ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৪ ১৪৩০

বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজ গঠন করেছিলাম: হাসান ইমাম

প্রকাশিত : ০৫:৫৯ পিএম, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৭ বুধবার | আপডেট: ০৮:৫৭ পিএম, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৭ বুধবার

বিশিষ্ট অভিনেতা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সৈয়দ হাসান ইমাম মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করে বলেন, ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আমরা প্রতিবাদী সংগঠন ‘বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজ’ গঠন করি। আমাকে সংগঠনটির আহ্বায়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। আমরা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পাকিস্তান বেতার ও টেলিভিশনের অনুষ্ঠান বর্জন করি। গণআন্দোলনের চাপে পাকিস্তান সরকার ৮ মার্চ থেকে বেতার-টেলিভিশনের দায়িত্ব বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজের হাতে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।

সৈয়দ হাসান ইমাম দেশের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও অসাম্প্রদায়িক আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে আসছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠায় অসামান্য অবদান রেখেছেন। এরইমধ্যে অভিনয় জীবনের ছয় দশক পূর্ণ করেছেন। তিনি একাধারে প্রকৌশলী, আবৃত্তিশিল্পী, অভিনেতা, লেখক ও একজন দক্ষ সংগঠক। এবারের বিজয় দিবস উপলক্ষে তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন একুশে টেলিভিশন অনলাইনের জ্যেষ্ঠ সহ-সম্পাদক দীপংকর দীপক।

ইটিভি অনলাইন : টানা নয় মাস মুক্তিপ্রেমী বীরসেনারা রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম করেছে। এর সূচনা পর্ব সম্পর্কে জানতে চাই-

সৈয়দ হাসান ইমাম : মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে স্বল্প পরিসরে বলা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এর কথা দিনের পর দিন বলে গেলেও শেষ হবে না। ’৭১ সালের মার্চ মাসে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলেও এর সূচনা পর্বটা অনেক আগেই ঘটেছিল। তবে আমি মনে করি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের মাধ্যমে বাঙালি জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতির আহবান জানিয়েছিলেন। অগ্নিবিদারী সেই ভাষণ শুনে আমি আপ্লুত হয়ে পড়েছিলাম। স্বাধীনতা অর্জনকেই মূল লক্ষ্য হিসেবে ধরে নিয়েছিলাম। শুধু আমি নই, লক্ষ বাঙালি তরুণ এই ভাষণের নির্দেশনা অনুসারেই মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।

ইটিভি অনলাইন : আপনি কোথায় বসে বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ শুনেছিলেন?

সৈয়দ হাসান ইমাম : রেসকোর্স ময়দানে সরাসরি আমার ভাষণটি শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল। আমাদের প্রিয় নেতা জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন- এটা আগেই নির্ধারিত ছিল। তাই সমগ্র জাতি তার বজ্রকন্ঠের ভাষণ শোনার জন্য সাগ্রহে অপেক্ষা করছিল। আমিও অধীর আগ্রহে রেসকোর্স ময়দানে ছুটে গিয়েছিলাম। লাখো জনতার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে আমিও উদ্দীপ্ত হলাম। জাতির পিতার সেই ভাষণ ময়দানে উপস্থিত থেকে স্বাধীনতাকামী বাঙালির সঙ্গে শুনতে পারাটা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সৌভাগ্য বলে মনে করছি।

ইটিভি অনলাইন : ওই সময় কী ধরনের অনুভূতি হয়েছিল?

সৈয়দ হাসান ইমাম : ৭ মার্চের দিনটির কথা কোনোভাবেই ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়, এটা শুধু উপলব্ধি করা যায়। তবে সেদিন বাঙালির মুক্তি চেতনা দেখে বুঝতে পেরেছিলাম, স্বাধীনতা আমাদের জন্য অনিবার্য। বাস্তবে তাই ঘটেছে।

ইটিভি অনলাইন : মুক্তিযুদ্ধে কীভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন?

সৈয়দ হাসান ইমাম : পাক হানাদাররা আগে থেকেই বাঙালি তরুণদের ওপর নজর রাখছিলেন। তাই অনেকের কাছে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করাটা জটিল হয়ে পড়েছিল। অনেককে ঝুঁকি নিয়ে ভারতে গিয়ে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে হয়েছে। তবে আমরা ২৫ মার্চের আগেই পাক সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে চলছিলাম। `৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আমাকে আহ্বায়ক করে শিল্পীদের প্রতিবাদী সংগঠন ‘বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজ’ গঠিত হয়েছিল। আমারা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পাকিস্তান বেতার ও টেলিভিশনের অনুষ্ঠান বর্জন করি। গণআন্দোলনের চাপে পাকিস্তান সরকার ৮ মার্চ থেকে বেতার-টেলিভিশনের দায়িত্ব বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজের হাতে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। ২৫ মার্চের পর আমি মুজিব নগরে চলে যাই। সেই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের নাট্য বিভাগের প্রধানের দায়িত্ব পালন করি।

ইটিভি অনলাইন : স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের দিনগুলোর কথা জানতে চাই-

সৈয়দ হাসান ইমাম : প্রথম দিকে আমি স্বনামে বিভিন্ন অনুষ্ঠান করলেও পরে বেতার কর্তৃপক্ষের বিশেষ সিদ্ধান্ত মোতাবেক সালেহ আহমেদ নাম ধারণ করেছিলাম। দেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্ব মুহূর্ত অর্থাৎ ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সংবাদ পাঠ এবং নাট্য বিভাগের দায়িত্ব পালন করি। আমরা প্রায় বিশ-পঁচিশ জন বিভিন্ন ছদ্মনামে অনুষ্ঠান প্রচার করেছি। কারণ তখন পাকিস্তানি এজেন্টরা আমাদের নামে দেশিয় রেডিওতে নানা ধরনের অপপ্রচার চালাচ্ছিল। এতে করে মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে বিভ্রান্তি ছড়াতে পারে, মূলত এ কারণেই আমাদের ছদ্মনাম দেয়া হয়েছিলো।

দেশের সংকটকালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যোগদান করতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছি। মুক্তিকামীদের যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য বেতারের মাধ্যমে অনুপ্রেরণা যোগাতে পেরেছি, এখন তা ভাবতেই ভালো লাগছে। সেই দিনগুলোই ছিলো আমার জীবনের সেরা সময়। এখনও সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়লে শরীর শিউরে উঠে।

ইটিভি অনলাইন : বিজয়ের সংবাদ শুনে কেমন লেগেছিল?

সস্ত্রীক সৈয়দ হাসান ইমাম

সৈয়দ হাসান ইমাম : বিজয়ের সংবাদ শুনে আমরা আনন্দ-উল্লাসে আপ্লুত হয়ে উঠেছিলাম। নিজের এলাকায় ফেরার জন্য মন ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল। স্বাধীনতা আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন। এই অর্জনের সরাসরি সাক্ষী হতে পেরে নিজেকে নিয়ে খুব গর্ব হচ্ছে।

ইটিভি অনলাইন : আসন্ন বিজয় দিবসের কোনো অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করছেন কী?

সৈয়দ হাসান ইমাম : প্রতি বছর বিটিভি, বেতার এবং বেসরকারি নানা চ্যানেলের আয়োজিত বিজয় দিবসের একাধিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে থাকি। এ বছরও সরকারি-বেসরকারি কয়েকটি অনুষ্ঠানে যোগদানের কথা রয়েছে।

ইটিভি অনলাইন : মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা শেয়ার করার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

সৈয়দ হাসান ইমাম : ইটিভি পরিবারকেও ধন্যবাদ।