ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৪ ১৪৩০

ভালো নেই শীতল পাটির কারিগররা

তবিবুর রহমান

প্রকাশিত : ০৪:০৮ পিএম, ১০ ডিসেম্বর ২০১৭ রবিবার | আপডেট: ০৫:০০ পিএম, ১৩ জুলাই ২০২০ সোমবার

বাংলাদেশের আবহমান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অনন্য নিদর্শন শীতলপাটি। সূক্ষ্ম বুনন আর দৃষ্টিনন্দন নকশার কারণে মানুষের কাছে এর আলাদা কদর রয়েছে। গরমে আরাম দিতে শীতল পাটির জুড়ি নেই।এ পাটি এরইমধ্যে ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য-২০১৭ (দ্য ইনটেনজিবল কালচারাল হেরিটেজ অব হিউমানিটি) হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। তবে শীতলপাটি বিশ্ব স্বীকৃতি পেলেও কাচাঁমাল, বাজারজাতকরণ, ন্যায্য দামের অভাবে অনেক কষ্টে জীবন অতিবাহিত করছেন এ পেশার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। কারিগরদের অনেকেই মানবেতর জীবন যাপন করছেন। অনেকেই জীবিকার তাগিদে এ পেশা ছেড়ে অন্য কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন।

সিলেট অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী শীতলপাটি নিয়ে রাজধানীর শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরে দুই সপ্তাহব্যাপী প্রদর্শনী চলছে। গত মঙ্গলবার থেকে জাতীয় জাদুঘরের নলিনীকান্ত ভট্টশালী প্রদর্শনী গ্যালারিতে আনুষ্ঠানিকভাবে এর প্রদর্শনী শুরু হয়েছে। জাতিসংঘের শিক্ষা বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা-ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পাওয়ার পর এ পেশার কয়েকজন কারিগরের সঙ্গে কথা হয় ইটিভি অনলাইনের এ প্রতিবেদকের।

তারা জানান, ‘পূর্ব পুরুষেরা করে গেছেন, তাই আমরা বাদ দিতে পারি না। স্থানীয় বাজারে শীতলপাটির বর্তমানে তেমন চাহিদা নেই। কালের পরিক্রমায় এই পেশায় জড়িত দক্ষ কারিগরের টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে প্লাস্টিকসহ বিভিন্ন সামগ্রীর বাজার দখলের কারণে সংকুচিত হয়ে এসেছে শীতলপাটির বিক্রয় ও বিপণন। চাহিদা কমে যাওয়ায় অনেকেই বাধ্য হয়ে এ পেশা ছেড়ে দিয়েছেন।’

প্রদর্শনীতে এসেছেন রমাকান্ত দাস নামের এক কারিগর। গ্রামের বাড়ি মৌলভীবাজারের রাজনগরে। তিনি বলেন, অপূর্ব বুননের শীতলপাটি বাংলার ঘরে ঘরে স্থান করে নিলেও তারা অবহেলিত রয়ে গেছেন। সামান্য বেত দিয়ে অপূর্ব নকশাখচিত পাটি তৈরি করলেও নিজেদের সংসার সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন। এভাবে চলতে থাকলে তাদের ভবিষৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। তার দাবি, ঐতিহ্য ধরে রাখতে হলে তাদের কাজের সঠিক মূল নিশ্চিত করতে হবে।

তিনি আর বলেন, সরকারকে এ বিষয়ে একটি দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। এ খাতে সহজ শর্তে ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। তাহলে শীতলপাটি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে বড় ভূমিকা রাখতে পারবে।

লক্ষণ কুমার নামের এক কারিগর জানান, ‘মুর্তা’ বেত দিয়ে তৈরি হয় শীতল পাটি। সিলেটের গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, বিশেষ করে বালাগঞ্জের প্রায় সর্বত্র ‘মুর্তা’ পাওয়া যেত। বনজঙ্গল কেটে আবাদ ও জনসংখ্যার আধিক্যের কারণে ‘মুর্তা’ বন বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এখন সিলেট শহর থেকে কিনে আনতে হয় এই বেত। এতে অনেক খরচ পড়ে যায়। এরপর একটি শীতল পাটি তৈরি করতে ১ থেকে ২ মাস সময় লাগে। কিন্তু আমরা সে তুলনায় মূল্য পাচ্ছি না। এছাড়া জিনিস পত্রের দাম বাড়ছে প্রতিনিয়ত। একদিকে যেমন চাহিদা কমছে, অন্যদিকে মূলও কমেছে। ফলে ইচ্ছা না থাকালেও অনেকেই এ পেশা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে।

লক্ষণ কুমার বলেন, আগে তাদের গ্রামের প্রায় ১০০ পরিবার এ পেশায় জড়িত ছিল। অনেক চাহিদা ছিল শীতলপাটির। দিনে দিনে চাহিদা কমে এসেছে। তেমননিভাবে এ পেশার মানুষের সংখ্যায়ও কমছে। এখন তাদের গ্রামে মাত্র ৫ জন এই পাশের সঙ্গে জড়িত। তিনি নিজেও এ পেশা থেকে বিদায় নিতে চাচ্ছেন। এখন কেবল কেউ অর্ডার দিলে পাটি তৈরি করে দেন। ৫ বছর আগে তার বাড়িতে ৬ জন লোক কাজ করতো। এখন একাই করছেন।

প্রদর্শনীতে কথা হয়, কার্তিক পালের সঙ্গে। তিনি বলেন, একটি পাটি বুনতে সময় লাগে ২০ দিন। পাটি বিক্রয় করতে হয় ২৫০০ টাকা থেকে ৩০০০ টাকায়। উন্নতমানের পাটি বুনতে সময় লাগে দেড় মাস। এটি বিক্রি করতে হয় ১৫-২০ হাজার টাকায়। ‘মুর্তা’ ক্রয় করে পাটি বানাতে যে খরচ ও সময় ব্যয় হয় তাতে আমাদের পোষায় না। অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার অভাবে মূলধন বিনিয়োগ করতে পারি না। ব্যাংক থেকেও ঋণ পাই না। এ কারণে আমরা এই পেশা ছেড়ে শুধু নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করছি।’

শীতল পাটির নকশিগুলোর মধ্যে বেত দিয়ে মসজিদ, মন্দির, হাঁস, মুরগী, পাখি, বিড়াল, বক ও হরিণসহ বিভিন্ন পশু-পাখির প্রতিকৃতি তৈরি করা হয়।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বলেন, ‘শীতলপাটির সেই সোনালী অতীতকে ফিরিয়ে আনতে সরকারিভাবে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। শীতল পাটি উৎপাদন ও বাজারজাতকরণে বড় ধরনের একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্টদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে, মুর্তার বাগান তৈরি, উন্নত কারুকাজ সম্পর্কে ধারণা প্রদান, সহজ শর্তে ঋণ প্রদান, বাজার সৃষ্টি, উদ্যোক্তা তৈরির বিষয়ে উন্নত প্রশিক্ষণ প্রদান, স্থানীয়ভাবে কারখানা তৈরি, সরকারিভাবে প্রচার ও বিভিন্ন মেলায় শীতলপাটির স্টল দেওয়ারও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের বিভিন্ন পর্যায়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা লোকশিল্পের ঐতিহ্য ধরে রাখতে আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। সরকারিভাবে সহযোগিতার পাশাপাশি বেসরকারিভাবেও আমাদের এগিয়ে আসতে হবে। বিত্তবানদের সৌখিনতার অংশ হিসাবে লোক শিল্পের চাহিদা তৈরির পাশাপাশি বিদেশে রপ্তানি করে আয় করা সম্ভব।

জাদুঘরের বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সভাপতি শিল্পী হাশেম খান বলেন, ‘প্রদর্শনীতে বিভিন্ন নকশা ও আকৃতির শীতল পাটি দর্শকদের জন্য রাখা হয়েছে। শীতল পাটিতে ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে আবহমান বাংলার রূপ, কাল্পনিক চরিত্র, জ্যামিতিক আর্ট, প্রিয়জনের অবয়ব ইত্যাদি। সেই সঙ্গে শীতল পাটির কারিগররা সরাসরি শীতল পাটি তৈরি করে দর্শকদের মুগ্ধ করছেন। তবে আরেকটি বিষয়ও আমাদের মনে রাখতে হবে, সবকিছু দিয়ে শুধু অর্থ আয়ের চিন্তা করা উচিত নয়। কিছু কিছু জিনিস বা পণ্য একটি জাতির সমৃদ্ধ পরিচয় বহন করে। তাই এমন ঐতিহ্যবাহী জিনিসগুলোকে রক্ষা করা আমাদের দায়িত্বের অংশ।’

/ডিডি/ এআর