পদক’ প্রদান করা হয়েছে সোমবার, ২৭ নভেম্বর। এ বছর ‘মুনীর চৌধুরী সম্মাননা’ পেয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার এন্ড পারফরমেন্স স্টাডিজ বিভাগের সিনিয়র অধ্যাপক ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন নির্দেশক, গবেষক ও অভিনেতা ড. ইসরাফিল শাহীন। অপরদিকে ‘মোহাম্মদ জাকারিয়া স্মৃতি পদক’ পেয়েছেন নাট্যকার রুমা মোদক।

২৭ নভেম্বর, সোমবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় সেগুনবাগিচাস্থ বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালা মিলনায়তনে আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁদের হাতে এ সম্মাননা ও পদক তুলে দেওয়া হয়।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. গওহর রিজভী। বিশেষ অতিথি ছিলেন আইএফআইসি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী শাহ এ সারওয়ার। থিয়েটার সভাপতি নাট্যব্যক্তিত্ব ফেরদৌসী মজুমদারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার।

অনুষ্ঠানে গুণিজনদের হাতে পদক তুলে দেন ড. গওহর রিজভী।

আইএফআইসি ব্যাংক লিমিটেড এর সৌজন্যে ‘মুনীর চৌধুরী সম্মাননা’র অর্থমূল্য বাবদ ৫০ হাজার টাকার একটি চেক এবং ‘মোহাম্মদ জাকারিয়া স্মৃতি পদক’র জন্য ২৫ হাজার টাকার একটি চেক গুণিজনদের হাতে প্রদান করেন আইএফআইসি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী শাহ এ সারওয়ার।

দ্বিতীয় পর্বে মুনীর চৌধুরীর নাটক ‘দণ্ডধর’ পাঠাভিনয় করে থিয়েটার সংগঠনের সদস্যরা।

মুনীর চৌধুরী সম্মননা আগে যাঁরা পেয়েছেন :

১৯৮৯ সালে প্রখ্যাত অভিনেতা ও গ্রুপ থিয়েটার চর্চার পথিকৃৎ মোহাম্মদ জাকারিয়া, ১৯৯০ সালে যাত্রা জগতের কিংবদন্তি নট-নাট্যকার-নির্দেশক অমলেন্দু বিশ্বাস (মরণোত্তর), ১৯৯১ সালে কৃতী নাট্যকার-নির্দেশক-অভিনেতা আবদুল্লাহ আল-মামুন, ১৯৯২ সালে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার চর্চায় অগ্রণী দল নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়, ১৯৯৪ সালে প্রতিভাধর নির্দেশক ও ডিজাইনার সৈয়দ জামিল আহমেদ, ১৯৯৫ সালে কৃতী নাট্য সংগঠক রামেন্দু মজুমদার, ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশে সর্বাধিক নাট্যগ্রন্থ প্রকাশক মুক্তধারা, ১৯৯৭ সালে কৃতী নাট্যকার ও শিল্প সমালোচক সাঈদ আহমদ, ১৯৯৮ সালে প্রতিভাধর অভিনেতা-নির্দেশক ফেরদৌসী মজুমদার, ১৯৯৯ সালে সব্যসাচী নাট্যকার সৈয়দ শামসুল হক, ২০০০ সালে কৃতী নির্দেশক-অভিনেতা-সংগঠক আতাউর রহমান, ২০০১ সালে প্রতিভাধর নাট্যকার-নির্দেশক-অভিনেতা-সংগঠক মামুনুর রশীদ, ২০০২ সালে কৃতী নির্দেশক-সংগঠক নাসির উদ্দীন ইউসুফ, ২০০৩ সালে প্রতিভাধর নাট্যকার-গবেষক সেলিম আল দীন, ২০০৪ সালে গুণী অভিনেতা-নির্দেশক আলী যাকের, ২০০৫ সালে প্রবীণ নির্দেশক নিখিল সেন, ২০০৬ বহুমাত্রিক অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর, ২০০৭ সালে নাট্যশিক্ষার পথিকৃৎ জিয়া হায়দার, ২০০৮ সালে কৃতী নাট্যকার-নির্দেশক মলয় ভৌমিক, ২০০৯ সালে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মূকাভিনেতা পার্থপ্রতিম মজুমদার, ২০১০ সালে বিশিষ্ট অনুবাদক ও সমালোচক অধ্যাপক আবদুস সেলিম, ২০১১ সালে বাংলাদেশে গ্রুপ থিয়েটার চর্চায় অগ্রণী দল আরণ্যক, ২০১৩ সালে গুণী অভিনেতা-নির্দেশক-সংগঠক লিয়াকত আলী লাকী, ২০১৪ সালে প্রতিভাবান নাট্যকার মৃত্তিকা চাকমা, ২০১৫ সালে কৃতি অভিনেতা-সংগঠক ম. হামিদ, ২০১৬ সালে প্রতিভাধর অভিনেতা কেরামত মাওলা এবং ২০১৭ সালে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন নির্দেশক, গবেষক ও অভিনেতা ড. ইসরাফিল শাহীন।

মোহাম্মদ জাকারিয়া স্মৃতিপদক আগে যাঁরা পেয়েছেন :

১৯৯৭ কৃতী নির্দেশক-অভিনেতা-সংগঠক আহমেদ ইকবাল হায়দার, ১৯৯৮ সালে নাট্যকার-নির্দেশক-অভিনেতা মান্নান হীরা, ১৯৯৯ সালে প্রতিভাধর অভিনেতা-সংগীতশিল্পী শিমুল ইউসুফ, ২০০০ কৃতী আলোক পরিকল্পক ঠান্ডু রায়হান, ২০০১ সালে প্রতিভাবান অভিনেতা-নির্দেশক খালেদ খান, ২০০২ সালে কৃতী সংগঠক-নির্দেশক দেবপ্রসাদ দেবনাথ, ২০০৩ সালে প্রতিভাধর আলোক নির্দেশক নাসিরুল হক খোকন, ২০০৪ সালে প্রতিভাবান নাট্যকার মাসুম রেজা, ২০০৫ সালে কৃতী নাট্যকার-নির্দেশক আমিনুর রহমান মুকুল, ২০০৬ সালে প্রতিভাবান নির্দেশক ফয়েজ জহির, ২০০৭ সালে বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী জগলুল আলম, ২০০৮ সালে প্রতিভাধর নাট্যকার-নির্দেশক শুভাশিস সমীর, ২০০৯ সালে নিষ্ঠাবান নাট্য গবেষক বাবুল বিশ্বাস, ২০১০ সালে গুণী নির্দেশক অসীম দাশ, ২০১১ সালে নাট্যপত্রিকা থিয়েটারওয়ালা, ২০১২ সালে প্রতিভাবান নির্দেশক সুদীপ চক্রবর্তী, ২০১৩ সালে নিষ্ঠাবান নাট্যকার-অভিনেতা সামিনা লুৎফা নিত্রা, ২০১৪ সালে প্রতিভাধর নির্দেশক আইরিন পারভীন লোপা, ২০১৫ সালে কৃতী নির্দেশক-সংগঠক আকতারুজ্জামান, ২০১৬ সালে নিষ্ঠাবান সংগঠক-নির্দেশক অভিজিৎ সেনগুপ্ত এবং ২০১৭ সালে নাট্যকার-অভিনেত্রী রুমা মোদক।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশের নাট্যচর্চার আধুনিক চেতনা সঞ্চারে অগ্রণী পুরুষ মুনীর চৌধুরী। পরিবেশের প্রবল বিরুদ্ধাচরণ উপেক্ষা করে তিনি জ্বালিয়েছিলেন আলোকশিখা, অন্তরে এবং বাহিরে। তাই যেমন নিমগ্ন ছিলেন নাট্যরচনার একনিষ্ঠ সাধনায়, তেমনি আলো দিয়ে আলো জ্বালানোর প্রয়াসে নাট্যান্দোলনের সামাজিক ব্রতেও ছিলেন সমভাবে নিবেদিত। একদিন তাঁর সৃষ্টিশীল ও কুশলী হাতে রচিত হয়েছে প্রোজ্জ্বল কতক মৌলিক নাটক, অনূদিত ও রূপান্তরিত হয়েছে শেক্সপীয়র ও বার্নাড শ’, পাশাপাশি এই নাট্যব্যক্তিত্বকে ঘিরে রচিত হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-যুবাদের নাট্যাচর্চার ভিন্নতর আরেক অধ্যায়। সর্বপরি তিনি স্মরণীয় হয়ে আছেন কারাজীবনে রচিত ‘কবর’ নাটকের জন্য। মুক্তিযুদ্ধের বিজয়লগ্নে ধর্মান্ধ পাশবিক সাম্প্রদায়িক শক্তির নির্মম আঘাতে তাঁর মৃত্যু আমাদের জাতীয় চেতনা ও গৌরবের অঙ্গাঅঙ্গি অংশ করে তুলেছে তাঁকে, যেমনভাবে বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের রক্তধারায় যুক্ত হয়ে তাঁর রক্তও মিশেছে দেশের কাদামাটির সঙ্গে। মুনীর চৌধুরী তাই আমাদের নাটক ও আমাদের জাতির গৌরবগাথার অংশী। মুনীর চৌধুরী থিয়েটার গোষ্ঠির অন্তহীন প্রেরণা। 

মুনীর চৌধুরীর নামাঙ্কিত পদক প্রদানের মধ্য দিয়ে থিয়েটার সম্মান জানায় দেশের নাট্যজগতের নিবেদিতপ্রাণ প্রতিভাবানদের এবং রক্তের ভেতরে পুনরায় অনুভব করতে চায় সেই অঙ্গীকার, নাটকের শিল্পীত চর্চার মধ্য দিয়ে জাতির জাগরণের যে স্বপ্ন সবাই বহন করে চলেছে।

অপরদিকে সর্বজনশ্রদ্ধেয় নাট্যব্যক্তিত্ব মোহাম্মদ জাকারিয়া বাংলা নাটকের ইতিহাসে এক অনন্যসাধরণ সৌভাগ্য দ্বারা বরিত হয়েছিলেন- চল্লিশের দশকে কলকাতায় বাংলা নাটকে যে যুগান্তর ঘটেছিলো গুটিকয় নবীন প্রতিভার মিলিত প্রয়াসে, তিনি ছিলেন সেই তরুণ কাণ্ডারিদের অন্যতম। আবার সত্তরের দশকের সূচনায় স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে যে নবনাট্যধারা কল্লোলিত হয়ে উঠল তিনি ছিলেন সেই জাগরণেরও প্রবীণ অংশী। মোহাম্মদ জাকারিয়া ১৯৪৪ সালে যুগসৃষ্টিকারী প্রযোজনা বিজন ভট্টাচার্যের ‘নবান্ন’ নাটকে শরণার্থীর ভূমিকায় অভিনয় দ্বারা মঞ্চে প্রবেশ করেন। ১৯৪৮ সালে শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র, গঙ্গাপদ বসু প্রমুখের সঙ্গে মিলে তিনি গঠন করেন ‘বহুরূপী’।

স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে নাটকের আশ্চর্য উত্থান সম্পাদিত হয়েছিল একদল তরুণ নাট্যশিল্পীর দ্বারা এবং অনায়াসে তাঁদের সঙ্গে মিশে তাঁদেরই একজন হয়ে উঠেছিলেন সবার আপনকার জাকারিয়া দাদা। ১৯৭২ সালে তিনি থিয়েটার গোষ্ঠিতে যোগ দেন এবং অভিনয়ে অতীত দক্ষতার নব-রূপায়ণ ঘটান ঢাকার মঞ্চে।

নাট্যসংগঠন থিয়েটার মনে করে আগামী দিনের নাট্যকর্মীদের হাতে বাংলা নাটকের নবতর উত্তরণ নিশ্চিত হবে। সেই প্রত্যাশায় ১৯৯৭ সাল থেকে থিয়েটার তরুণ নাট্যকর্মীদের সম্মানিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে এবং এর নামকরণ করে ‘মোহাম্মদ জাকারিয়া স্মৃতিপদক’।


//এসএ